রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির একটি পঙ্ক্তির ঋণ করতে হলো নিবন্ধের শিরোনামে। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগপর্যন্ত অনেক অপমানের শিকার হয়েছিলেন তাঁর প্রিয় বাঙালির দ্বারাই। তবে উক্ত পঙ্ক্তির উপজীব্য তাঁর নিজের অপমান নয়। হিন্দু সমাজে শতাব্দীর পর শতাব্দী নিম্নবর্ণ উচ্চবর্ণের কাছে কীভাবে নিগৃহীত হয়েছে, তার এক করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে মূল কবিতাটিতে। অনেকটা আর্তনাদের মতো। কবি উচ্চবর্ণকে সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, এমন নিগ্রহ যদি চলতে থাকে, ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। শুধু তা–ই নয়, পুরো সমাজই ভেঙে পড়তে পারে একসময়।
নিউটনের (গতির) তৃতীয় সূত্র বলছে: প্রতিটি কাজের (তথা বলপ্রয়োগের) একটি সমমানের ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া হয়, যা জড় জগতের একটি ধ্রুব সত্য। ঠিক একই কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন কবিতার ভাষায়:
‘যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।’
যা মনুষ্য জগতের এক অমোঘ সত্য। সাহিত্যিক-দার্শনিক মানব মনস্তত্ত্ব ও সমাজ মনস্তত্ত্ব বিষয়ে গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক তাঁরা ভালো বোঝেন এবং সাহিত্যে-দর্শনে তা লিপিবদ্ধ করেন। সে জন্যই, রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক ঘটনা বোঝার জন্য সাহিত্য ও দর্শনশাস্ত্র পাঠ করা জরুরি।
রবীন্দ্রনাথ শ্যামলী কাব্যগ্রন্থের ‘হঠাৎ দেখা’ শীর্ষক কবিতায় এমনি এক দার্শনিক তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। তিনি বলছেন, ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে’। অর্থাৎ যা চলে গেছে তা আদতে পুরোপুরি চলে যায়নি, বরং কালের গভীরে তার রেশটুকু থেকে গেছে। অতীত বর্তমানকে সৃষ্টি করে। তাই তো কবি বলছেন:
‘হে অতীত, তুমি ভুবনে ভুবনে
কাজ করে যাও গোপনে গোপনে।’
বর্তমানকে অতীত ভুলের কুপ্রভাব থেকে মুক্ত করতে হলে দরকার বর্তমান সময়ে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর ব্যাপক সংশোধনী কর্মযজ্ঞ। বাংলাদেশে ঘটেছে ঠিক তার উল্টোটি। বাঙালির স্বাধিকার-স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকশিত হওয়ার পরিবর্তে আমরা যেন পশ্চাৎ-যাত্রা শুরু করেছি। এ দেশের একটি বিরাটসংখ্যক মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কর্মকাণ্ডে ভীষণ রকম তৎপর।
বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের চার স্তম্ভ অর্থাৎ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এখানে সমাজতন্ত্র যুক্ত হয়েছে সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে, কারণ স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেওয়া দল ও প্রথম ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ কখনোই সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেনি। ফ্রান্সের মতো অথবা ওয়েস্টমিনস্টার স্টাইলের ডেমোক্রেসির মতো একটি আধুনিক রাষ্ট্র গঠন করাই ছিল আদতে বাঙালির সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য। এখন আধুনিক রাষ্ট্র বলতে কী বোঝায়, তা পরিষ্কার হওয়া দরকার।
সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ইউরোপের এনলাইটেনমেন্ট মুভমেন্ট পুরো পশ্চিমা দুনিয়ায় যে বিশ্ববীক্ষা তৈরি করেছিল, তার মূলকথা ছিল বিশ্বাসের পরিবর্তে যুক্তির আশ্রয়, ভাবের বিপরীতে বস্তুর প্রাধান্য, ইহজাগতিকতায় গুরুত্ব আরোপ ইত্যাদি। এনলাইটেনমেন্ট মুভমেন্টই বা আলোকায়নের যুগই ফরাসি বিপ্লবের ভিত্তি। অতএব এনলাইটেনমেন্ট মুভমেন্টের পরিভাষার কয়েকটি শব্দবন্ধ লক্ষ করলে আধুনিক রাষ্ট্র বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যাবে। যেমন এনলাইটেনমেন্ট মুভমেন্টের মূল বিষয়গুলোর মধ্যে আছে যুক্তির মহিমা উদ্যাপন ও যুক্তির প্রয়োগ; বিশ্বাস ও পূর্বধারণা থেকে মুক্তি; যে ধীশক্তি দিয়ে মানুষ এই অনন্ত বিশ্বকে জানতে পারে ও মানবসমাজের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে সেই শক্তির উন্মেষ ঘটানো; জ্ঞান, মুক্তি ও সুখ হলো যুক্তিবাদী মানবতার লক্ষ্য ইত্যাদি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন দুটি ধারার স্পষ্ট বিভাজন। একটি ধারা মানুষের তৈরি আইন দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার পক্ষে। আরেকটি ধারা ধর্মীয় আইন দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার পক্ষে। প্রথম ধারার পক্ষে সিংহভাগ মানুষ থাকলেও তারা বহুধাবিভক্ত। কার্যক্রম, শক্তিমত্তা, লক্ষ্যস্থিত বিনিয়োগ—সবকিছু সীমিত। দ্বিতীয় ধারার ঐক্য, লক্ষ্যস্থিত বিনিয়োগ, কার্যক্রম এবং শক্তিমত্তার প্রদর্শন ব্যাপক, বহুগুণ। আধুনিক রাষ্ট্রের পক্ষের মানুষের সব মনোযোগ ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারে, দুর্নীতির মাধ্যমে টাকার পাহাড় নির্মাণে। আধুনিক রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যে কোনো যৌথ প্রয়াসে মনোযোগ নেই, বিনিয়োগ নেই। যার ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উল্টো দিকে আমাদের এই যাত্রা।
প্রতিটি কাজের (তথা বলপ্রয়োগের) একটি সমমানের ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া হয়—বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কয়েকটি ছোট্ট ঘটনার মধ্যে নিউটনের এই তত্ত্বের বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ যদি জাসদকে রাজনীতি করার সুযোগ দিত, বহুদলীয় ব্যবস্থা অব্যাহত থাকত, সংবাদপত্রকে, ব্যক্তির কণ্ঠরোধ না করত, তাহলে হয়তো ’৭৫-এর নির্মম ঘটনা ঘটত না। বাংলাদেশে সামরিক শাসনেরই সূচনা হতো না।
’৯১-এ জাতীয় নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা বাকশাল বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগকে একটি গণতান্ত্রিক সংগঠনে রূপান্তরিত করেছিলেন। ’৯৬-এ ক্ষমতায় এসে ডেপুটি স্পিকারের পদ বিরোধী দলকে দিতে চেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে প্রেসিডেন্ট করেছিলেন। অর্থাৎ যিনি (শেখ হাসিনা) একসময় গণতন্ত্রপ্রিয় ছিলেন, তিনি বনে গেলেন স্বৈরশাসক। এখানেও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সূত্র বলবৎ।
এরপর শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার বাসভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। এর প্রায় ২০ বছর পর তাঁর পিতার বাসভবনটিও ধ্বংস হয়ে গেল। প্রতিপক্ষ তারেক রহমানকে ১৭ বছর প্রবাসে থাকতে হয়েছে। আজ শেখ হাসিনাকেও দেশের মাটি থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। প্রতিটি বলপ্রয়োগের একটি সমমানের ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া হয়—এ দুটি ঘটনার চেয়ে প্রামাণ্য আর কী ঘটনা থাকতে পারে? প্রতিহিংসা একটি ভয়াবহ রকমের বিষক্রিয়া, যা যুগ থেকে যুগান্তরে সঞ্চারিত হয়। কারণ, প্রতিহিংসা প্রতিহিংসার জন্ম দেয়, যা যুগের পর যুগ চক্রাকারে চলতে থাকে। গান্ধীর অহিংস নীতি এই তত্ত্বের ওপরেই প্রতিষ্ঠিত। রাজনীতিতে এই প্রতিহিংসাপরায়ণতা থেকে আমাদের বেরোতেই হবে। না হলে মুক্তি নেই।
আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুঁজি করে মানুষকে ধোঁকা দিয়েছে। কারণ, সংবিধানে সংযুক্ত ওই মূলনীতি ধারণ করেন, এমন কোনো আওয়ামী লীগ নেতার সন্ধান আমার কাছে নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করলে কেউ এভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হতে পারে না। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের কুকীর্তি আমরা জানি, কিন্তু ২০২৪-এর জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের একটি অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকে মিলিয়ে ফেলেছে। বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রামের প্রধান নেতা শেখ মুজিবের অবদানকে খাটো করেছে, ঐতিহাসিক দিবস মুছে ফেলতে চেয়েছে।
সরকার ঐতিহাসিক দিবস মুছে ফেলার প্রয়াসে এবং ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংস করার সুযোগ করে দিয়েছে আর কিছু সংবাদপত্র বা মিডিয়া এ বিষয়ে চুপ থেকেছে। সরকার থেকেও এসব ধ্বংস কার্যক্রম ফ্যাসিবাদের প্রতি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। মৌলবাদী, স্বাধীনতাবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী উন্মত্ত জনগোষ্ঠীকে এভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ন্যায্যতা দেওয়া, সমর্থন করা, নীরব থাকা, প্রতিবাদ না করার প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ১৮ ডিসেম্বর প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট ও ঢাকার অন্যান্য স্থানে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ।
যে সমাজে অন্যায়ের প্রতিবাদ হয় না, সেই সমাজ একসময় বসবাসের অযোগ্য হতে বাধ্য। আর সমাজ বসবাসের অযোগ্য হলে, যত অর্থবিত্তের মালিকই হই না কেন, বেঁচে থাকতে পারলেও, সুখ সর্বাধিক করা যাবে না।
এন এন তরুণ অর্থনীতির অধ্যাপক, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected]
*মতামত লেখকের নিজস্ব
