ভারতের নির্বাচন কেন বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ

নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনী প্রচারণা সভায় তাঁর ছবি হাতে বিজেপির একজন সমর্থক। বেঙ্গালুরে।ছবি: রয়টার্স

নির্বাচনের জন্য প্রার্থীদের টাকাপয়সা খরচ করার বিষয়টি ভারতীয় উপমহাদেশের একটি পুরোনো রেওয়াজ। এ কারণে একটু অবস্থাপন্ন রাজনীতিকেরাই নির্বাচনে দাঁড়ান—বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানে সাধারণভাবে এটাই দেখা যায়।

টাকাপয়সা কম থাকা সত্ত্বেও কেউ যদি মনোনয়ন পেয়ে যান, কোনো না কোনোভাবে তিনি সেটা ম্যানেজ করে ফেলেন—হয় দল থেকে অনুদান পান অথবা শুভানুধ্যায়ীরা সাহায্য করেন। আর কেউ যদি মন্ত্রী থাকেন বা এ রকম কোনো বড় দায়িত্ব পালন করেন, নির্বাচনে তাদের টাকাপয়সার সমস্যা হওয়ার কথাই না।

সম্প্রতি ভারতে একটি উল্টো ঘটনার খবর অনেকের নজরে এসেছে। পর্যাপ্ত টাকাপয়সা না থাকার কথা বলে লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ। (নির্মলা সীতারমণ সেস শি ডাজ নট হ্যাভ মানি টু কনটেস্ট লোকসভা ইলেকশন, ডিক্লাইনস বিজেপি টিকিট, হিন্দুস্তান টাইমস, ২৮ মার্চ ২০২৪)

ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির অর্থমন্ত্রীরই নির্বাচনের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ নেই! ভুলে গেলে চলবে না, নির্মলা সীতারমণ এর আগে বিজেপি সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন। পরপর দুই মেয়াদে এ রকম দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা একজন মন্ত্রীর নির্বাচনের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ নেই—এমন খবরের তাৎপর্য কী?

টাকাপয়সা না থাকা নিয়ে নির্মলা সীতারমণের বক্তব্যে এমনটা মনে হওয়া স্বাভাবিক, তিনি একজন সৎ রাজনীতিক এবং তাঁর দল এত ‘গরিব’ যে তাঁকে অর্থ সাহায্য করতে পারছে না। পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত না থাকায় ব্যক্তি ও রাজনীতিক হিসেবে নির্মলার সততা-অসততা নিয়ে কিছু বলার সুযোগ নেই। কিন্তু তাঁর দল বিজেপি যে ‘গরিব’ নয়, সেটা  নিশ্চিত করেই বলা যায়।

টাকাপয়সার অভাবে নির্মলা যেদিন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার বিষয়টি বলেন, তার বেশ কয়েক দিন আগেই ইলেকটোরাল বন্ড থেকে বিজেপির তহবিলে ছয় হাজার কোটি রুপিরও বেশি জমা হওয়ার কথা জানা গেছে। (বিজেপি রিসিপেন্ট নাম্বার ওয়ান, ইটস টপ টেন ডোনার্স ফ্রম থার্টি ফাইভ পারসেন্ট অব ইটস রুপি সিক্স থাউজেন্ড ক্রোর ইলেকটোরাল বন্ড কিট্টি, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২২ মার্চ ২০২৪)

ইলেকটোরাল বন্ড নিয়ে পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। বিজেপি সরকারের করা অভিনব এই নিয়ম এরই মধ্যে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছেন। ইলেকটোরাল বন্ডের মাধ্যমে কোন ব্যবসায়ী গ্রুপ কোন দলকে কত টাকা দিয়েছে, ভারতের রাষ্ট্রীয় ব্যাংক সেটা প্রকাশ করতে গড়িমসি করছিল। তবে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার পর তারা সেটা প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। এতেই বিজেপির থলের বিড়াল বের হয়ে আসে।

এটা মোটামুটি স্পষ্ট, ভারতে গত কয়েক বছরে অর্থাৎ মোদি-জমানায় রাষ্ট্র ও করপোরেট কোম্পানিগুলোর সুসম্পর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে। রাষ্ট্র ও করপোরেট কোম্পানির এই সম্পর্ক কী ইঙ্গিত দেয়? এ ক্ষেত্রে ইতালির স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনির সেই বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করতে হবে। তিনি বলেছিলেন, করপোরেশনের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিয়েই হলো ফ্যাসিজম (দ্য ডেফিনেশন অব ফ্যাসিজম ইজ দ্য ম্যারেজ অব করপোরেশন অ্যান্ড স্টেট)।

ইলেকটোরাল বন্ড আসলে কী তা নিয়ে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলারই স্বামী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও লেখক পরকলা প্রভাকর। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী বন্ড শুধু ভারতের নয়, সারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুর্নীতি।’ (‘নির্বাচনী বন্ড পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুর্নীতি’, বললেন অর্থমন্ত্রী নির্মলার স্বামী, আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন, ২৭ মার্চ ২০২৪)

পরকলা যেহেতু স্বয়ং অর্থমন্ত্রীর স্বামী, তাঁর এসব কথা বিজেপির জন্য অস্বস্তিকর। লক্ষণীয়  হলো, ভারতে যারা বিজেপিকে ভোট দেন বা সমর্থন করেন, তাঁরা অনেকেই এই দলকে ‘দুর্নীতিমুক্ত’ বলে দাবি করেন। কয়েক বছর ধরে নীতিনির্ধারকেরাও বিভিন্নভাবে দলটির সে রকম একটি ইমেজ তৈরি বা ন্যারেটিভ দাঁড় করার চেষ্টা করেছেন। প্রায় নিয়মিত তাঁরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। দুর্নীতির অভিযোগে বহু গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হয়েছেন।

অপর দিকে বিরোধীদের দাবি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে এসব হাঁকডাক আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাঁরা বরং উল্টো সরকারের বিরুদ্ধেই পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন। বিরোধী দল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা রাহুল গান্ধী ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’। ইলেকটোরাল বন্ড–কাণ্ডের পর রাহুলের সেই কথা কি কিছুটা হলেও সত্যি প্রমাণ হলো?

ভারতের দুই বড় ব্যবসায়ী আদানি ও আম্বানির সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির সখ্যের বিষয়টি বহুল চর্চিত। কিন্তু ইলেকটোরাল বন্ডের মাধ্যমে অন্য করপোরেট কোম্পানিগুলো যে পরিমাণ অর্থ ভারতের ক্ষমতাসীন দলকে দিয়েছে, সেটির পরিমাণ সত্যিই বিস্ময়কর। এই অর্থ কিন্তু নিঃস্বার্থভাবে দেওয়া হয়নি। এর বিনিময়ে তাঁরা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন এবং ভবিষ্যতে আরও পাবেন বলে প্রত্যাশা করছেন।

এটা মোটামুটি স্পষ্ট, ভারতে গত কয়েক বছরে অর্থাৎ মোদি-জমানায় রাষ্ট্র ও করপোরেট কোম্পানিগুলোর সুসম্পর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে। রাষ্ট্র ও করপোরেট কোম্পানির এই সম্পর্ক কী ইঙ্গিত দেয়?

আরও পড়ুন

এ ক্ষেত্রে ইতালির স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনির সেই বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করতে হবে। তিনি বলেছিলেন, করপোরেশনের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিয়েই হলো ফ্যাসিজম (দ্য ডেফিনেশন অব ফ্যাসিজম ইজ দ্য ম্যারেজ অব করপোরেশন অ্যান্ড স্টেট)।

ভারতের ভবিষ্যৎ গতিমুখ বুঝতে হলে আবারও ফিরতে হবে পরকলা প্রভাকরের কাছে। অল্প কয়েক দিন আগে তিনি ভারতের বিশিষ্ট সাংবাদিক করণ থাপারকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেখানে তিনি তাঁর দেশের নির্বাচন ও ভোটাধিকার নিয়ে আশঙ্কার কথা জানান। (নো ফিউচার ইলেকশনস ইন ইন্ডিয়া ইফ পিএম মোদি রিইলেকটেড: পরকলা প্রভাকর, দ্য হিন্দু, ৯ এপ্রিল ২০২৪)

এই সাক্ষাৎকারে সংবিধান ও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়েও  কিছু মন্তব্য করেন পরকলা প্রভাকর। তিনি বলেন, ‘এমনটা হতে পারে, যদি এই সরকার ফের ক্ষমতায় আসে, তবে আর কোনো নির্বাচন হবে না দেশে। ভোটাধিকার প্রয়োগ করার আশা করবেন না আর। এরপর আর কোনো ভোটই হবে না ভারতে। দেশের সংবিধান এবং নকশা পুরোপুরি বদলে যাবে। চিনতেও পারবেন না। লাল কেল্লা থেকে হিংসার কথা শোনা যাবে। ভয়ংকর হতে চলেছে দেশের ভবিষ্যৎ। যা আজ মণিপুরে হচ্ছে, তা আগামী দিনে দেশের যেকোনো স্থানে হতে পারে। কৃষকদের সঙ্গে যা হচ্ছে, লাদাখের মানুষের ওপর যা চলছে, তা গোটা দেশে হতে পারে।’ (‘লাল কেল্লা থেকে হেট স্পিচ! বন্ধ হবে নির্বাচন’, সীতারমনের স্বামীর ভবিষ্যদ্বাণীতে অস্বস্তিতে বিজেপি, এই সময়, ৮ এপ্রিল ২০২৪)

পরকলা প্রভাকর যা বলেছেন, তা শুধু ভারতের জন্য নয়, বাংলাদেশের জন্যও আশঙ্কার বিষয়। ভারতের রাজনীতি, নির্বাচন বা গণতন্ত্র নিয়ে কেন আমাদের এই আশঙ্কা? এর কারণ হলো, ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। দেশটির সঙ্গে আমাদের বহুমাত্রিক সম্পর্ক রয়েছে। কোনো কারণে ভারতে যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আরও অবনমন হয়, তাহলে বাংলাদেশেও নিশ্চিতভাবে সেটার প্রভাব পড়বে। এর ফলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে যে সংকট চলছে তা আরও বাড়তে ও দীর্ঘায়িত হতে পারে। একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য তাই প্রতিবেশী হিসেবে গণতান্ত্রিক ভারতের কোন বিকল্প নাই।

  • মনজুরুল ইসলাম  প্রথম আলোর জেষ্ঠ্য সহসম্পাদক