সম্প্রতি ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদি হত্যার ঘটনাকে উপলক্ষ করে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট ও উদীচী ভবনে ব্যাপক হামলা এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া স্বল্প সময়ের মধ্যে একযোগে এ রকম হামলা করা সম্ভব নয়। ডানপন্থী উগ্রবাদীরা দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে হামলার উসকানি দিয়ে আসছিলেন। সাম্প্রতিক এ হামলার উসকানিদাতা হিসেবে বিদেশে অবস্থানরত কয়েকজন ইউটিউবারের পাশাপাশি দেশের ভেতরে যাঁদের ভূমিকার কথা আলোচিত হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের দুই নেতাও রয়েছেন।
১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ওই বিক্ষোভ মিছিল-পরবর্তী সমাবেশে দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার বন্ধ করতে হবে বলে ঘোষণা দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (রাকসু) সহসভাপতি (ভিপি) ও শাখা শিবিরের সভাপতি মোস্তাকুর রহমান। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘আমরা আজকের এই প্রোগ্রাম থেকে ঘোষণা দিচ্ছি, প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ এসব সুশীল সংবাদ পত্রিকাকে অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।’
একই দিন রাতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) শাখার সেক্রেটারি মোস্তাফিজুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে এক সমাবেশে বলেন, ‘রাজনৈতিক লড়াই করে বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব নয়। আমাদের লড়াই শুরু হবে শহীদ ওসমান হাদির ইনকিলাব মঞ্চের সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। আগামীকাল (শুক্রবার) বাম, শাহবাগি, ছায়ানট, উদীচীকে তছনছ করে দিতে হবে, তাহলেই বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জিত হবে।’
উল্লেখ্য, ১৮ ডিসেম্বর রাতেই ঢাকায় প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা ও লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর মধ্যরাতে হামলা হয় ধানমন্ডির ছায়ানট ভবনে। হামলাকারীরা ভবনের প্রতিটি তলা তছনছ করে; বিভিন্ন সামগ্রী নিচে জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দেয়। আর পরদিন ১৯ ডিসেম্বর রাতে ঢাকার তোপখানা রোডে সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি–সেক্রেটারি পর্যায়ের নেতারা এসব হামলার উসকানি দিলেও সংগঠনটি তাঁদের বক্তব্যকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বলে দাবি করেছে। শুধু তা–ই নয়, এসব হামলার দায় শিবিরের ওপর চাপানোকে ‘অপচেষ্টা’ বলে নিন্দা ও প্রতিবাদও জানিয়েছে।
ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে অনলাইনে ভোটাভুটি করে অধিকাংশ ব্যাচ প্রতিনিধি শিবির নিজেদের লোকজনকে নির্বাচিত করে। এই ব্যাচ প্রতিনিধিরাই পরবর্তী সময়ে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে, একপ্রকার ছায়া প্রশাসন হিসেবে হলে ফাংশন করে। এই ব্যাচ প্রতিনিধিরাই আবার ৫ তারিখের পরে ছাত্রলীগের নামের তালিকা তৈরির দায়িত্ব নেয়। স্বাভাবিকভাবেই তারা নিজেদের সাথি ভাইদের তালিকার বাইরে রাখে।’
এ বিষয়ে ২২ ডিসেম্বর দেওয়া এক বিবৃতিতে ছাত্রশিবির বলেছে, ‘সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ও রাকসু ভিপি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারির ব্যক্তিগত বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ছাত্রশিবিরের ওপর দায় চাপানোর অপচেষ্টা চালানো হয়। সংশ্লিষ্ট বক্তব্যগুলো ছিল সম্পূর্ণ তাঁদের ব্যক্তিগত। ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলেরা নিজ নিজ বক্তব্যের বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন এবং বক্তব্যের ক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃত “স্লিপ অব টাং”-এর বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।’
বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, ‘একটি স্বার্থান্বেষী মহল পরিকল্পিতভাবে দৈনিক ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর কার্যালয়ে সংঘটিত ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের দায় ছাত্রশিবিরের ওপর চাপিয়ে দিয়ে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার, ষড়যন্ত্র ও অপরাজনীতির তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’ প্রশ্ন হলো একটি ছাত্রসংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি–সেক্রেটারি পর্যায়ের নেতাদের আচরণের দায় যদি সংগঠন না নেয়, তাহলে সেই সংগঠনের জবাবদিহির কী উপায় হবে!
কোনো রাজনৈতিক সংগঠন যদি এভাবে দায়মুক্তি পেয়ে যায়, তাহলে তার নেতা-কর্মীদের যেকোনো ধরনের অপকর্মের দায় এড়িয়ে যেতে থাকবে। নেতা–কর্মীরা খুন করলেও বলবে ব্যক্তির দায়, চাঁদাবাজি করলেও বলবে ব্যক্তিগত ব্যাপার। অথচ ব্যক্তি নেতা–কর্মীরা মিলেই দল গঠিত হয়। ফলে সভাপতি–সেক্রেটারি পর্যায়ের নেতারা তো বটেই, এমনকি সাধারণ কর্মীদের বক্তব্য ও কর্মের দায় সংগঠনের ওপরেই বর্তায়।
এর মধ্যে সভাপতি–সেক্রেটারির দায় বেশি থাকে। কারণ, ব্যক্তিগতভাবে দলের আদর্শ ধারণ করে বলেই তাঁরা সভাপতি–সেক্রেটারি। কোনো বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য দল যদি তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে বুঝতে হবে, দল তাঁদের সেই আচরণকে দলের আদর্শবিরোধী মনে করছে না।
অবশ্য ক্ষমতাচর্চাকারী ছাত্রসংগঠনের দিক থেকে নেতা–কর্মীদের অপকর্মের দায় অস্বীকার করাটা নতুন কিছু নয়। বিগত সরকারের আমলে আমরা ছাত্রলীগকে এভাবে দায় এড়ানোর রাজনীতি করতে দেখেছি। ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, অপহরণ, নির্যাতনসহ নানা ধরনের অপকর্মে যুক্ত থাকলেও দলীয়ভাবে এর দায় অস্বীকার করা হয়েছে। যেমন ২০১৭ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মো. সাইফুর রহমান সোহাগ বলেছিলেন, ছাত্রলীগের কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় সংগঠন নেবে না। (নেতা-কর্মীদের অপকর্মের দায় নেবে না ছাত্রলীগ: সোহাগ, এনটিভি অনলাইন, ১৯ জানুয়ারি ২০১৭)
২০১৯ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেছিলেন, সন্ত্রাসী বা অপরাধীর কোনো সাংগঠনিক পরিচয় নেই। ছাত্রলীগের নীতি-আদর্শের বাইরে কোনো ব্যক্তির অপকর্মের দায় সংগঠন নেবে না। (ব্যক্তির অপকর্মের দায় সংগঠন নেবে না: ছাত্রলীগ, সমকাল, ৯ অক্টোবর ২০১৯)
বর্তমানে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বক্তব্য বিগত সরকারের আমলে ছাত্রলীগের দায় এড়ানোর রাজনীতিরই অনুরূপ। অবশ্য ছাত্রলীগ তো লোকদেখানোর জন্য হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বহিষ্কার করত, ছাত্রশিবিরের ক্ষেত্রে সেটুকুও ঘটছে না।
ছাত্রশিবির আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাসীন না থাকলেও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোয় বেশ প্রভাবশালী। সংগঠনটির বিরুদ্ধে বিগত সরকারের আমলে ছাত্রলীগের মধ্যে ঢুকে গুপ্ত রাজনীতিচর্চার অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আবদুল কাদের ছাত্রলীগ পরিচয়ে নির্যাতনকারী শিবির কর্মীদের নাম–পরিচয় ও বিভিন্ন ঘটনার বিস্তারিত উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘ছাত্রলীগ যে নিপীড়ন-নির্যাতন চালাত, তারা সেগুলোর অংশীদার হতো, লীগের কালচারই চর্চা করত।’ এসব ঘটনার মধ্যে গেস্টরুমে শিক্ষার্থীদের শারীরিক–মানসিক নির্যাতন থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে আটকে রাখার মতো গুরুতর ফৌজদারি অপরাধও রয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে যখন ছাত্রলীগের অপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গ ওঠে, তখনো ছাত্রলীগের মধ্যে গুপ্ত থাকা শিবির নেতাদের এসব গুরুতর অপকর্মের দায়মুক্তি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে শিবিরের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে কাদের লিখেছিলেন, ‘৫ আগস্টের পরে হলে হলে ব্যাচ প্রতিনিধি হয়, শৃঙ্খলা কমিটি হয়, এটা কার প্রেসক্রিপশনে হয়, সেটা প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক পরিচয় দেখলেই বোঝা যায়।
ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে অনলাইনে ভোটাভুটি করে অধিকাংশ ব্যাচ প্রতিনিধি শিবির নিজেদের লোকজনকে নির্বাচিত করে। এই ব্যাচ প্রতিনিধিরাই পরবর্তী সময়ে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে, একপ্রকার ছায়া প্রশাসন হিসেবে হলে ফাংশন করে। এই ব্যাচ প্রতিনিধিরাই আবার ৫ তারিখের পরে ছাত্রলীগের নামের তালিকা তৈরির দায়িত্ব নেয়। স্বাভাবিকভাবেই তারা নিজেদের সাথি ভাইদের তালিকার বাইরে রাখে।’
শুধু গণ–অভ্যুত্থানের আগের ঘটনার ক্ষেত্রেই না, গণ-অভ্যুত্থানের পরও শিবিরের এই দায় না নেওয়ার রাজনীতি চলেছে সাধারণ শিক্ষার্থী পরিচয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিভিন্ন শিক্ষক ও অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থী পরিচয়ে বিভিন্ন সময় মব উসকানোর অভিযোগ রয়েছে শিবিরের বিরুদ্ধে।
প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট ও উদীচীর বিরুদ্ধে দলটির নেতা-কর্মীদের উসকানির দায় নিতে না চাওয়া এরই ধারাবাহিকতা। এভাবে দায় না নিয়ে ক্ষমতার রাজনীতি করা শিবিরের জন্য সুবিধাজনক হলেও দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য বিপজ্জনক।
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
মতামত লেখকের নিজস্ব
