মেট্রোরেলের পিলারে পোস্টার, কবে বদলাবে আমাদের নাগরিক স্বভাব?

মেট্রোরেলের কর্মীরা একদিকে ঘষেমেজে পোস্টার তুলছেন, অন্যদিকে নতুন পোস্টার লাগানো চলছে।
ছবি : প্রথম আলো

থাকিলে ডোবাখানা, হবে কচুরিপানা/ থাকিলে ডোবাখানা, হবে কচুরিপানা/ বাঘে হরিণে খানা একসাথে খাবে না/ স্বভাব তো কখনো যাবে না/ ও মরি, স্বভাব তো কখনো যাবে না—গুরুদাস পালের এই লোকগান এন্ড্রু কিশোরের কারণে একসময় বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়েছিল। গানটিতে গীতিকবি নানা দৃষ্টান্ত টেনে বলতে চেয়েছেন মানুষ হোক আর অন্য প্রাণী হোক, সহজাত অভ্যাস বা স্বভাব বদলানো কত কঠিন। কিন্তু প্রায় শতবর্ষ আগে রুশ চিকিৎসক পাভলভ গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন প্রাণীর সহজাত আচরণ বদলানোও যায়।

সিভিক সেন্স বা নাগরিক বোধ বলে একটি বিষয় আছে। নাগরিক হিসেবে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না, তারই নিয়মবিধি। লিখিত আইন হোক আর অলিখিত রেওয়াজ হোক, সহনাগরিকেরা সেটা মেনে চলেন, যাতে তার কারণে অন্য কেউ সমস্যায় না পড়েন। নাগরিক স্বাধীনতার সীমানা কত দূর, তা নিয়ে আইরিশ নাট্যকার জর্জ বার্নাড শ ও সায়েন্স ফিকশন লেখক এইচ জি ওয়েলসকে নিয়ে প্রচলিত একটি গল্প আছে। দুজন একবার প্রাতর্ভ্রমণে গেছেন। হঠাৎ করেই ওয়েলস তাঁর হাতের লাঠিটা ঘোরাতে শুরু করলেন। লাঠিটা ঠিক বার্নাড শ-এর নাক ছুঁই ছুঁই করে ঘুরতে লাগল। ওয়েলসের আচরণে ত্যক্তবিরক্ত বার্নাড শ বললেন, ‘এবার তোমার লাঠিটা ঘোরানো বন্ধ করো। যেকোনো সময় ওটা আমার নাকে এসে লাগবে।’

ওয়েলস বললেন, ‘লাঠি ঘুরিয়ে হাঁটা আমার নাগরিক অধিকার।’

জবাবে বার্নাড শ বললেন, ‘তোমার যুক্তি মানলাম। তবে আমার নাকের ডগা যেখানে শেষ, তোমার নাগরিক অধিকার সেখান থেকে শুরু।’

ঢাকার প্রধান সব সড়ক থেকে অলিগলিতে হাঁটতে-চলতে গেলে যে কারওরই মনে হতে পারে নাগরিক স্বাধীনতার আসলে কোনো সীমা আছে কি না। কেউ অবলীলায় আপনাকে পেরিয়ে যেতে যেতে খ্যাঁক করে কফ-থুতু কিংবা পানের পিক ফেলবে। আপনার জামাকাপড়, গায়ে-মুখে তার ছিটে এসে পড়বে। এই যে এত বড় একটা কোভিড মহামারি গেল, এত শোরগোল, এত মৃত্যু, এত ক্ষয়ক্ষতি, এত ভয়, এত উৎকণ্ঠা—এরপরও রাস্তাঘাটে থুতু ফেলার অভ্যাস বদলানো গেল না। আবার আপনি হয়তো ফুটপাত দিয়ে হাঁটছেন, আপনাকে অবলীলায় ধাক্কা দিয়ে কেউ অতিক্রম করে যাবে, তার জন্য দুঃখ প্রকাশের ধারও ধারবে না।

ভাঙাচোরা ফুটপাত ধরে হাঁটতে গেলেও পেছন থেকে বিকট হর্ন শুনতে পাবেন। পেছন ফিরে দেখতে পাবেন, মোটরসাইকেলচালক খুব বিরক্তি নিয়ে আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন আর হর্ন দিচ্ছেন। ভাবটা এমন ফুটপাত ধরে হেঁটে আপনি অপরাধ করে ফেলেছেন। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে ঢাকায় নাগরিকদের ওপর সহনাগরিকেরা যে যে স্বাধীনতার সীমা অতিক্রম করে, তার তালিকা তৈরি করা হলে তা দিয়ে হয়তো একুশ শতকে এসেও মহাকাব্য টাইপের ঢাউস গ্রন্থ লেখা যাবে। সেদিকে না গিয়ে সম্প্রতি আলোচিত দুটি ঘটনার দিকে নজর দেওয়া যাক।

সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো বনানী, বারিধারা, নিকেতন এবং গুলশান পূর্ব ও পশ্চিমের ৩ হাজার ৮৩০টি বাড়িতে জরিপ চালিয়েছে উত্তর সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে ২ হাজার ২৬৫টি বাড়িতেই পয়োবর্জ্য সরাসরি উন্মুক্ত নালা, খাল কিংবা লেকে ফেলা হচ্ছে। অর্থাৎ ৮৫ শতাংশ বাড়ির পয়োবর্জ্য সরাসরি নালায় মিশছে। অভিজাত এলাকার পরিস্থিতি যদি এই হয়, তাহলে অন্য এলাকাগুলোর পরিস্থিতি কী, সহজেই অনুমান করা যায়।

শুধু সহনাগরিকের ওপর সীমাহীন নাগরিক অধিকারচর্চা নয়, মেট্রোরেলের মতো স্থাপনার ওপরও সেই চর্চা বেশ জোরেশোরে চলছে। প্রায় পুরোটা লাইনজুড়ে মেট্রোরেলের পিলারে পোস্টার সাঁটানো হচ্ছে। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ নোটিশ দিয়ে সতর্ক করেছে, মেট্রোরেলের পিলারে পোস্টার লাগানো দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু সেই সতর্কবার্তা কে মানবে? ৩ জানুয়ারি প্রথম আলো ‘মেট্রোরেলের পিলারে পোস্টারের থাবা’—শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তাদের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের পোস্টারে ছেয়ে গেছে মেট্রোরেলের পিলারগুলো। চাকরি ও পাত্রপাত্রী চাই, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, এমনকি দুদকের পোস্টারও বাদ যায়নি। মেট্রোরেলের কর্মীরা একদিকে ঘষেমেজে পোস্টার তুলছেন, অন্যদিকে নতুন পোস্টার লাগানো চলছে।

মেট্রোরেলের পিলারে যে পোস্টার সাঁটানো হবে কিংবা দেয়াল লেখন হবে, তা নিয়ে নেটিজেনদের মাঝে আগে থেকেই শঙ্কা ছিল। চালুর আগেই অনেকে তো রীতিমতো শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, মেট্রোরেলের আসবাব কিংবা রং কত দিন অক্ষত থাকবে। পরীক্ষামূলকভাবে চালুর দু-তিন দিনের মধ্যে একটি সংবাদমাধ্যমের খবরে এসেছে, কে যেন একটি দেয়ালে লিখেছে, অমুক প্লাস অমুক। প্রেম প্রকাশের এমন মোক্ষম সুযোগ ছাড়েননি নাছোড় কোনো প্রেমিক।

প্রশ্ন হলো, এই ডিজিটাল যুগেও মেট্রোরেলের পিলারে গিয়ে কেন পোস্টার সাঁটাতে হবে? ট্রেনের দেয়ালে লিখতে হবে অমুক প্লাস তমুক? কেউ যুক্তি দিতে পারেন, এটা তো নাগরিক অধিকার। কিন্তু নাগরিক অধিকারের সীমা কিন্তু নির্ধারিত। আবার কেউ বলবেন, আইন তো আছে, প্রয়োগ হচ্ছে না কেন? বাস্তবে মানুষ নিজ থেকে স্বভাব না বদলালে আইন দিয়ে খুব যে বেশি কাজ হয়, তেমন দৃষ্টান্ত খুব একটা নেই। নাগরিকের মধ্যে তাঁদের নিজস্ব সম্পদ রক্ষার বোধ জন্মানো জরুরি। এটাও সিভিক সেন্স। নাগরিক হয়ে ওঠার বোধ। কেউই এই বোধ নিয়ে জন্ম নেয় না, চর্চার মধ্য দিয়ে গড়ে তুলতে হয়।

বনানী, বারিধারা, নিকেতন এবং গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় ৮৫ শতাংশ বাড়ির পয়োবর্জ্য সরাসরি নালায় মিশছে
ছবি : প্রথম আলো

দ্বিতীয় ঘটনাটি আরও পিলে চমকানো। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র ঢাকার অভিজাত এলাকা বলে পরিচিত গুলশানের কয়েকটি বাড়ির পয়োবর্জ্যের সংযোগ কলাগাছ দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন। নিয়ম অনুসারে বাসাবাড়ির পয়োবর্জ্যের সংযোগ দেওয়ার কথা ঢাকা ওয়াসার পয়োনিষ্কাশন নালায়। আর যেখানে ওই নালা নেই, ওই এলাকার বাড়ির মালিককে পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সেপটিক ট্যাংক স্থাপন করে নিতে হবে। কিন্তু এই দুটির কিছুই না করে পয়োবর্জ্য নিষ্কাশন করা হচ্ছিল সিটি করপোরেশনের খোলা নালায়। আর সেই নোংরা ও বিষাক্ত তরল বর্জ্য নালা থেকে খাল কিংবা লেকে গিয়ে পড়ছিল।

সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো বনানী, বারিধারা, নিকেতন এবং গুলশান পূর্ব ও পশ্চিমের ৩ হাজার ৮৩০টি বাড়িতে জরিপ চালিয়েছে উত্তর সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে ২ হাজার ২৬৫টি বাড়িতেই পয়োবর্জ্য সরাসরি উন্মুক্ত নালা, খাল কিংবা লেকে ফেলা হচ্ছে। অর্থাৎ ৮৫ শতাংশ বাড়ির পয়োবর্জ্য সরাসরি নালায় মিশছে। অভিজাত এলাকার পরিস্থিতি যদি এই হয়, তাহলে অন্য এলাকাগুলোর পরিস্থিতি কী, সহজেই অনুমান করা যায়।

মেয়র আতিকুল ইসলামের অভিযোগ, প্রথমে তিন মাস পরে আরও তিন মাস মোট ছয় মাস সময় দেওয়া হলেও বাড়ির মালিকেরা গা করেননি। কিন্তু কলাগাছ ঢুকিয়ে পয়োবর্জ্যের সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ার পর সোসাইটিগুলো আর বাড়ির মালিকেরা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। আর বছরের পর বছর ধরে ওয়াসা ‘বিল নিলে সেবাও দিতে হবে। আপনারা বিল নেন কিন্তু সেবা দেন না, এতেই এই অবস্থা। বিল নিচ্ছেন আপনারা (ওয়াসা), তরল পয়োবর্জ্য যাচ্ছে করপোরেশনের নালায়, খালে ও লেকে।’

প্রায় দুই কোটি, সোয়া দুই কোটি মানুষের ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে হলে এ নগরের বাসিন্দাদের আচরণ, অভ্যাস, স্বভাব বদলানো প্রয়োজন। নাগরিক হয়ে ওঠার মূল চ্যালেঞ্জটা আসলে সেখানেই। নাক আর লাঠি মাঝে সীমারেখা টানতে শিখব আমরা কবে?

  • মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী