ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে খুন না করে থামতে চাইছে না ইসরায়েল

২০২১ সালের মে মাসে গাজায় হামাসের সমাবেশে ইয়াহিয়া সিনওয়ার

গাজায় আড়াই শ দিনে ৩৭ হাজার মানুষ হত্যা করেও ইসরায়েল বলতে পারছে না এই যুদ্ধে তারা জিতেছে। অন্তত আরও একজন মানুষকে মারতে মরিয়া তারা। কেবল তাঁর লাশই ইসরায়েলকে বিজয়ের নারকীয় তৃপ্তি এনে দিতে পারে। ইসরায়েলের গোয়েন্দারা, তাদের পুরো সামরিক কাঠামো হন্যে হয়ে খুঁজছে সেই ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে।

ধারণা করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারাও এ কাজে ইসরায়েলকে সাহায্য করে যাচ্ছেন। কিন্তু গাজা যুদ্ধের আট মাস পরও সিনওয়ার কীভাবে ইসরায়েলের বুলেট এড়িয়ে এখনো তাঁর গেরিলাদের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন, সেটা আধুনিক যুদ্ধ ইতিহাসের এক বিস্ময় হয়ে উঠেছে।

যুদ্ধ বন্ধে বড় ‘বাধা’ ইয়াহিয়া সিনওয়ার?

গাজা মাত্র ১৪১ বর্গমাইলের একটি জায়গা। লোকসংখ্যা ২০ লাখের মতো। এ রকম একটা পরিসরে সিআইএ এবং মোশাদের মতো দক্ষ গোয়েন্দা বাহিনীর নজরদারি এড়িয়ে মাসের পর মাস লুকিয়ে থাকা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কিন্তু ইয়াহিয়া সিনওয়ার এখনো বিস্ময়করভাবে বেঁচে আছেন। জীবিত আছেন তাঁর আহত প্রধান সহযোগী মোহাম্মদ দায়েফও।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অসম হলেও পূর্ণাঙ্গ এক যুদ্ধে লিপ্ত সিনওয়ারের বাহিনী। তাতে প্রায় পনেরো শ ইসরায়েলি মারা গেছেন এ পর্যন্ত। অর্থাৎ প্রতি ১০০ ফিলিস্তিনিকে খুনের বিনিময়ে তাদের হারাতে হয়েছে মাত্র ৪ জন।

যুদ্ধের সব পরিসংখ্যান তাদের পক্ষে, তারপরও ইসরায়েলের কাছে মনে হচ্ছে না এই যুদ্ধে তারা জিতেছে। খুশি নয় তাদের বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রও। উভয়ের অখুশির কারণ গাজার প্রতিরোধ যোদ্ধাদের প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ার এখনো জীবিত। সে জন্যই হয়তো বিশ্বজুড়ে এই যুদ্ধ বন্ধে যতই দাবি উঠুক, সিনওয়ারকে জীবিত বা মৃত না পাওয়া পর্যন্ত ইসরায়েল গাজা যুদ্ধ থামাবে বলে মনে হয় না। স্বঘোষিত ওই ‘অগ্রাধিকারমূলক লক্ষ্য’ তারা এখনো হাসিল করতে পারেনি।

হামাসের শীর্ষ নেতা ইসমাইল হানিয়ার সঙ্গে সিনওয়ার
ছবি: রয়টার্স

কোথায় সিনওয়ার?

গত ৮-৯ মাসের যুদ্ধে গাজার বড় অংশই এখন ধ্বংস হয়ে যাওয়া এক নগরী। এখানকার ৫৫ শতাংশ ভবনই ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত। বাকিগুলোতেও প্রতিদিন মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েই কেবল থাকতে হয়। বোমা পড়ার সম্ভাবনা আছে এবং প্রকাশ্য নজরদারির সুযোগ থাকছে, এমন জায়গায় সিনওয়ারের থাকার কথা নয়। ৬১ বছর বয়সী এই প্রতিরোধযোদ্ধা হয়তো এ মুহূর্তে গাজায় মাটির নিচের কোনো সুড়ঙ্গে লুকিয়ে আছেন।

ইসরায়েল ও আমেরিকার গোয়েন্দাদের সে রকমই ধারণা বলে গত ১৮ মে উল্লেখ করেছে মিডল ইস্ট আই নামের সংবাদমাধ্যম। কিন্তু ওই রকম সুড়ঙ্গ গাজায় আছে মাইলের পর মাইল। ফলে চট করে এই কমান্ডারকে শনাক্ত করা ও হামলা করা সহজ নয়। খুবই অপ্রচলিত ধরনের এক প্রতিরক্ষা কৌশল নিয়েছেন সিনওয়ার নিজের জন্য।

কিন্তু মাটির যত গভীরেই থাকুন, ইসরায়েল যেকোনো মূল্যে তাঁকে পেতে মরিয়া। দেশটির অজেয় সামরিক ইমেজ তিনি ভেঙেছেন। তাঁর বাহিনী ইসরায়েলের অনেক ভেতরে আঘাত করতে পেরেছিল গত ৭ অক্টোবরের ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাডে’র মাধ্যমে। এই অভিযান ‘ইসরায়েলের ভেতর ইহুদিরা নিরাপদ’ থাকার এত দিনের ধারণা ভেঙে দিয়েছে।

আরও পড়ুন

বলা যায়, পুরো ইসরায়েল রাষ্ট্রের জাতীয় অহং টেনে ছিঁড়েছেন সিনওয়ার। এসব কারণে তিনি ইসরায়েলের এক নম্বর শত্রু এখন। কিন্তু ইরান, সিরিয়া, লেবাননে যখন যাকে ইচ্ছা টার্গেট করে খুন করতে অভ্যস্ত তেল আবিবের গোয়েন্দারা গাজার পাড়ায় পাড়ায় হাজার হাজার সৈনিক ঢুকিয়েও সিনওয়ারকে পাচ্ছেন না, এটা নেতানিয়াহু সরকারের কাছে অসহনীয় ঠেকছে।

সন্দেহ তৈরি হয়েছে, সিনওয়ার কি তবে সুড়ঙ্গপথে সিরিয়া বা লেবাননে সরে পড়েছেন? কিন্তু এটি নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া যাচ্ছে না। হামাসের দ্বিতীয় সারির নেতাদের এ রকম দাবি রয়েছে যে গাজায় মাঝেমধ্যে অল্প সময়ের জন্য প্রকাশ্যে এসে সিনওয়ার তাঁর যোদ্ধাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। অর্থাৎ প্রাণের মায়ায় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানোর লোক তিনি নন।

একই কথা বলা হয় মোহাম্মদ দায়েফের বেলাতেও। ইসরায়েলের গোয়েন্দারা গত দুই দশকে যার একটি ছবিও জোগাড় করতে পারেননি, অথচ গাজার সুড়ঙ্গ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তাঁরই চিন্তার ফসল বলে মনে করা হয়।

গাজায় হামাসের সমাবেশে ইয়াহিয়া সিনওয়ার। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে
ছবি: রয়টার্স

হামাসের নেতৃত্বকাঠামোতে সিনওয়ারের গুরুত্ব বেড়েছে

হামাসের নেতৃত্বকাঠামোতে ইয়াহিয়া সিনওয়ারের অবস্থান সর্বোচ্চ নয়। তিনি কেবল গাজার প্রধান। কিন্তু হামাসের শক্তির ভরকেন্দ্র গাজা। পশ্চিম তীরসহ ফিলিস্তিনিদের অন্যান্য জনপদে তাদের প্রভাব কম। তা ছাড়া গাজার হামাস যোদ্ধারাই ইসরায়েলকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, আর তাঁদের নেতা তিনি। সেই সূত্রে হামাসের পুরো নেতৃত্বকাঠামোতে সিনওয়ার ইতিমধ্যে প্রধান এক চরিত্র হয়ে গেছেন।

ফলে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, হামাসের অপর প্রধান নেতাদের চেয়েও সিনওয়ারের দিকেই ইসরায়েল-আমেরিকার সামরিক নজরদারি বেশি এখন। গাজা যুদ্ধ থামাতে কাতারে থাকা হামাসের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নেতাদের সম্মতিও অনেকখানি নির্ভর করছে সিনওয়ারের সবুজ সংকেতের ওপর।

সিনওয়ার-মিশনে যুক্তরাষ্ট্র যে কারণে আগ্রহী

গাজা যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় প্রশ্নহীনভাবে জায়নবাদীদের পাশে আছে। তবে বাইডেন প্রশাসনের জন্য গাজা যুদ্ধ দুধারী তলোয়ারের মতো। যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, তত ইসরায়েলকে সহায়তা দিয়ে যেতে হচ্ছে তাদের।

আবার এই যুদ্ধ আমেরিকা-ইউরোপজুড়ে জনমতকে ভাগ করে ফেলেছে। ক্রমেই বেশি বেশি মানুষ ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি উদ্ধারের সংগ্রামের সমর্থক বনে যাচ্ছেন।

শ্বেতাঙ্গ তরুণ-তরুণীরা অনেকেই ইসরায়েলি বর্বরতায় ওয়াশিংটনের মদদে বিক্ষুব্ধ। এর মধ্যে আবার সামনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ থামাতে কিছু করতে না পারার জন্য বাইডেনের ইমেজ খারাপ হচ্ছে ক্রমেই।

কিন্তু ‘বিজয়ে’র একটা পরিপূর্ণ তৃপ্তি ছাড়া ইসরায়েলকে আগ্রাসন বন্ধে রাজি করানো বাইডেন প্রশাসনের জন্য সহজ নয়। তাতে নেতানিয়াহু রাজনৈতিকভাবে নিজ ভোটারদের কাছে বিপদে পড়বেন। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেরও মান-ইজ্জত থাকে না এতে। তাতে মধ্যপ্রাচ্যে হামাসের সামরিক অভিভাবক ইরানের ইমেজ আরও শক্তপোক্ত হয়ে উঠতে পারে। উজ্জীবিত হবে লেবাননের হিজবুল্লাহও।

প্রশ্ন হলো, সিনওয়ারকে হত্যা করা হলে তাঁর বাহিনী কি কোনো ধরনের যুদ্ধবিরতি আর মেনে নেবে? আবার এ–ও সত্য, তখন তাদের প্রতিরোধের তীব্রতা সাময়িকভাবে হলেও কমে আসতে পারে। কিন্তু নিশ্চিতভাবে অন্য কোনো সিনওয়ার এসে আবার মাতৃভূমি উদ্ধারের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে কাজে নেমে পড়বে। ফিলিস্তিনিদের অতীত ইতিহাস সে রকমই।

এসব কারণেই ওয়াশিংটনের হিসাব হলো, সিনওয়ারকে হত্যা করা গেলে তেল আবিবকে দিয়ে একটা বিজয় উৎসব করানো যায় এবং যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগও তখন নেতানিয়াহু হয়তো মেনে নেবেন। সিআইএর জন্য তাই সিনওয়ারকে খুঁজে দেওয়া বিরাট এক সামরিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত ১১ মে ওয়াশিংটন পোস্ট স্পষ্ট করে লিখেছে, হামাস নেতাদের অবস্থান সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে ইসরায়েলকে সাহায্য করছে।

প্রশ্ন হলো, সিনওয়ারকে হত্যা করা হলে তাঁর বাহিনী কি কোনো ধরনের যুদ্ধবিরতি আর মেনে নেবে? আবার এ–ও সত্য, তখন তাদের প্রতিরোধের তীব্রতা সাময়িকভাবে হলেও কমে আসতে পারে। কিন্তু নিশ্চিতভাবে অন্য কোনো সিনওয়ার এসে আবার মাতৃভূমি উদ্ধারের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে কাজে নেমে পড়বে। ফিলিস্তিনিদের অতীত ইতিহাস সে রকমই।

২০০৪ সালে ইয়াসির আরাফাতকে বিষ প্রয়োগে হত্যার পর মনে হয়েছিল, এই জনগোষ্ঠী আর দখলদারত্বের বিরুদ্ধে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু গাজা যুদ্ধ সেটাকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে।

ইয়াহিয়া সিনওয়ারও নিশ্চিতভাবে শেষ ফিলিস্তিনি বীর নন। এমনকি নিহত হলেও তিনি ভবিষ্যতের সিনওয়ারদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন।

  • আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক