দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাত্র ছয় বছর পর ১৯৫১ সালে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস ও পশ্চিম জার্মানি প্যারিসে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল। ওই চুক্তির মাধ্যমে দেশগুলো কয়লা ও ইস্পাত উৎপাদন নিয়ে একটি ‘সম্প্রদায়’ গড়ে তুলেছিল, যা ‘ইউরোপিয়ান কোল অ্যান্ড স্টিল কমিউনিটি’ হিসেবে পরিচিত।
এটি গত শতাব্দীর সভ্যতার একটি উল্লেখযোগ্য সফলতা। কারণ, ১৮৭০ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ফ্রান্স ও জার্মানি তিনটি বড় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। ওই যুদ্ধের কারণে উভয় পক্ষের লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল। বহু শহর ও জনপদ ধ্বংস হয়েছিল। বহু এলাকার ভৌগোলিক সীমা বদলে গিয়েছিল। বহু শহরের চেহারা আমূল পাল্টে গিয়েছিল।
এর কয়েক দশক পরও আমার বেলজিয়াম বংশোদ্ভূত মা (যিনি কিনা শিশুবেলায় মা-বাবার সঙ্গে জার্মান দখলদার বাহিনীর ভয়ে ব্রাসেলস ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন) জার্মান বাহিনীর খাকি পোশাক দেখে আঁতকে উঠতেন।
এ রকম শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলোও অবশেষে তাদের খনিজ কয়লা ও ইস্পাত উৎপাদন এমনভাবে করতে রাজি হয়েছে, যা ভবিষ্যতে তাদের একে অন্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণে বাধা দিতে পারে।
ফ্রান্সের রবার্ত শুমান ও জ্যঁ মোনে; পশ্চিম জার্মানির কনরাড আদেনাউ এবং ইতালির আলসিদে দো গাসপেরির মতো কয়েকজন হাতে গোনা মহান নেতা ইউরোপের এই নতুন ভবিষ্যতের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ, পরাশক্তিগুলোর রশি–টানাটানি, গোপন কূটনীতি ও প্রতিনিয়ত জাতীয় ভৌগোলিক সীমা পরিবর্তন করা নিয়ে চরম বিভক্তি যে মহাদেশটিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, সেখানে এই চুক্তি একটি নতুন ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতা তৈরি করে দেয়।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রথমে ইউরোপের এই রাষ্ট্রগুলো একটি সম্প্রদায় বা কমিউনিটি গঠনে রাজি স্বীকৃত হয়েছিল। পরে তারা সেই কমিউনিটিকে ইউনিয়নে রূপ দেয়। এর আওতায় প্রতিটি দেশ নিজেদের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা বজায় রেখে একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে সম্মত হয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের এই গল্প আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে খুবই পরিচিত। কিন্তু এটি এমন এক গল্প, যা বারবার ইউরোপের ঐতিহাসিক বিভক্তি ও ঐক্যের ঘটনা মনে করিয়ে দেয়।
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও হামাসের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আবার সেই গল্প প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কারণ, গাজার যুদ্ধের কারণে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের আলাপটি উঠে এসেছে।
দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের তত্ত্ব অনুযায়ী, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে শান্তিপূর্ণভাবে পাশাপাশি সহাবস্থান করবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে বলেছেন, ইসরায়েলের ওপর হামাসের হামলা করার ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে শেষ হওয়ার পর দীর্ঘ মেয়াদে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথে অগ্রসর হতে হবে।
বাইডেন মনে করেন, ইসরায়েলের রাষ্ট্র গঠনের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে ফিলিস্তিনি জনগণকে দীর্ঘমেয়াদি শান্তির পথে হাঁটতে হবে। এ স্বীকৃতির মধ্য দিয়েই ফিলিস্তিনিরা তাদের নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারবে।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, ১৯৯০–এর দশকের গোড়ার দিকে যে ওসলো চুক্তি হয়েছিল, তা আজও কার্যকর হতে পারেনি। আলাদা দুই রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হয়নি। জনসংখ্যাগত ও ভৌগোলিক সীমারেখাগত জটিলতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
ইসরায়েলে বসবাসরত আরবদের সংখ্যা এক দিকে যেমন বাড়ছে, অন্যদিকে পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হচ্ছে, যা ফিলিস্তিনের আলাদা রাষ্ট্র হওয়ার পথে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ কারণে দুই ভূখণ্ডের মধ্যে বাসিন্দাদের অদলবদল (অর্থাৎ ইসরায়েলে থাকা আরবদের ফিলিস্তিনে নেওয়া এবং ফিলিস্তিনে থাকা ইহুদিদের ইসরায়েলে ফিরিয়ে নেওয়া) দিনকে দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে।
এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের সমর্থকদের আরও সৃজনশীল হতে হয়েছে। ২০১৫ সালে তৎকালীন ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট রিউভেন রিভলিন একটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেই বিকল্প হলো, একধরনের কনফেডারেশন প্রতিষ্ঠা করা, যা প্রস্তাবিত দুটি রাষ্ট্রকে সমগ্র আরব ভূখণ্ডের যৌথ সিদ্ধান্তের কাছাকাছি নিয়ে আসবে।
একইভাবে ইসরায়েলি মানবাধিকার আইনজীবী মে পুন্ডাক ‘দ্বিরাষ্ট্র সমাধান ২.০’ শীর্ষক একটি মডেলের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মডেল অনুসরণ করে একটি দ্বিরাষ্ট্রীয় কনফেডারেশন করা সম্ভব, যা দুটো রাষ্ট্রের স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করবে।
এখন কথা হলো, গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলা এবং তার জেরে গাজায় ইসরায়েলের চালানো হামলার (যাতে ইতিমধ্যেই ১৩ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন) পর এই দুটি পক্ষকে সংলাপের টেবিলে বসানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় অভিজ্ঞতা থেকে তিনটি বিষয়ে জোর দেওয়া যেতে পারে।
প্রথমত, সব ধরনের গোলাগুলি বন্ধ করতে হবে এবং দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তনে বিবদমান উভয় পক্ষকে রাজি করতে পর্যাপ্ত ব্যয় করতে হবে। বর্তমান সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে সব ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলির স্থায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র ও একাধিক আরব দেশকে তাদের সামরিক বাহিনী একযোগে সরিয়ে নিতে হবে। উভয় ভূখণ্ডের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পর একটি নতুন ভবিষ্যৎ কল্পনা করা যেতে পারে। ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হলেই চলমান সহিংসতা কাটিয়ে সামনে এগোনোর কথা ভাবার সুযোগ পাওয়া যাবে।
দ্বিতীয়ত, শুরুটা ছোট দিয়েই করতে হবে। অর্থাৎ সংলাপের শুরুতেই দুই রাষ্ট্র গঠন এবং সমস্যার দীর্ঘ তালিকা তুলে ধরে তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করার বিষয় উত্থাপন করা যাবে না। বরং ইউরোপিয়ান কোল অ্যান্ড স্টিল কমিউনিটির আদলে কোনো একটি প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করাতে হবে, যেখানে বিবদমান পক্ষগুলোকে এক জায়গায় আনা যায়।
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সবচেয়ে বেশি অংশীদারভিত্তিক সম্পদ সম্ভবত পানি। যৌথ ব্যবস্থাপনায় যদি পানি সংরক্ষণ, সাগরের পানিকে লবণমুক্তকরণ এবং পানির সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়, তাহলে পানিকে হাতিয়ার বানানো উভয় পক্ষের জন্য কঠিন হবে।
আরেকটি সম্ভাবনা হলো যৌথভাবে সাধারণ জ্বালানিসহ সবুজ জ্বালানির উৎপাদন। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন যৌথভাবে জ্বালানি উৎপাদন করতে পারলে বাণিজ্যিক ও পরিবেশগত সুবিধা পাওয়া যাবে এবং ইসরায়েলি সরবরাহের ওপর ফিলিস্তিনিদের জ্বালানিনির্ভরতা হ্রাস পাবে।
তৃতীয়ত, সমমনা তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে সম্পৃক্ততা গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে হলে এখানে অবশ্যই মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল গড়তে হবে। ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ের বীজ হিসেবে কাজ করেছিল বেনেলাক্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস ও লুক্সেমবার্গের মধ্যকার একটি কাস্টমস ইউনিয়ন। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনকে অন্তর্ভুক্ত করে জর্ডান, মিসর, সৌদি আরবসহ আরও কয়েকটি দেশ মিলে এ ধরনের একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত
অ্যান মারি স্লটার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতি পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক পরিচালক