আরবান ৯৫, নগর–নকশা ও শিশুর বিকাশ

যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে লোগান ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরে শিশুদের জন্য খেলার স্থান আছে বেশ কয়েকটি। দেয়ালে শিশুসাহিত্যের জনপ্রিয় চরিত্র আঁকা। বইগুলো থেকে কিছু বাক্য, লেখক ও অলংকরণশিল্পীর পরিচিতিও আছে।

বাংলা ভাষার শিশুসাহিত্য অনেক সমৃদ্ধ। সেগুলো নিয়ে বিমানবন্দরে বা অন্যান্য স্থানে এই উদ্যোগ নেওয়া যায়। এর ফলে শিশুরা নানা বই ও চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত হবে, গল্পগুলো পড়ায় আগ্রহী হয়ে উঠবে। সাহিত্যপাঠ তাদের কল্পনাশক্তি বাড়িয়ে সামগ্রিক বিকাশে ভূমিকা রাখবে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে এমন একটি খেলার স্থান রাখার কথা কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখতে পারে।

শিশুদের চাহিদার কথা মনে রাখুন

যেকোনো বিষয়ে আমরা অনেকেই প্রথমে আর্থিক দিকটা চিন্তা করি। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুবান্ধব হওয়ার সঙ্গে অর্থের কোনো সম্পর্ক নেই। ঢাকার বেশ কিছু ক্লিনিকেই শিশুবিশেষজ্ঞরা নির্দিষ্ট একটি তলায় বসেন। অপেক্ষার স্থানে টেলিভিশন আছে। সেখানে সারাক্ষণ খেলা বা খবরের চ্যানেল ছেড়ে রাখার প্রয়োজন আছে কি? শিশুতোষ অনুষ্ঠান দেখানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছাই কি যথেষ্ট নয়? ধরা যাক, একটা জনসমাগমস্থলে ১০টা বেসিন আছে। তার ২টা বেসিন অনায়াসেই শিশুদের উচ্চতার কথা ভেবে তৈরি করা যায়। এতে কোনো অতিরিক্ত খরচ নেই। এমন অনেক উদাহরণ আছে।

শিশুর চোখ দিয়ে বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করলে বিনা খরচে বা খুব অল্প খরচেই অনেক অবকাঠামো, নকশা ও সেবা শিশুবান্ধব করা সম্ভব। একটি রেস্তোরাঁয় শিশুদের জন্য আলাদা চেয়ার রাখা এবং খাবারের তালিকায় শিশুদের কথা ভাবা, রেস্তোরাঁমালিকের মানসিকতার ওপর নির্ভর করে। সেখানে খাবারের জন্য অপেক্ষা করার সময় কাগজ ও রং পেনসিল, ধাঁধা থাকলে তারা আনন্দের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবে, বিকাশের জন্য উদ্দীপনাও পাবে।

ইউরোপের বেশ কিছু আর্ট গ্যালারিতে দেখেছি যে নানা শিল্পকর্মের বর্ণনা শিশুদের বোধগম্য ভাষায় লিখে নিচু করে টাঙানো হয়েছে, যাতে তারা সহজে পড়তে পারে। বাস বা রেলস্টেশন, বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন স্থানে শিশুদের জন্য খেলার স্থান, মায়েদের জন্য শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। বিভিন্ন অবকাঠামো ও সেবা যে শুধু বয়স্করা নন শিশুরাও ব্যবহার করবে, এটি মনে রাখলে শিশুদের উপযোগী অনেক কিছু বিদ্যমান সামর্থ্যের মধ্যেই করা সম্ভব।

বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে শিশুদের নিরাপত্তাকে বিবেচনায় নেওয়া, শহরাঞ্চলে সবুজ গাছপালা ফিরিয়ে আনা, শিশুর খেলাধুলা ও সৃজনশীল কার্যক্রমের ওপর গুরুত্বারোপ করা এবং সমাজকে শিশুর জন্য নিরাপদ করা অত্যন্ত জরুরি। নগর-পরিকল্পনায় বিভিন্ন বয়সী শিশুদের কথা শোনা এবং তাদের সঙ্গে নিয়ে নকশা করাটা গুরুত্বপূর্ণ।

নগর-পরিকল্পনায় শিশুদের কথা শুনতে হবে

‘আরবান ৯৫’ বার্নার্ড ভ্যান লিয়ার ফাউন্ডেশনের একটি উদ্যোগ। তিন বছর বয়সী শিশুর গড় উচ্চতা সাধারণত ৯৫ সেন্টিমিটার। এ অবস্থান থেকে দেখলে নগরের বিভিন্ন স্থানের নকশায় কী পরিবর্তন আনতে হবে, সে বিষয়টি নিয়েই ‘আরবান ৯৫’ পৃথিবীর নানা দেশে কাজ করছে। আলবেনিয়ার তিরানা থেকে কলম্বিয়ার বোগোটা, বিভিন্ন নগরে শিশুদের কেন্দ্র করে উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। বোগোটার সবচেয়ে দরিদ্র এলাকাগুলোর একটি সিউদাদ বলিভার। সেখানে অপরাধের হার খুব বেশি। শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো শনাক্ত করে এলাকার বাসিন্দারা শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন।

বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে শিশুদের নিরাপত্তাকে বিবেচনায় নেওয়া, শহরাঞ্চলে সবুজ গাছপালা ফিরিয়ে আনা, শিশুর খেলাধুলা ও সৃজনশীল কার্যক্রমের ওপর গুরুত্বারোপ করা এবং সমাজকে শিশুর জন্য নিরাপদ করা অত্যন্ত জরুরি। নগর-পরিকল্পনায় বিভিন্ন বয়সী শিশুদের কথা শোনা এবং তাদের সঙ্গে নিয়ে নকশা করাটা গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে আমাদের নগরগুলো শিশুদের জন্য বাসযোগ্য হবে। নগর-পরিকল্পনাকারী, স্থপতি ও নকশাবিদদের শিশুবান্ধব অবকাঠামো ও নকশা তৈরি এবং সেবা প্রদানে সচেতনতা এবং দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। বিষয়টি পাঠ্যক্রমে থাকা উচিত।

মনে রাখতে হবে সব শিশুর কথা

কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের কেমব্রিজ শহরে পার্কিন্স স্কুল ফর দ্য ব্লাইন্ডে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। একটা সর্বজনীন খেলার মাঠ দেখলাম। তার একটা অংশে টেবিলের দুই পাশে বসার জন্য বেঞ্চ আছে। এক পাশে খানিকটা ফাঁকা স্থান রাখা হয়েছে। এখানে হুইলচেয়ার নিয়ে শিশুরা বসতে পারে। নকশায় সামান্য পরিবর্তন এনে বিভিন্ন খেলায় প্রতিবন্ধী শিশুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে।

সেখানকার কারখানায় কয়েকজন কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকের সঙ্গে সর্বজনীন নকশা নিয়ে কথা বলার সুযোগ হলো। প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য তাঁরা বিভিন্ন ধরনের আসবাব তৈরি করেন। শিশুদের বিশেষ চাহিদার কথা বিবেচনা করে প্রত্যেকের জন্য আলাদাভাবে নকশা করা হয়। উপযোগী আসবাব ব্যবহারের কারণে তাদের নিজের জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ে এবং মর্যাদার সঙ্গে তারা বাঁচতে পারে। এ ধরনের উদ্যোগ বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য নেওয়া উচিত।

প্রয়োজন শিশুসংবেদনশীল মানসিকতা

অর্থনীতিবিদ মাহবুবুল হকের একটা পর্যবেক্ষণ খুব গুরুত্বপূর্ণ—‘গণতান্ত্রিক হওয়ার জন্য একটা সমাজের প্রাচুর্যের দরকার নেই। সব সদস্যের অধিকারকে সম্মান করার জন্য কোনো পরিবারের ধনী হওয়ার প্রয়োজন হয় না। নারী-পুরুষের সমতার সঙ্গে একটা জাতির প্রাচুর্যের সম্পর্ক নেই। অর্থপূর্ণ সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধগুলো উপার্জনের যেকোনো স্তরেই বজায় রাখা সম্ভব।’

আমরা ‘শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ’ বলতে পছন্দ করি। কিন্তু তাদের বর্তমানকে সুন্দর করার জন্য আমরা দায়িত্ব পালন করছি কি? শিশুদের খেলার মাঠ দখল করে মেলাসহ নানা কাজে ব্যবহার সাধারণ চিত্র। শিশুসংবেদনশীল সমাজ গড়ায় আমাদের সবার নিজস্ব অবস্থান থেকে কাজ করা জরুরি। তাহলে শিশুদের যথাযথ বিকাশ নিশ্চিত করা সম্ভব এবং তারা বড় হয়ে জাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে পারবে।

  • লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী