২০২১ সালের মার্চে ইউসি বার্কলের ইনভেস্টিগেশন ল্যাব বসেছিল ‘জুম’ বৈঠকে। তখন ঘোর কোভিডকাল। তাই এই ব্যবস্থা। অতিমারির পৃথিবী কার কাছে কেমন, তা দেখার সুযোগ জুটেছিল ওই বৈঠকে। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেনি বা তাকায়নি। প্রত্যেকেই ব্যস্ত ছিল ইন্টারনেটে। কেউ কেউ ফেসবুক বা টুইটারে ভিডিও ও ফটো দেখছিল নিবিষ্ট চিত্তে। এই ছবিগুলোর মধ্যে ছিল মিয়ানমারে ঘটে চলা ভীতিকর ঘটনার সব ছবি ও ভিডিও। যেমন শান্ত কোনো রাস্তায় দুই বন্ধু মোটরবাইকে চড়ে যাচ্ছেন কোথাও।
আচমকা তাঁরা গুলিবিদ্ধ হলেন। কিংবা ট্রাকের পেছনে ডাঁই করে রাখা মৃতদেহ। অথবা ক্রন্দনরত নারী-পুরুষ, যাঁরা স্বজনকে কেন হত্যা করা হলো, তার জবাব খুঁজছেন।
বার্কলের এই ছাত্ররা ডিজিটাল গবেষক। তাঁরা গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেন। কখনো কখনো হাজার মাইল দূর থেকে। ২০১৬ সালে আমাদের হিউম্যান রাইটস সেন্টারের ইনভেস্টিগেশন ল্যাব কাজ শুরু করে। শত শত ছাত্রছাত্রী এখান থেকে শিখেছে কীভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ছবি দেখে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা শনাক্ত করা যায়।
আমাদের উদ্দেশ্য ছিল গবেষণার সবচেয়ে আধুনিক কৌশল শেখা একদল পেশাজীবী তৈরি করা। পাশাপাশি সাংবাদিক, মানবাধিকার গবেষক এবং আইনজীবীদের সহযোগিতা করা। কারণ, তাঁদের অনেকেই হয়তো যথাযথ প্রশিক্ষণ অথবা সময়ের অভাবে অনলাইনে উপাত্ত খুঁজে নিতে এবং তদন্ত ঠিকঠাক করতে পারেন না।
ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে আমাদের ছাত্ররা একসঙ্গে বসে সহিংসতার এসব ভিডিও দেখেনি। কিন্তু তারা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে, অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পেরেছে। এভাবে একের সঙ্গে অন্যের যে সম্পর্ক, তা গভীর হয়। তাদের এই সম্মিলিত চেষ্টা হয়তো নির্মমতার অভিযোগ তদন্তে ভূমিকা রাখবে। দীর্ঘ মেয়াদে হয়তো মিয়ানমারে ঘটে চলা সহিংসতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তারা তথ্যপ্রমাণ হাজির করে জোরালো অবস্থান নিতে পারবে, ভুক্তভোগীরা আইনগত সহযোগিতা পাবে। আর স্বল্প মেয়াদে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে একেকজন ছাত্র ছবি বা ভিডিও থেকে খুঁজে পেল একেক রকম অর্থ।
এই কাজটা খুব সহজ নয়। একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের সঙ্গে জঘন্যতম যে অপরাধ করতে পারেন, তার ভিডিও বা ছবি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেখা, বিশ্লেষণ করা যেকোনো মানুষের জন্য দুরূহ। তাই ল্যাব প্রতিষ্ঠার পরপর আমরা প্রথমে যার খোঁজ নিলাম তা হলো, বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো একটা উপায় বের করা। যেন গবেষকদের এসব ছবি তাড়িয়ে না বেড়ায়। যেন অন্যের ওপর ঘটা এই বর্বরতায় তাঁরা যন্ত্রণাক্লিষ্ট হয়ে না পড়েন। আমরা এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করি। উদ্দেশ্য ছিল আমাদের প্রশিক্ষণার্থীদের মতো সাধারণ মানুষও যেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা বীভৎসতা থেকে নিজেকে সুরক্ষা দিতে পারেন।
এই যুগে মুঠোফোন আমাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। আমরা সব সময় কেবল যুদ্ধাপরাধের সাক্ষ্যপ্রমাণ খুঁজতে মুঠোফোন স্ক্রল করি না। আমরা টুইটার (এক্স), টিকটক অথবা ফেসবুকে হঠাৎ কিছু ভিডিও বা ছবির মুখোমুখি হই। যেমন ইউক্রেন যুদ্ধে নিহত কোনো শিশু, বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় দৃষ্টিশক্তি হারানো মানুষ কিংবা বীভৎস কিছু। হয়তো সে সময় আমরা সন্তানের জন্য সকালের নাশতা তৈরি করছি বা প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়েছি অথবা ফুরফুরে মেজাজে ইনস্টাগ্রাম ঘাঁটছি।
নতুন এই বিশ্বব্যবস্থা কিছু প্রশ্নের অবতারণা করেছে। কীভাবে একজন মানুষ, হোক তিনি মানবাধিকারকর্মী বা সাধারণ কেউ, গা শিউরে ওঠা ছবি দেখেও স্থির থাকেন? কীভাবে আমরা ক্ষতির আশঙ্কা কমিয়ে আনতে পারি? কীভাবে আমরা অনলাইনে যে সময় কাটাচ্ছি, তা থেকে সামাজিক ও মানসিকভাবে লাভবান হতে পারি?
ভার্চ্যুয়াল জগতের বর্বর ও বীভৎস ছবি ও ভিডিও থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার হাজারো পন্থা আছে। এর মধ্যে তিনটি পদ্ধতি বিশেষভাবে কার্যকর। যেমন জেনে-বুঝে দেখা, নিজের অভিজ্ঞতা অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া এবং প্রয়োজন ছাড়া এ ধরনের ছবি বা ভিডিও না দেখা।
মনোবিজ্ঞানী মেটিন বা ও লু এবং এবরু সালকিওগ্লু ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, উদ্বেগ তৈরি হয় এই ভাবনা থেকে যে যা কিছু ঘটছে, তার ওপর আপনার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আর মানুষ ভেঙে পড়ে তখনই, যখন সে বুঝতে পারে, এ পরিস্থিতি থেকে ভবিষ্যতে উত্তরণের আশা নেই। ভার্চ্যুয়াল জগৎ থেকে যে বেদনার সূত্রপাত, তা আমাদের শক্তিশালী করবে, নাকি আমরা নৈরাশ্যের অতল গহ্বরে পড়ে থাকব, তা নির্ভর করে আমরা কীভাবে ছবি বা ভিডিওটি দেখছি, কেন দেখছি।
ইউসি বার্কলের গ্রেটার গুড সায়েন্স সেন্টার অর্থবহ জীবনের পেছনে কীভাবে বিজ্ঞান অবদান রাখে, তা গবেষণা করে দেখছে। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য যদি থাকে, তাহলে যেকোনো কাজই শক্তিশালী হতে পারে। সামাজিক বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষকেরা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বলতে বুঝিয়েছেন কোনো কিছু অর্জনের আন্তরিক ইচ্ছাকে, যা ব্যক্তিজীবনে অর্থবহ এবং এই পৃথিবীতে ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। এখন যদি নিজেদের সুরক্ষার জন্য আমরা চিন্তাভাবনা করে মুঠোফোন স্ক্রল করি, তাহলে ফলাফল কেমন হবে?
আমরা যখন ‘প্রত্যক্ষদর্শী’, তখন এ ধরনের ছবি, ভিডিও বা খবর স্ক্রল করার একটা কার্যকারণ থাকে। মেডিকেল নৃতত্ত্ববিদ এবং বৈশ্বিক স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষক পল ফারমার বলেন, প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে কোনো কিছু দেখার অর্থ সহানুভূতি নিয়ে দেখা, সংহতি বোধ করা। এটা ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে দেখা, তাদেরই জন্য (হয়তো সেই ভুক্তভোগী মারা গেছেন কিংবা বিস্মৃত হয়েছেন)। এই অভিজ্ঞতা যেকোনো প্রত্যক্ষদর্শীর জন্য অবিশ্বাস্যরকমের অর্থবহ।
এভাবে বিষয়গুলোকে দেখা ‘ডুমস্ক্রলিং’, অথবা রোবটের মতো একের পর এক ছবি দেখার চেয়ে আলাদা। অবিবেচকের মতো স্ক্রল করতে থাকা আপনার জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। কারণ, আপনি প্রেক্ষাপট বিবেচনা করছেন না বা যথেষ্ট বিশ্লেষণ করেননি। নিজের ওপর হয়তো আপনার নিয়ন্ত্রণও নেই। অন্যদিকে যাঁরা অপরাধ তদন্ত করেন, তাঁরা পদ্ধতিগতভাবে ছবি, ভিডিও বিশ্লেষণ করে থাকেন। ঘটনার উৎস খুঁজে দেখতে ছবি স্ক্যান করেন। ভয়ংকর ছবি খুঁটিয়ে দেখার পেছনে তাঁদের নির্দিষ্ট কারণ আছে। কখনো কখনো নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণের কারণে তাঁদের মানসিক চাপ কম হয়।
কেন স্ক্রল করছি, সে সম্পর্কে যেমন ভাবা উচিত, তেমনি আমরা যেন অপ্রস্তুত অবস্থায় নেতিবাচক কোনো কিছুর মুখোমুখি না হই, সেদিকেও মনোযোগ দেওয়া দরকার। যুদ্ধাপরাধ এবং মানবাধিকারবিষয়ক তদন্ত কর্মকর্তারা মাঝেমধ্যে ইন্টারনেট থেকে পাওয়া কোনো কোনো ছবিকে ‘বিষাক্ত বর্জ্যে’র সঙ্গে তুলনা করেন। এখন আপনি কি অবিবেচকের মতো নিজেকে বা নিজের পরিবারকে এই বিকিরণের মধ্যে ফেলে দেবেন? নাকি তাঁদের সতর্কতার সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল জগতে প্রবেশ করতে বলবেন? দীর্ঘ সময় ধরে কেউ যদি অবিবেচকের মতো ভার্চ্যুয়াল জগৎ অনুসরণ করেন, তাহলে ক্ষতি কতটা হয়? যদিও অন্যের যে বেদনা বা ব্যথা তাকে আমরা ‘বর্জ্য’ বলতে পারি না। এই শব্দটা বিশ্লেষকেরা ব্যবহার করেন বিপদের ঝুঁকি বোঝানোর জন্য।
প্রযুক্তির এই যুগে আমাদের ভার্চ্যুয়াল জগতে আনাগোনা অনেক বেড়েছে। ছবি দেখে পাঠোদ্ধার করা এবং ঘটনার গভীরে যাওয়ার ক্ষমতা সবার থাকে না। এই অভিজ্ঞতা অশেষ। সুজান সনট্যাগ তাঁর রিগার্ডিং দ্য পেইন অফ আদাররস বইয়ে বলেছেন, কোনো ছবি বা ভিডিও দেখে আমাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা নির্ভর করে আমাদের পরিচিতির ওপর বা আমাদের ভাবাদর্শের ওপর। যখন একজন মানুষ যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি দেখে শান্তির পক্ষে কথা বলবেন, অন্য একজন, যিনি যুদ্ধের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত, তিনি হয়তো চাইবেন যুদ্ধের তীব্রতা আরও বাড়ুক। ছবি নিজে কথা বলে না, এর অর্থ নির্ভর করে ব্যক্তির ওপর।
ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে আমাদের ছাত্ররা একসঙ্গে বসে সহিংসতার এসব ভিডিও দেখেনি। কিন্তু তারা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে, অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পেরেছে। এভাবে একের সঙ্গে অন্যের যে সম্পর্ক, তা গভীর হয়। তাদের এই সম্মিলিত চেষ্টা হয়তো নির্মমতার অভিযোগ তদন্তে ভূমিকা রাখবে। দীর্ঘ মেয়াদে হয়তো মিয়ানমারে ঘটে চলা সহিংসতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তারা তথ্যপ্রমাণ হাজির করে জোরালো অবস্থান নিতে পারবে, ভুক্তভোগীরা আইনগত সহযোগিতা পাবে। আর স্বল্প মেয়াদে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে একেকজন ছাত্র ছবি বা ভিডিও থেকে খুঁজে পেল একেক রকম অর্থ।
টাইম ম্যাগাজিন-এ প্রকাশিত। ঈষৎ সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
অ্যালেক্স কোয়েনিং ও আন্দ্রেয়া ল্যাম্প্রোস ইউসি বার্কলের হিউম্যান রাইটস সেন্টারের ইনভেস্টিগেশন ল্যাবের সহপ্রতিষ্ঠাতা।