বিএনপি-জামায়াত বিচ্ছেদ নিয়ে গেম থিওরি কী বলে?

দেশে যখন বিএনপির কর্মীদের ওপর হামলা চলছে, সে সময় বিএনপি জোট থেকে জামায়াতের বিচ্ছেদের কথা শোনা যাচ্ছে। তবে বিএনপি জামায়াতকে ছাড়ছে, না জামায়াত বিএনপিকে ছাড়ছে, তা স্পষ্ট নয়। গত কয়েক বছর এই জোটে জামায়াতকে সক্রিয় দেখা যায়নি। যুদ্ধাপরাধের বিচার ও শাস্তিদানের প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিএনপিও জামায়াত থেকে নিজেকে দূরেই রেখেছে। তাই এই বিচ্ছেদ অসম্ভব কিছু নয়। ১৯৯৫-৯৬ সালে জামায়াত বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আন্দোলনে ছিল। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে এরশাদের পাতানো নির্বাচনে তারা অংশ নিয়েছিল, যেখানে বিএনপি করেছিল বয়কট। সুতরাং বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের কৌশলগত ঐক্য কিংবা কৌশলগত বিচ্ছেদও যেমন হতে পারে, তেমনি আওয়ামী লীগের সঙ্গেও কখনো সমঝোতা ও কখনো বিরোধিতা চালাতে পারে জামায়াত।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রুতা বলে যদি কিছু থাকে, তা হলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির, মতাদর্শিকভাবে তারা দুটি ঐতিহাসিক জোট বা হিস্টোরিক্যাল ব্লকের নেতা। একটি দাঁড়ায় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের ইতিহাসের ওপর, অন্যটি দাঁড়ায় সার্বভৌমত্ব ও ইসলামি পরিচয়ের ওপর। তা ছাড়া ক্ষমতার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেও তাদের একটি জিতলে আরেকটি হারে। অন্যদিকে বড় দুটি দলের সঙ্গে অন্যদের ঐক্য ও বিরোধ লাভালাভের ব্যাপারমাত্র। যত কম সুবিধার বিনিময়ে যাকে জোটে পাওয়া যাবে, তাকেই তারা নেবে। আদর্শ এই দেশে কেবল লোকদেখানো, সুবিধার খাতিরে ভোল বদলাতে কারওরই কোনো অসুবিধা নেই। এই মুহূর্তে সরকারের সামনে প্রধান সমস্যা হচ্ছে নির্বাচনটাকে অংশগ্রহণমূলক দেখানো। অর্থাৎ নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ধরে রেখেই আগামী নির্বাচনে বিএনপিসহ অন্য দলগুলোকে আনা। প্রয়োজনে তাদের কিছু আসন বরাদ্দ দেওয়া।

পর্দার আড়ালের এই নির্বাচনী দর-কষাকষিতে সেই দলই যাবে, যার হারানোর চেয়ে পাওয়ার পাল্লা ভারী হবে। অবাধ ভোটাধিকারের ব্যবস্থা করা ছাড়া বিএনপি যদি নির্বাচনে যায়, তাহলে তার আম, অর্থাৎ আন্দোলনের নৈতিক পুঁজি ও ক্ষমতার ছালা—দুটোই যাবে। যদি সমঝোতার মাধ্যমে তারা কিছু সংসদীয় আসন পাওয়ার গ্যারান্টির কথা মাথায়ও রাখে, তাতে করে ক্ষমতাসীন সরকার আরও পাঁচ বছরের ক্ষমতার নিশ্চয়তা পেয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, কিছু নেতার এমপি হওয়ার বিনিময়ে দলটি আপসকামিতার অভিযোগ মাথায় নিয়ে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকারের দিক থেকেও বাস্তবে বিএনপিকে বেশিসংখ্যক আসনে ছাড় দেওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়। সংসদীয় আসন তো মাত্র ৩০০। কিন্তু গত এক দশকের ক্ষমতাচর্চার মধ্য দিয়ে দলে সংসদ সদস্য পদের দাবিদারের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে এর কয়েক গুণ বেশি। নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের ভেতরকার রক্তাক্ত অন্তর্কোন্দল দেখলেই বোঝা যায়, কেন্দ্রীয়ভাবে যে আশ্বাসই বিএনপি বা জামায়াতকে দেওয়া হোক, স্থানীয় পর্যায়ে তা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াবেন এলাকার প্রভাবশালী নেতারা। ধরা যাক, সব বিরোধী দলকে ১০০ আসন ছেড়ে দেওয়া হবে। সেই ১০০ আসনের ৩০০ দাবিদারেরা কি তা মেনে নেবেন? সুতরাং আপসের পথেও বিএনপির জন্য তেমন সুযোগ নেই। তারপরও যদি তারা যায়, তাহলে ২০১৮ সালের মধ্যরাতের মতো তারা আবারও প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবে। পরিণতিতে কর্মীদের আস্থা ও জনসমর্থন হারিয়ে বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং যুক্তি বলে, বিএনপির পক্ষে নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা ছাড়া আর কোনো উপায়ই থাকছে না।

আরও পড়ুন

কিন্তু জামায়াতের সমস্যাটি তেমন নয়। তাদের গুটিকয় আসন তো সরকার দিতেই পারে। তার আগে জামায়াতের এখন চাই দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন। তার চাই রাজনৈতিক বৈধতা। নীতিগতভাবে এই নিবন্ধনের ব্যবস্থা বর্তমান সরকার যেমন করতেও পারে না, তেমনি তা সমর্থন করাও তাদের ঘোষিত অবস্থানের বরখেলাপ হয়। তা ছাড়া সরকারের সঙ্গে আপস করে নিবন্ধনহীন অবস্থায় স্বতন্ত্র প্রতীকে নির্বাচন করাও জামায়াতের জন্য অর্থহীন। এতে করে দলের কিছু নেতার এমপি হওয়ার সুযোগ হলেও রাজনীতি বরবাদ হয়ে যায়। দলের অভ্যন্তরীণ বিভক্তি তখন ভাঙনে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।

ডান ও বামের কিছু ছোট দলের নেতাদের এ সমস্যা নেই। ব্যক্তিকেন্দ্রিক এসব দলের নেতারা বরং সরকারের সঙ্গে আপসে নির্বাচনে গিয়ে যদি সংসদে বসতে পারেন, তাহলে দল টেকাতে পারবেন, রাজনীতির মাঠে খেলার পাস পাবেন। রাজপথেও প্রভাব নেই, সংসদেও আসন নেই; এমন অবস্থা তাঁদের জন্য বরং বেশি সংকটের। কিন্তু জামায়াতের মতো দল কয়েকজন নেতার সংসদ সদস্য হওয়ার বিনিময়ে যদি রাজনীতি বিসর্জন দেয়, তবে তাদের আর থাকল কী? যে সরকার তাদের শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধের বিচার করেছে, ফাঁসি দিয়েছে, তাদের কাছ থেকে রাজনীতি চালানোর রেশন কার্ড নেওয়া মানে, সেই আম ও ছালা দুটোই হারানোর দশা।

বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর পারস্পরিক দূরত্ব ও অবিশ্বাসের কারণে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। আবার ক্ষমতাসীন দল তার প্রধান প্রতিপক্ষের বিনাশের রাস্তা নেওয়ার কারণে, প্রতিপক্ষরাও আজ না হোক কাল পাল্টা বিনাশের পথে নেমে পড়বেই। ক্ষমতায় থাকার গায়ের জোরও কমে আসে, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক দুরবস্থার জন্যও ক্ষমতার খুঁটি কমজোরি হতে পারে। এই অবস্থায় ‘বাঁচো ও বাঁচাও’ নীতিই হতে পারে যার যার ভবিষ্যতের গ্যারান্টি।

সুতরাং নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা ছাড়া যে বিরোধী দলই নির্বাচনে যাবে, তারাই সরকারের পুতুল বলে গণ্য হবে। আবার নির্বাচনে না গেলেও তাদের নির্বাচনী আসনের বিরোধী পরিসর ফাঁকা থাকবে না। রাষ্ট্রীয় কলাকৌশল দিয়ে নতুন বিরোধী দল সেখানে খাঁড়া করানো অসম্ভব কিছু নয়। বিশেষত সেই সরকারের পক্ষে, যারা এক যুগ ক্ষমতায় থাকার সুবাদে রাজনৈতিক কারিগরির সব কলকবজা হাত করে নিয়েছে।

যদি বর্তমান অবস্থায় বিএনপিসহ সব প্রকৃত বিরোধী দলের জন্য নির্বাচনে যাওয়া না-যাওয়া—দুটোই ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে কেউ কেউ যাওয়ার পথকেই মন্দের ভালো বলে মনে করতে পারেন। আগেই বলা হয়েছে, বিএনপির জন্য তা হবে আত্মঘাতী। সুতরাং তাদের পক্ষে জিরো সাম গেম, অর্থাৎ হয় তুমি থাকবে, নয়তো আমি থাকব—এমন অবস্থান নেওয়াই যৌক্তিক। আবার আন্দোলনে টিকে থাকতে হলে জামায়াতকে ছাড়াও বিএনপির উপায় নেই। জামায়াতের মধ্যকার মূলধারারও উপায় নেই বিএনপিকে একেবারে পরিত্যাগ করা, যেটা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলে ফেলেছেন। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত কখনো ছিন্ন হবে না। জামায়াতের আমির বলেছেন, তাঁরা যুগপৎ আন্দোলনে থাকবেন। এটি তাঁদের রাজনৈতিক কৌশল। বিএনপি জামায়াতকে কখনো ছাড়তে পারবে না।
আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে আগে অবস্থাটা দাঁড়িয়েছে এমন, সরকারও আর আগের কায়দায়, অর্থাৎ ২০১৪ কি ২০১৮-এর কায়দায় নির্বাচন করতে পারবে না। বিরোধীদেরও আগের মতো করে লড়াই কিংবা আশ্বাসের পথে আস্থা রাখার উপায় নেই। এটা এক সার্বিক উভয়সংকট।

গেম থিওরিতে প্রিজনার্স ডিলেমা বা বন্দীদের দোলাচল বলে একটা কথা আছে। একে বলা যায় বন্দীদের উভয়সংকট। ব্যাপারটা এ রকম: পুলিশ দুই সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করল, যাদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। যদি তারা স্বীকার করে যে অপরাধ করেছে, তবেই তাদের শাস্তি দেওয়া যাবে, নচেৎ নয়। যেহেতু পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই, সেহেতু বিচারে উভয়েরই তিন মাসের কারাদণ্ডের বেশি দেওয়াও যাচ্ছে না। এ অবস্থায় কেউই অভিযোগ স্বীকার না করায় পুলিশ অন্য ফন্দি নিল। তারা দুজনকেই একটা কূটচালে ফেলে দিল। আলাদা করে তাদের বলা হলো, ‘অপরজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলে তুমি বেকসুর খালাস পাবে আর তোমার সঙ্গী পাবে সাত বছরের কারাদণ্ড। তবে একটা শর্ত আছে, যদি দুজনই পরস্পরের বিপক্ষে অভিযোগ করো, তাহলে দুজনেরই কমপক্ষে পাঁচ বছরের জেল হবে।’ এখন তারা কী করবে? বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো অনেকটা এ ধরনের সংকটে পড়েছে।

যদি বিরোধী দলগুলো পরস্পরকে বিশ্বাস করে, তাহলে সবারই ক্ষতি কম হয় এবং ‘পুলিশের ফাঁদ’ এড়ানো যায়। আর যদি অনাস্থাই প্রধান হয়, তাহলে একজন অন্যজনকে দোষী করে নিজের শাস্তি কমাতে চাইবে। এটা তারা তখনই করবে, যখন আলাদা আলাদাভাবে তারা ভাববে যে অন্যজন শাস্তি পেলেও আমি বেঁচে যাব। কিন্তু উভয়ই যেহেতু উভয়কে বিশ্বাস করে না এবং আলাদা কক্ষে বন্দী থাকার জন্য উভয়ের মধ্যে সলাপরামর্শ করারও উপায় নেই, সেহেতু তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে একপাক্ষিকভাবেই। যদি তারা অবিশ্বাস করে, তাহলে পাল্টাপাল্টি অভিযোগের কারণে তারা পাবে পাঁচ বছরের জেল। উভয়ের মঙ্গল একসঙ্গে চিন্তা করলে যেখানে মাত্র তিন মাসের শাস্তি পেত, সেখানে পরস্পরকে ঠকাতে গিয়ে তারা পাবে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর পারস্পরিক দূরত্ব ও অবিশ্বাসের কারণে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। আবার ক্ষমতাসীন দল তার প্রধান প্রতিপক্ষের বিনাশের রাস্তা নেওয়ার কারণে, প্রতিপক্ষরাও আজ না হোক কাল পাল্টা বিনাশের পথে নেমে পড়বেই। ক্ষমতায় থাকার গায়ের জোরও কমে আসে, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক দুরবস্থার জন্যও ক্ষমতার খুঁটি কমজোরি হতে পারে। এই অবস্থায় ‘বাঁচো ও বাঁচাও’ নীতিই হতে পারে যার যার ভবিষ্যতের গ্যারান্টি। বিরোধী দলগুলোর জন্য যেমন ঐক্যই তুলনামূলক সুবিধাজনক, সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে সমঝোতাও তেমনি জিরো সাম গেম থেকে বের হওয়ার পথ।

  • ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও প্রতিচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক
    [email protected]