বদরুদ্দীন উমর যেভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন

বদরুদ্দীন উমর লেখক-গবেষক–তাত্ত্বিক ও বামপন্থী রাজনীতিক। ৯৪ বছর বয়সে ঢাকার একটি হাসপাতালে গত রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) তিনি মারা গেছেন। লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বদরুদ্দীন উমরের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকার সংকলিত হয়েছে প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হওয়া বামপন্থার সুরতহাল বইয়ে। এখানে উঠে এসেছে তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতার কথা। একই সঙ্গে তিনি দিয়েছেন বাম রাজনীতির একটি সুরতহাল রিপোর্ট। সেখান থেকে চুম্বক অংশ প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।

কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আমার যোগাযোগ একদম ছেলেবেলা থেকেই। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে আমাদের পরিবার ছিল বৃহত্তর একটি পরিবার। সেখানে রাজনীতি করার মতো লোক অনেকেই ছিলেন। রাজনৈতিক নেতা ছিলেন—একেবারে জেলা পর্যায়ে, প্রাদেশিক পর্যায়ে, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে। সেখানে কংগ্রেস ছিল, মুসলিম লীগ ছিল, কমিউনিস্ট পার্টির লোক ছিল। শুধু হিন্দু মহাসভা ছিল না।

বর্ধমান জেলা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আমার ফুফাতো ভাই সৈয়দ শাহেদুল্লাহ। তাঁর ভাই ও আমার আরেক ফুফাতো ভাই মনসুর হবিবুল্লাহ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন বর্ধমানে কমিউনিস্ট পার্টির খুব ভালো সংগঠন ছিল। ২নং পার্কাস রোডের যে বাড়িতে আমরা থাকতাম, তা আমার দাদির বাড়ি ছিল। সেখানেই জন্মেছিলাম এবং বড় হয়েছি। আমরা একসঙ্গে থাকতাম। পরে আশপাশে অন্য বাড়িতে থেকেছি। কিন্তু ২নং পার্কাস রোডের ওই বাড়িটিই ছিল কমিউনিস্ট অ্যাকটিভিটির হাব (মূল কেন্দ্র)।

আমাদের পরিবার ছিল রাজনৈতিক পরিবার। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কখনো ছিলাম না। আমি কখনো ছাত্ররাজনীতিও করিনি। আমার সমবয়সী বা দু-এক বছরের বড়-ছোটরা ছাত্র ফেডারেশন করত। আমি ছাত্র ফেডারেশন করতাম না। মিটিং-মিছিলে যেতাম, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো সংগঠনের সঙ্গে ছিলাম না।

আরও পড়ুন

আমার আব্বা মুসলিম লীগ করতেন, কিন্তু আমি কোনো দিন ছাত্রলীগের ধারেকাছে যাইনি। তিনি আমাকে কোনো দিন ছাত্রলীগ করার কথা বলেননি। ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গেই সম্পৃক্ত ছিলাম। আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও তাদের সঙ্গেই ঘোরাফেরা করতাম। কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে যে ক্লাসগুলো হতো, সেগুলোতে যেতাম। সেখানে ক্লাস নিতেন শাহেদুল্লাহ সাহেব, বিনয় চৌধুরী, হরেকৃষ্ণ কোঙার, যাঁরা পরে প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় নেতা হয়েছিলেন। আব্বা কখনো এসবে আমাকে নিষেধ করেননি। আমাদের পরিবারে দারুণ একটা পরিবেশ ছিল।

জেলাপর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টির যত বড় বড় নেতা-কর্মী ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে আমার নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ হতো। কলকাতায় ছেলেবেলায় আরও বড় সব কমিউনিস্ট নেতাকে দেখেছি। সম্মেলনে গিয়েছি, সেখানেও দেখেছি। কাজেই কমিউনিস্ট পার্টি আমার কাছে অপরিচিত ছিল না।

আমি রাজনীতি না করলেও রাজনীতিসচেতন ছিলাম। বাড়িতে আমরা নিয়মিত খবরের কাগজ পড়তাম। আমার মনে আছে, ছোটবেলায় একবার শিক্ষক ক্লাসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় এখন কী হচ্ছে? কেউ কিছু না বলতে পারলেও আমি বলতে পারলাম। কারণ, আমরা তখন খবরের কাগজ পড়তাম।

আমার ৮০-৮৫ বছর বয়স্ক দাদি, যিনি চোখে দেখতে পেতেন না, তিনিও খবরের কাগজের জ্ঞান রাখতেন, তাঁকে পড়ে শোনাতে হতো। প্রতিদিন কেউ না কেউ তাঁকে খবরের কাগজ পড়ে শোনাত। কাজেই একটা অন্য রকম আবহ আমাদের পরিবারে ছিল। কিন্তু আমি নিজে কোনো দিন আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ছাত্রসংগঠন বা দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না।

আমি যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম, তখন অক্সফোর্ড গিয়েছি। অক্সফোর্ডে থাকা অবস্থাতেই নেপাল নাগের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এটা ১৯৬০ সালের কথা। সে সময় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিভক্তির সূচনা ঘটতে যাচ্ছিল।

১৯৬০ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি হিসেবে নেপাল নাগ অংশগ্রহণ করেছিলেন। এখানকার কমিউনিস্ট পার্টি তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে দুই ভাগে (মস্কোপন্থী ও পিকিংপন্থী) বিভক্ত হয়নি। নেপাল নাগ প্রথমে মস্কো, তারপর মস্কো থেকে লন্ডন গিয়েছিলেন ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে।

তসদ্দুক আহমদ বলে একজন লোক ছিলেন, তিনি অনেক যোগাযোগ করতেন। খুব উদার লোক ছিলেন, আতিথেয়তা ছিল খুব। তাঁর বাসাতেই প্রথম যোগাযোগ হলো। সে সময় লন্ডনে ছিলেন জহুর হোসেন চৌধুরী ও সালাউদ্দিন আহমদ। জহুর ভাইয়ের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির খুব যোগাযোগ ছিল।

এখানকার কমিউনিস্ট পার্টির লোক হিসেবে প্রথমে যোগাযোগ হয় নেপাল নাগের সঙ্গে, লন্ডনে। তাঁর সঙ্গে কয়েক দফা, তিনবারের মতো কথা হয়েছিল। তিনি আমাকে তখন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হতে বললেন। তিনি বললেন, ‘আমি বলে রাখব। আপনি দেশে ফিরলেই আপনার সঙ্গে আলাপ করে সদস্যপদ দেব।’

সে সময় লন্ডনেই সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির একটা আলোচনা হচ্ছিল, প্রশিক্ষণ হচ্ছিল। তিনি আমাকে সেখানে যাওয়ার কথা বললেন। কিন্তু সেখানে মাহবুবউল্লাহ্ নামে আমার এক ফুফাতো ভাই থাকতেন। তিনি ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘খবরদার, ওখানে যেয়ো না। ওখানে প্রতি তিনজনে একজন ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার লোক।’ পরে সেখানে আর যাইনি।

অক্সফোর্ড থেকে এসে আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি। তখন জহুর ভাইয়ের মাধ্যমে এখানে খোকা রায়ের সঙ্গে প্রথম দেখা হলো। নেপাল নাগ বোধ হয় খোকা রায়কেও জানিয়েছিলেন কিছু। খোকা রায়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার বিষয়টা খুবই অস্বস্তিকর ছিল। এই লোক এখানকার কমিউনিস্ট পার্টির সবচেয়ে বড় নেতাদের একজন, জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর কথাবার্তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা দেখলাম। আমার সঙ্গে যে কথা বললেন, তাতে তাঁর খুব একটা আগ্রহ আছে বলে মনে হয়নি। তাঁর সঙ্গে এক-দুবার দেখা হয়েছে।

তারপর তাঁকে বলেছি, ‘দেখেন, আমি এখন কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিতে পারি না। কারণ, আমি মনে করি, এখন কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলে ঠিকভাবে কাজ করার মতো লোক হিসেবে যোগ দিতে হবে। কাজেই পার্টির মেম্বার হলাম, কিন্তু কাজ করলাম না, এ অবস্থায় আমি যেতে পারব না।’

তারপর খোকা রায়ের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ থাকেনি। খোকা রায়কে বলেছিলাম, আমি পার্টিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেব না। কিন্তু বাইরে থেকে কিছু কাজ থাকলে তা করে দিতে পারব। কিন্তু খোকা রায় শুরু থেকেই আমার প্রতি একটা বিদ্বেষমূলক মনোভাব প্রকাশ করলেন। পরে তিনি আর যোগাযোগ করেননি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীনই আমার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে একটা যোগাযোগ হলো। নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও তাঁদের ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নসহ অন্য যে লোকেরা তাঁদের সঙ্গে ছিলেন, তাঁদের সঙ্গেই আমার যোগাযোগ ছিল। তোয়াহা সাহেব তো আব্বার শিষ্য ছিলেন,আসা-যাওয়া করতেন। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির লোক হিসেবে তোয়াহা সাহেবের সঙ্গে আমার তেমন পরিচয় ছিল না।

আমাকে একদিন রউফ নামের একজন এসে বললেন, সুখেন্দু দস্তিদার আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। রউফের বাড়ি ছিল খুলনায়। ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগাররা তাঁকে মেরে ফেলে। তখন আমি প্রথম কোনো পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে সুখেন্দু দস্তিদারের সঙ্গে দেখা করি। তোয়াহার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, কিন্তু পার্টির বিষয়ে তাঁর সঙ্গে সেভাবে কোনো কথাবার্তা হয়নি।

আবদুল হককে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। পিকিংপন্থী কাউকে চিনতাম না। মস্কোপন্থী লোকজন, রণেশ দাশগুপ্তের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। অনেক সাংস্কৃতিক এলাকায় রণেশ দাশগুপ্ত কাজ করতেন। পরের দিকে, ১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে এসে প্রথমবারের মতো প্রো-পিকিং ছাত্রসংগঠনের সম্মেলনে যাই। তার আগে মস্কোপন্থীদের ছাত্রসংগঠনে যেতাম। তারা ১৯৬৮ সালে গোর্কি শতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান করেছিল, সেখানে গিয়েছিলাম।

রাজশাহী ফিরে এসে উপাচার্য শামসুল হক সাহেব আমাকে ডেকে এসব বললেন। তিনি বললেন, ‘আমি আর পারছি না। কী করা যায়?’

আমি তাঁকে বললাম, ‘আপনাকে আর কিছু করতে হবে না।’ কারণ, এ পরিস্থিতির শুরুতেই যখন চাপাচাপি শুরু হলো, তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনাকে ভারতের এজেন্ট বলা হচ্ছে। আপনি ভারতের বিরুদ্ধে কিছু লিখেছেন?’

আমি বললাম, ‘না। ভারতের বিরুদ্ধে হঠাৎ লিখতে যাব কেন?’ তারপর তিনি বললেন, ‘ভারতের বিরুদ্ধে কিছু লিখতে পারেন না?’ আমি বললাম, ‘শুধু শুধু ভারতের বিরুদ্ধে লিখতে যাব কেন?’

পরে তো ভারতের বিরুদ্ধে অনেক লিখেছি। যা-ই হোক, মিটিংয়ের বিষয় জানার পর বাড়ি ফিরে গিয়ে চিন্তাভাবনা করলাম। দু-এক দিন পর গিয়ে তাঁর কাছে দুই বাক্যের একটা পদত্যাগপত্র জমা দিলাম। তারপর ঢাকা চলে এলাম।

কমিউনিস্ট পার্টির পিকিংপন্থী কোনো নেতার সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল না। ঢাকায় তখন কয়েকটা পার্টি হয়েছে। একটা ছিল মণি সিংহের, একটা সুখেন্দু দস্তিদারদের পার্টি; আবার ওদিকে দেবেন শিকদারদের পার্টি। আমি কোনটায় যাব! একটাতে তো যেতেই হবে, তা না হলে রাজনীতি করব কীভাবে?

তখন মনে করেছিলাম, কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া কিছু করা যাবে না। সে জন্য অন্যদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে থাকলাম। মণি সিংহ আমার বাসায় এলেন দুবার, তাঁদের সংগঠনে যোগ দেওয়ার জন্য বললেন। তারপর দেবেন শিকদার, আলাউদ্দিনরা ছিলেন।

আমাকে একদিন রউফ নামের একজন এসে বললেন, সুখেন্দু দস্তিদার আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। রউফের বাড়ি ছিল খুলনায়। ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগাররা তাঁকে মেরে ফেলে। তখন আমি প্রথম কোনো পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে সুখেন্দু দস্তিদারের সঙ্গে দেখা করি। তোয়াহার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, কিন্তু পার্টির বিষয়ে তাঁর সঙ্গে সেভাবে কোনো কথাবার্তা হয়নি।

যা-ই হোক, খান আতাউর রহমানের বাড়িতে সুখেন্দু দস্তিদারের সঙ্গে দেখা হলো। সেখানে পার্টির আরেকজন ছিলেন। তিনি আমাকে পার্টিতে যোগ দিতে বললেন। ১৯৬৯ সালের মাঝামাঝির দিকের ঘটনা এটা।

এর আগে মণি সিংহ ও দেবেন শিকদারের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। দেবেন শিকদারের সঙ্গে চট্টগ্রামে একবার বিস্তারিত কথা হয়েছিল। এটি আমার বইয়ে লিখেছি। বিরক্তিকর একটা ব্যাপার। তাঁর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গেলেন আমাকে। রাতের বেলা কথাবার্তা হচ্ছে। তারপর সুখেন্দু দস্তিদারের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার জন্য মেম্বার হলাম।

এই হচ্ছে আমার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার ইতিহাস। তবে একটা কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে, সুখেন্দু দস্তিদারের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল খান আতাউর রহমানের বাড়িতে, শেষ দেখাও হয়েছিল খান আতাউর রহমানের বাড়িতেই।