গুম হয়ে যাওয়া কবিগুরু ও ছাত্রলীগের নির্যাতন কেন্দ্র

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা ও ছাত্রলীগের এই নির্যাতক রূপ ধারণ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত
ছবি : প্রথম আলো

দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেন এখন ছাত্রলীগের নির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ছাত্রলীগের কর্মীরা যখন যাকে খুশি ডেকে নিয়ে আটকে নির্যাতন করছেন। নির্মমভাবে মারধর করা, বিবস্ত্র করা, এমনকি অপহরণ করে চাঁদা আদায়—কোনো কিছুই আর বাদ রাখছে না ছাত্রলীগ। যতই দিন যাচ্ছে, ছাত্রলীগ ততই ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। বিস্ময়করভাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরাও তাদের সহগামী হচ্ছেন। এই যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রাতের আঁধারে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি প্রতিবাদী ভাস্কর্য সরিয়ে দিয়েছিল। শিক্ষার্থীরা সেখানে ‘গুম হয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ’– লেখা ব্যানার ঝুলিয়ে দেন।

প্রথমে অনেকের মতো আমিও ধারণা করেছিলাম এটা ছাত্রলীগের কাজ হতে পারে। ওমা, একি কাণ্ড! নির্বাক হয়ে আমরা দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রাব্বানী নিজেই এ দায়িত্বে কাঁধে নিয়েছেন। তিনি স্বীকার করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রবি ঠাকুরের ভাস্কর্য সরিয়েছে। ভাস্কর্য সরানো ঠিক হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেছেন। কবিগুরুর ভাস্কর্য স্থাপনে কেউ প্রতিবাদ করেছে বলে শুনিনি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উপযাচক হয়েই কাজটি করেছে। একটি ভাস্কর্যের পাশে আরেকটি ভাস্কর্য থাকতে পারে না বলে যুক্তি উপস্থাপন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর যখন এ ধরনের কথা বলেন, তখন ছাত্রলীগের আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হয়। বুক ফুলিয়ে নানা অপকর্ম করতে তারা উৎসাহিত বোধ করতে পারে। যেমন আমরা দেখেছি নির্যাতন করার পরও হুমকি দিয়ে যেতে থাকে। যেমনটা তারা করেছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুই ক্যাম্পাসে নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি; নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীকে আবারও দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেলে দুই শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে চিকিৎসাও নিতে দেয়নি। নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা উদ্ধারের আকুতি জানানোর পর কলেজ অধ্যক্ষ ও পুলিশ উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়েছে। তাঁরা সবাই দিনভর জানতেন, চারজনকে আটকে রেখে মারধর করা হচ্ছে; কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন দুই শিক্ষার্থীকে পুনরায় হুমকি দিয়েছেন ছাত্রলীগের ক্যাডাররা টুঁ শব্দটি না করার জন্য। করলে মর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা ও ছাত্রলীগের এই নির্যাতক রূপ ধারণ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। উল্লেখ্য,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের পাশে রবি ঠাকুরের একটি ভাস্কর্য স্থাপন করেছিলেন। বিশ্বকবির মুখ বন্ধ ও হাতে রাখা পুস্তকে একটি পেরেক গাঁথা ছিল। অমর একুশে বইমেলায় বেশ কয়েকটি বই বিক্রিতে বাধা দেওয়া, নানাভাবে মতপ্রকাশের পথ আটকে দেওয়া, প্রচলিত পদ্ধতিতে একসঙ্গে অনেক মানুষের প্রতিবাদের পথ বন্ধ করার প্রতিবাদেই রবি ঠাকুরের ভাস্কর্যটি অস্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয়েছিল।

ওদিকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করেছেন ছাত্রলীগের নারী নেত্রীরা। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে ফিরতে আর নিরাপদ বোধ করছেন না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষার্থীকে হল থেকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন ছাত্রলীগের ক্যাডাররা।  

ছাত্রলীগের এ ধরনের নির্মমতা দেশের সব ক্যাম্পাসেই আছে। এদের ভয়ে অনেক শিক্ষার্থী হলে থাকতে চান না। কিছুদিন আগে দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগরের কয়েক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়টি অবশ্য আবাসিক চরিত্র হারিয়েছে অনেক আগেই। এখন নামেই আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচয় দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের বেশ কয়েকজন জানান, ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী গ্রামে এখন বাসা ভাড়ার রমরমা ব্যবসা চলছে। কারণ, হিসেবে জানালেন, অনেক শিক্ষার্থীই গণরুম ও রাজনৈতিক ঝামেলা এড়াতে পাশের গ্রামে কয়েকজন মিলে বাসা ভাড়া করে থাকেন। গণরুমে গাদাগাদি করে থাকার চেয়েও ভয়াবহ গণরুম সংস্কৃতি শিক্ষার্থীদের জন্য ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। রাতবিরাতে রাজনৈতিক নেতারা গণরুমে এসে ক্যাম্পাসের আদব শেখানোর নামে মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার করেন।

বুধবার রাতে সেটি উধাও হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কর্যটি । পরে শুক্রবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ভাস্কর্যটির ভাঙা মাথা উদ্ধার করা হয়।
ছবি: সংগৃহীত

শুধু জাহাঙ্গীরনগরই নয়, গণরুম বা গেস্টরুমের আদব শেখানোর ভয়াবহ ও আতঙ্কজনক সংস্কৃতি দেশের সব ক্যাম্পাসেই আছে। হলের প্রভোস্ট ও দায়িত্বরত শিক্ষকেরা এসব জানেনও। কিন্তু তাঁরাও যেহেতু দলীয় কোটায় হলের দায়িত্ব পালন করেন, তাই এসব অত্যাচার-নির্যাতন নিয়ে মাথা ঘামান না। চুপচাপ থাকেন বা ঢাবির প্রক্টরের মতো আশকারামূলক বক্তব্য দেন। আর তখনই ছাত্রলীগের কর্মীরা আরও ভয়ংকর রূপ নিয়ে আবির্ভূত হন। ছাত্রলীগের অপকর্ম থেকে আয়ের ভাগও নাকি কেউ কেউ আজকাল পান। যে কারণে দুষ্টের দমন নয়, পালনই করেন তাঁরা। অপরাধকে উসকে দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা ও ছাত্রলীগের এই নির্যাতক রূপ ধারণ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। উল্লেখ্য,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের পাশে রবি ঠাকুরের একটি ভাস্কর্য স্থাপন করেছিলেন। বিশ্বকবির মুখ বন্ধ ও হাতে রাখা পুস্তকে একটি পেরেক গাঁথা ছিল। অমর একুশে বইমেলায় বেশ কয়েকটি বই বিক্রিতে বাধা দেওয়া, নানাভাবে মতপ্রকাশের পথ আটকে দেওয়া, প্রচলিত পদ্ধতিতে একসঙ্গে অনেক মানুষের প্রতিবাদের পথ বন্ধ করার প্রতিবাদেই রবি ঠাকুরের ভাস্কর্যটি অস্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এতটাই অসহিষ্ণু যে প্রতিবাদের ন্যূনতম এ পথও তারা খোলা রাখতে ভয় পাচ্ছে। তাদের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রবল ক্ষোভ সম্পর্কে জ্ঞাত। এ কারণেই যেকোনো প্রতিবাদের ভাষাকেই আজকাল ভয় পাচ্ছে। আতঙ্কের কারণে শেষ পর্যন্ত রাতের আঁধারেই রবি ঠাকুরের ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেয়। পরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাস্কর্যটির মাথাটি পাওয়া যায়।

এ কারণে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষকদের একধরনের তত্ত্বাবধান ও আশকারায় ছাত্রলীগ মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়। ক্যাম্পাসগুলোকে একেকটি নির্যাতনকেন্দ্র পরিণত করেছে। হলগুলো হচ্ছে এক একটি নির্যাতন সেলের মতো। কাঠের ডান্ডা দিয়ে বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরারের পায়ের তালু ও হাঁটুতে মেরেছিল। চট্টগ্রাম মেডিকেলে মুখে পানি ঢেলে শিবির করার স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করেছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর গায়ে পিন ফুটিয়ে দিয়েছে।

শেষ পর্যন্ত দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কতৃপক্ষও এ ধরনের ধরনের কাজে জড়িয়ে পড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের হতা থেকে কবিগুরুর ভাস্কর্যেরও নিস্তার মেলেনি। তাঁর ‘গুম হয়ে যাওয়া’ ভাস্কর্যের খণ্ডিত মাথাটি এখন পড়ে থাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।

  • ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক