হরিজন শিশুর কান্না যে কারণে আমাদের জন্য লজ্জার

শিশু বীরার কান্না এ রাষ্ট্রের জন্য, সরকারের জন্য, আমাদের জন্য বড় লজ্জার
ছবি: ডেইলি স্টারের সৌজন্যে

একই মানুষ, একই রক্ত, একই আলো–হাওয়ায় বেড়ে ওঠা, একই দেশের নাগরিক, একই রাস্তায় হাঁটাচলা—তবু কত ভেদাভেদ। ঘরে ঘরে, পরিবারে পরিবারে, সমাজে সমাজে বিরাজমান নানা বৈষম্যের মাঝেও আলাদা করে চিহ্নায়িত হয়ে ওঠে তারা। বলছিলাম, এ দেশের হরিজন সম্প্রদায়ের কথা। বাড়ির পাশে অচেনা পড়শি যারা। যাদের নাম শুনলেই দুটি শব্দ অনায়াসে চলে আসে—অচ্ছুত আর অস্পৃশ্য।

উপমহাদেশজুড়ে নানা জায়গায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে তাদের বসবাস। বাংলাদেশে হরিজন বলে সাধারণত আমরা বুঝি, ব্রিটিশ আমলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পয়োনিষ্কাশন, চা–বাগান, রেলের কাজসহ প্রভৃতি কাজের জন্য ভারতের নানা অঞ্চল থেকে নিয়ে আসা দরিদ্র ও দলিত জনগোষ্ঠী। এরপর থেকে কয়েক প্রজন্ম ধরে এখানেই তাদের বসবাস। এখানকারই স্থায়ী বাসিন্দা।

রেলওয়ে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, সেলুনে নানা জায়গায় তাদের কাছ থেকে আমরা সেবা নিয়ে থাকি। কিন্তু তাদের ছোঁয়া যাবে না। তাদের সঙ্গে মেশাও যাবে না। কারণ, তারা নিচু জাত। মানুষ হিসেবে এর চেয়ে বড় অমর্যাদাকর আর কী হতে পারে। বিষয়টি প্রথম নাড়া দিয়েছিল অল্প বয়সে, লেখক আবুল ফজলের আত্মজীবনী ‘রেখাচিত্র’ পড়তে গিয়ে। সেখানে তিনি বর্ণনা করেছিলেন, কীভাবে চট্টগ্রাম শহরের মেথরপট্টির লোকদের একই দোকানে বসে খেতে দেওয়া হতো না। এমনকি দোকানের পেছন বা এক পাশ দিয়ে আলাদা পাত্র করে খাবার কিনতে পারতেন তাঁরা। সমাজের মূলধারার জনগোষ্ঠীর শিশুদের সঙ্গে স্কুলেও পড়তে পারত না তাঁদের সন্তানেরা। গোটা শহর সাফ-সুতরো ও সুন্দর করে রাখতেন যাঁরা, তাঁদেরই কি না মনে করা হতো সবচেয়ে নোংরা-অপরিষ্কার, অসুন্দর ও অপবিত্র।

গত বৃহস্পতিবার ডেইলি স্টার অনলাইনে প্রকাশিত ছবিসহ একটি প্রতিবেদন দেখে আবুল ফজলের সেই বর্ণনার কথা মনে পড়ে গেল। স্কুলের পোশাক পরা এক শিশু হোটেলের বাইরে বসে কাগজের টুকরো থেকে খাবার খাচ্ছে। তার সহপাঠীরা সবাই ভেতরে বসলেও তাকে হোটেলে বসতে দেওয়া হয়নি। এমনকি হোটেলের কোনো পাত্রে তাকে খাবারও দেওয়া হয়নি। সাত বছর বয়সী প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী বীরা বলছে, হোটেলে বসে বান্ধবীদের সঙ্গে খাবার খেতে তারও খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু তাকে কখনোই হোটেলে বসতে দেওয়া হয় না। কারণ, সে হরিজন সম্প্রদায়ের একজন। কথাগুলো বলতে বলতে বীরার চোখ পানিতে ভরে ওঠে। অতটুকু শিশু চেষ্টা করে চোখের পানি লুকাতে। এ ঘটনা মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলা শহরের রেলওয়ে কলোনিতে। শিশু বীরা সেখানকার রাবেয়া আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তার মতো হরিজন সম্প্রদায়ের আরও শিশু স্কুলটিতে পড়ে। তাদের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটে।

বীরার সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়া ডেইলি স্টারকে বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের কুলাউড়া শাখার সভাপতি মৎলা বাসপর বলেন, ‘আমরা সামাজিক বা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। শহর পরিষ্কার রাখতে আমরাই কাজ করি। অথচ সেই পরিষ্কার শহরে আমাদের সঙ্গেই বৈষম্য করা হয়। আমাদের ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন স্কুলে পড়ালেখা করে। টিফিনের সময় বাকি সব শিশু হোটেলে বসে খেতে পারলেও আমাদের ছেলেমেয়েরা ঢুকতে পারে না। তারা স্কুল ড্রেস পরা থাকলেও কাগজে নাশতা দেয়, ময়লা পাত্রে পানি দেয়, আর বসতে হয় হোটেলের বাইরে। এই বৈষম্যগুলো ইদানীং অনেক বেশি করা হচ্ছে।’

এর আগে ২০২১ সালে এই একই নভেম্বর মাসে রংপুর প্রেসক্লাব মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন রংপুরের হরিজন সংগঠনের প্রতিনিধিরা। সেখানে লিখিত বক্তব্যে বর্ণনা করা এক বছর আগের একটি ঘটনা তখন সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বেশ আলোচিত হয়েছিল।

নীলফামারীর সৈয়দপুরে হরিজন সম্প্রদায়ের এসএসসি পাস শিক্ষার্থী ও তার বাবার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা ছিল সেটি। মেয়ে এসএসসির ফল পেয়ে খুশিতে বাবাকে ফোন করে হোটেলে ডাকে মিষ্টিমুখ করাবে বলে। বাবাও খুশিমনে ছুটে আসেন দোকানের সামনে। তখন স্কুলের পোশাক পরিহিত মেয়ে হোটেলের ভেতরে মিষ্টি নিয়ে বসে ছিল। কিন্তু বাবার কোনো দেখা নেই। সে সময় মেয়ের ফোন বেজে উঠল। রিসিভ করতেই ও পাশ থেকে শোনা গেল বাবার কণ্ঠ, ‘হোটেলের মালিক ভেতরে যেতে মানা করছে।’ মেয়েটি ফোন রেখে হোটেলের মালিককে ডেকে বলল, ‘ওনাকে ভেতরে আসতে দিন, উনি আমার বাবা।’ কিন্তু হোটেলের মালিক সায় দিলেন না। উল্টো রেগে গিয়ে বললেন, ‘ উনি তোমার বাবা! তার মানে তুমিও একই! জলদি বাইরে যাও। হোটেলে ঢুকেছ কেন? জানো না তোমাদের হোটেলে বসতে মানা?’

গত মাসের শুরুতে রংপুর নগরীতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখি আমরা। সেখানকার এক হোটেলে খেতে গেলে হরিজন সম্প্রদায়ের এক স্কুলছাত্রকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের প্যাডে ‘এই হোটেলে খাওয়া নিষেধ সুইপারের’ লেখা এক টুকরো কাগজও ওই শিক্ষার্থীর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনার বিচার চেয়ে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে হরিজন সম্প্রদায়। পরে স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যস্থতায় পরিস্থিতি শান্ত হয়। সেই কিশোরকে হোটেলে বসিয়ে মিষ্টিমুখ করান হোটেলের ম্যানেজার।

২০২০ সালে কুলাউড়ার আরেকটি ঘটনার কথাও অনেকের মনে থাকতে পারে। হরিজন হওয়ার কারণে একটি শিশুকে সেখানকার একটি বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। স্কুল কর্তৃপক্ষ ও প্রধান শিক্ষকের ভাষ্য ছিল, শিশুটিকে ভর্তি করানো হলেও অন্য শিশুদের অভিভাবকেরা আপত্তি তোলেন যে একজন হরিজন শিশুর সঙ্গে তাদের বাচ্চা পড়াশোনা করবে না। এ কারণেই তাঁরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি মানতে পারেননি শিশুটির বাবা। তিনি কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে ঘটনার প্রতিকার চেয়ে আবেদন করেন। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে শিশুটি স্কুলে পড়ার সুযোগ পায়।

শত শত বছর ধরে এমন বঞ্চনার শিকার হরিজনরা। আবুল ফজলের সেই স্মৃতিও ছিল ব্রিটিশ আমলের। এরপর দেশভাগ হলো। মুক্তিযুদ্ধ হলো। মানচিত্র বদলাল দুই দফা। হলো নতুন সংবিধান। যার প্রস্তাবনায় লেখা হলো, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করতে হবে।’

কিন্তু কুলাউড়া, রংপুর, নীলফামারীর এসব ঘটনা থেকে বাস্তবে আমরা কী দেখতে পাই? অথচ সংবিধানেরই ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হলো, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী–পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোনো বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে কিংবা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনো নাগরিককে কোনোরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাবে না।’    

এ দেশে সুইপারের কাজই হরিজনদের প্রধান পেশা। কিন্তু তাঁদের বেতন কম, ইনক্রিমেন্ট নেই, পেনশনও নেই। বর্তমানে সব শ্রেণির মানুষের জন্য কাজটির সুযোগ করে দেওয়ায় তাঁরা এ পেশাও হারাতে বসেছেন। পুঁজির অভাবে ছোটখাটো ব্যবসাও করতে পারেন না। কেউ চেষ্টা করলেও সেখানে অস্পৃশ্যতা গেড়ে বসে। যেমন কেউ দোকান দিলে হরিজন বলে তাদের কাছ থেকে অনেকে কেনাকাটা করতে চান না। এসব দলিতদের মতো এ সমাজে দরিদ্র, অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায় আর কে আছে? অর্থনৈতিক দুর্দশা তো আছেই, সামাজিক ও মানবিক মর্যাদার দিকেও এভাবে তাদের পিছিয়ে থাকাটা কোনোভাবেই গ্রহণীয় হতে পারে না।

অবাঙালি দলিত হরিজনরাই নন, দেশে স্থানীয় দলিতদেরও এমন অস্পৃশ্যতার শিকার হতে হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকারবঞ্চিত এসব মানুষের সংখ্যা ৬০–৬৫ লাখ। গোটা জনগোষ্ঠীর তুলনায় যার হিস্যা অল্পই। সংবিধানই হওয়ার কথা ছিল এসব মানুষের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় রক্ষাকবচ, কিন্তু যে বাস্তবতা আমরা দেখতে পাই, তাতে আমাদের হতাশ হতে হয়। শিশু বীরার কান্না এ রাষ্ট্রের জন্য, সরকারের জন্য, আমাদের জন্য বড় লজ্জার।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক