কয়েক সপ্তাহ ধরে বেশির ভাগ মানুষের দৃষ্টি ছিল বেশ কিছু বেসরকারি ব্যাংকের বহুল আলোচিত ব্যাংকঋণ কেলেঙ্কারির দিকে। তবে এই সব কেলেঙ্কারির বাইরেও আমাদের ব্যাংকিং খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর দীর্ঘমেয়াদি ও পদ্ধতিগত দুর্বলতার দিক থেকে চোখ সরানো আমাদের ঠিক হবে না।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের বর্তমান উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গত ১১ ফেব্রুয়ারি একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন, যেখানে তিনি দেশে এত বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থাকার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। আমি তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে পুরোপুরি একমত হয়ে এবং আরও এক ধাপ এগিয়ে বলতে চাই আমাদের কি আদৌ কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থাকা উচিত? এই ব্যাংকগুলোকে এখনই কি বেসরকারি খাতে মুক্ত করে দেওয়ার সময় নয়?
আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আকার কিন্তু বিশাল। দেশজুড়ে ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শাখা প্রায় চার হাজার। যেখানে রয়েছে আমাদের ব্যাংক খাতের মোট আমানত ও সম্পদের এক-চতুর্থাংশ। কিন্তু এই ব্যাংকগুলোর পারফরম্যান্স খুবই হতাশাজনক। দুর্বল সরকারি তত্ত্বাবধান ও উৎসাহব্যঞ্জক মুনাফার অভাবে এ প্রতিষ্ঠানগুলো বহুদিন ধরেই টিকে থাকার লড়াই করছে।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো অদক্ষ ও অলাভজনক। এ ছাড়া খেয়াল করলে দেখা যায় যে গ্রুপ হিসেবে এক দশক ধরে তাদের নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন ২ শতাংশের নিচে আটকে আছে, যেখানে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন ২ দশমিক ৫ শতাংশের ওপরে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খরচ ও আয়ের অনুপাত ৮০-৯০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে, যেখানে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এই অনুপাত থাকে ৭০ শতাংশের মাঝামাঝিতে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর শেয়ারহোল্ডারদের প্রতি রিটার্ন অন ইক্যুইটি গত এক দশকে দাঁড়িয়েছে গড়ে ১৩ শতাংশ। সহজ কথায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে বিনিয়োগ করা প্রতি ১০০ টাকায় ১৩ টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সাত থেকে আট বছরের মধ্যে বিনিয়োগকৃত পুরো টাকাই হাওয়া হয়ে যাবে।
আসলে পচনটা আরও গভীরে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো খুবই নিম্নমানের ঋণদাতা, যাদের দেওয়া ঋণের ২৫ শতাংশই থাকে অনাদায়ি। মানে প্রতি চারটি ঋণের মধ্যে একটি অনাদায়ি থেকে যাচ্ছে। এর মূল কারণ হলো রাজনৈতিক প্রভাব, সুশাসনের অভাব, দুর্বল ঝুঁকি-ব্যবস্থাপনা এবং দক্ষ জনবল আকর্ষণের অক্ষমতা।
আসুন, এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে আমাদের ব্যাংকিং খাতকে সংস্কার করি, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করি এবং আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির পথে নিয়ে যাই। বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎটা এর ওপর ভর করেই এগিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
তাহলে এর সমাধান কী? বেসরকারীকরণ কি ভালো একটি সমাধান না? ন্যূনতম মূলধনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আমরা যেহেতু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি, আমাদের সামনে সোনালি সুযোগ এসেছে নতুন এক পরিকল্পনার।
বেসরকারি খাত থেকে বাড়তি মূলধন সংগ্রহে আমাদের মনোযোগী হতে হবে। যদি তা–ও কার্যকর না হয়, তাহলে পাবলিক ফান্ড ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ভবিষ্যতে বেসরকারীকরণের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য একটি স্পষ্ট ও স্বচ্ছ রোডম্যাপ থাকতে হবে।
বলে রাখা ভালো, এটি কোনো আদর্শগত বিষয় নয়, বরং বাস্তবতা। আমরা একটি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ এবং তাই আমাদের প্রশাসনিক সমস্যা কিছুটা থাকবেই। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সব সময় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের শিকার হয়ে এসেছে এবং সামনেও হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই শুধু মূলধন বাড়িয়ে এদের সেই একই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে এবং চলমান অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার অধীনে রাখা মানে হলো বারবার একই ভুল করার সুযোগ রাখা।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কৌশলগত সুবিধা হারানোর বিষয়ে যাঁরা চিন্তিত, তাঁদের জন্য বিকল্প হতে পারে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, যা জাতীয় অর্থনীতির লক্ষ্য বাস্তবায়ন ও ক্রটিগুলো নিয়ে কাজ করবে। ফলে অলাভজনক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে পরিচালনার বাধা ও ঝুঁকি ছাড়াই এটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ কিছু খাতে প্রভাব খাটানোর কিছুটা সুযোগ করে দেবে।
এ ক্ষেত্রে আধাআধি সমাধানের সময় এখন শেষ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো আমাদের জনগণের সম্পদ যেমন বিনষ্ট করেই চলেছে, তেমনি আমাদের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য এটি ঝুঁকিপূর্ণ। এই ব্যাংকগুলোর কর্মদক্ষতা উন্নয়ন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমানো, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বৃদ্ধি এবং সুদক্ষ জনবল আকৃষ্ট করার একমাত্র সহজ পথ হতে পারে বেসরকারীকরণ।
নতুন এই যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমি অন্তর্বর্তী সরকারকে, বিশেষ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে সেই পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করার আহ্বান জানাই, একজন নাগরিক হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি যে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
আসুন, এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে আমাদের ব্যাংকিং খাতকে সংস্কার করি, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করি এবং আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির পথে নিয়ে যাই। বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎটা এর ওপর ভর করেই এগিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
তাওহীদ আলী, প্রথম সারির বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান অ্যালিয়্যান্স বার্নসটেমইন (এবি)-এর প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা
[email protected]