আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কে হলো, তাতে আমাদের কী

ফার্স্ট লেডির কবিতা পাঠ এবং প্রেসিডেন্টের বক্তব্য শুনে উপস্থিত কচিকাঁচা শিশুরা হর্ষধ্বনি করল। হাততালি দিলেন অভিভাবকেরাওছবি : রয়টার্স

খুব সাজানো-গোছানো। বলা যায়, কোরিওগ্রাফ করা দৃশ্য ছিল সেটি। সেই দৃশ্যের দুই প্রধান পাত্র-পাত্রী ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন।

জনপ্রিয় তারকাদের ভঙ্গিমায় তাঁরা একটি কালো পর্দার ওপাশ থেকে আবির্ভূত হলেন। বেশ বড় একটা ক্রিসমাস ট্রির নিচে রাখা দুটি লাল চেয়ারে এসে দুজন বসলেন। ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন একটি কবিতার বই নিয়ে সেখান থেকে দ্য নাইট বিফোর ক্রিসমাস কবিতাটি পড়ে শোনালেন।

গত ২২ ডিসেম্বর ওয়াশিংটন ডিসির চিলড্রেনস ন্যাশনাল হসপিটালে এই আয়োজন করা হয়েছিল। বাইডেন দম্পতির সামনে বসা দর্শক শ্রোতাদের মধ্যে হাসপাতালটিতে ভর্তি হওয়া শিশুরা উপস্থিত ছিল। সেখানে সেই অসুস্থ শিশুদের অভিভাবকেরাও হাজির ছিলেন।

বড়দিন কেন্দ্র করে শুরু হওয়া উৎসব মৌসুমে একাত্মতা জানানোর অংশ হিসেবে এই আয়োজন ছিল।

ফার্স্ট লেডির কবিতা পাঠ এবং প্রেসিডেন্টের বক্তব্য শুনে উপস্থিত কচিকাঁচা শিশুরা হর্ষধ্বনি করল। হাততালি দিলেন অভিভাবকেরাও। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বললেন, ‘আপনাদের এখানে আমাদের আসতে সুযোগ দেওয়ায় আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।’

আজ থেকে ৭৫ বছর আগে তৎকালীন ফার্স্ট লেডি বেস ট্রুম্যান বাৎসরিক শিশু হাসপাতাল পরিদর্শনের যে সূচনা করেছিলেন, সেটিই আজ এত দিনে রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। সেই রেওয়াজ অনুযায়ী, প্রতিবছর বড়দিনের আগে মার্কিন ফার্স্ট লেডি শিশু হাসপাতালে এসে অসুস্থ শিশুদের সঙ্গে সময় কাটান।

গত ৭৫ বছরে কোনো ফার্স্ট লেডির এ ধরনের শিশু হাসপাতাল পরিদর্শনের সময় প্রেসিডেন্ট সঙ্গে থাকেননি। রেওয়াজে নতুনত্ব এনে ২০২২ সাল থেকে ফার্স্ট লেডির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও থাকছেন।

ফার্স্ট লেডি জিল যখন কবিতার বইটি উঁচু করে ধরে কবিতা পড়ছিলেন, তখন বাইডেনকে তাঁর দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি হাসতে দেখা গেছে।

ফার্স্ট লেডির কবিতা পাঠ শেষ হলে বাইডেন হাসপাতালের কর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, ‘আপনারা যে আয়োজন করেছেন, তা খুবই বিশেষ কিছু।’ এরপর তিনি বাণী দিলেন, ‘যেখানেই জীবন, সেখানেই আশা বেঁচে থাকে।’ তিনি অসুস্থ শিশুদের উপদেশ দিলেন, তারা যেন সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরার পর ছুটির দিনগুলো ঘরে না কাটিয়ে হাসপাতালে থাকা অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে যায়।

বাইডেনের কথা শুনে একজন হাসপাতাল কর্মী বললেন, প্রেসিডেন্টের এই হাসপাতাল পরিদর্শন ও শিশুদের সময় কাটানো সব শিশু আর তাদের পরিবারের জন্য আনন্দ বয়ে আনে।

প্রতিক্রিয়ায় বাইডেন বললেন, ‘ঈশ্বর আপনাদের সবার মঙ্গল করুন।’

তাঁদের এই পরিদর্শন পর্বের ব্যাপ্তি ছিল ১০ মিনিটের কম। তবে অনুষ্ঠানের সময় যত সংক্ষিপ্তই হোক, আমার ধারণা এর মধ্যেই বাইডেন নিজেকে একজন অত্যন্ত শিশুবৎসল, সহৃদয় ও উদার মানুষ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। শিশুদের জন্য তাঁর হৃদয় যে কাঁদে, তা তিনি তাঁর বক্তব্য ও অভিব্যক্তি দিয়ে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু টেলিভিশনের পর্দায় যখন এই সাজানো-গোছানো অনুষ্ঠান দেখছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল বাইডেনের কাছে সব শিশু আসলে এক নয়। তাঁর কাছে কোনো শিশুর জীবনের তুলনায় কোনো শিশুর জীবনের দাম অনেক বেশি।

ফিলিস্তিনে যে হাজার হাজার শিশুকে হত্যা করা হলো, তা ঠেকাতে বাইডেন তাঁর হাতে থাকা ক্ষমতা ও প্রভাব ব্যবহার তো করলেনই না, উল্টো এসব শিশু হত্যায় সেই ক্ষমতা ও প্রভাব ব্যবহৃত হচ্ছে।

অধিকৃত ফিলিস্তিনি শিশুদের কাছে তিনি আনন্দের ফেরিওয়ালা হতে পারেননি। উল্টো একটি অবরুদ্ধ ভূমির অসহায় মানুষের দোজখখানার তিনি অন্যতম সহপ্রতিষ্ঠাতার ভূমিকা নিয়েছেন।

পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে প্রাণের অস্তিত্ব ঠান্ডা মাথায় বিনাশ করার সর্বাত্মক চেষ্টায় প্রধান ইন্ধনদাতা হিসেবে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। ‘যেখানে জীবন, সেখানেই আশা বেঁচে থাকে’, এই দার্শনিক বাণী যে তাঁর সস্তা বুলি, তা ইতিমধ্যে সবার কাছে পরিষ্কার হয়েছে।

বাইডেনের এই লোকদেখানো নাটক আরও অশ্লীল হয়ে উঠেছে তখন, যখন হাসপাতালটি পরিদর্শনের সময় শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া ও পরিচর্যা করা নার্সদের তিনি সেবাধর্ম পালনের জন্য প্রশংসা করছিলেন। কারণ, ঠিক সেই সময়ে আমেরিকার প্রক্সি শক্তি ইসরায়েল গাজার হাসপাতালগুলোতে নির্বিচার বোমা ফেলছিল। শিশু ও নারীদের চিকিৎসা দেওয়া চিকিৎসক ও নার্সদের হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হচ্ছিল।

বোমায় ছিন্নভিন্ন শিশুর দেহ কাফনে পেঁচিয়ে কবর দিতে যাওয়া ফিলিস্তিনি বাবা-মায়ের আকাশ ফাটানো চিৎকারও বাইডেনকে এ ধরনের অনুষ্ঠানে গিয়ে ফটোসেশন করতে নিরুৎসাহিত করেনি।

বাইডেনের মতো একজন শিক্ষিত ও সজ্জন লোক যদি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন মূর্খ ও একগুঁয়ে উন্মত্ত লোকের বিকল্প হতে না পারেন, তাহলে বাইডেনকে সম্মানজনক ও শিক্ষিত মানুষ হিসেবে প্রশংসা করে আমি ইতিপূর্বে যত কলাম লিখেছি, তা মুছে ফেলতে চাই।

যে উদার ও শিক্ষিত আমেরিকান নাগরিকেরা আগামী নভেম্বরে ট্রাম্পের চেয়ে বেশি উন্মত্ত ও অমানবিক নেতার নেতৃত্বাধীন আরও চারটি বছর আমাদের উপহার দিতে চান, তাঁদের প্রশংসা করে লেখা আমার অন্যান্য কলামও আমি মুছে ফেলতে চাই। কারণ এখন আমার মনে হচ্ছে, হোয়াইট হাউসের জন্য ট্রাম্পই আসলে মানানসই নেতা।

  • আল-জাজিরা থেকে নেওয়া ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
    অ্যান্ড্রু মিত্রোভিকা আল-জাজিরার জ্যেষ্ঠ কলাম লেখক