পরের উপকারে নিজের কল্যাণ

ইসলাম মানবতার ধর্ম। পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহযোগিতা ইসলামের অন্যতম অনুষঙ্গ। রাসুলে করিম (সা.) বলেছেন, সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। ‘মুমিন মিলেমিশে থাকে। তার মধ্যে ভালো কিছু নেই, যে মিলেমিশে থাকতে পারে না। যে ব্যক্তি মানুষের বেশি উপকার করে, সে-ই শ্রেষ্ঠ মানুষ।’ (আল-মুজামুল আওসাত: ৫৭৮৭)

পরোপকার মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্বের অলংকার। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের নির্দেশ দেবে এবং মন্দ কাজে বাধা দেবে।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১১০)

এ বিষয়ে বিশ্বনবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা জগদ্বাসীর প্রতি সদয় হও, তাহলে আসমানের অধিপতি আল্লাহ তাআলা তোমাদের প্রতি সদয় হবেন।’ (তিরমিজি: ১৮৪৭)

পরোপকার মানুষকে মর্যাদার আসনে সমাসীন করে। পৃথিবীর ইতিহাসে যেসব মনীষী স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন পরহিতৈষী। রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রথম ওহিপ্রাপ্তির পর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে হজরত খাদিজা (রা.)–কে বললেন, ‘আমাকে কম্বল দিয়ে জড়িয়ে দাও, আমি আমার জীবনের আশঙ্কা করছি।’

তখন খাদিজা (রা.) নবীজি (সা.)-কে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ কখনোই আপনার অমঙ্গল করবেন না। কারণ, আপনি আল্লাহর সৃষ্টির সেবা করেন, গরিব-দুঃখীর জন্য কাজ করেন, অসহায়-এতিমের ভার বহন করেন, তাদের কল্যাণের জন্য নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।’ (বুখারি: ৪৫৭)

পরোপকারে নিজেরও কল্যাণ সাধিত হয়। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘অবশ্যই দান-সদকা মানুষের হায়াত বৃদ্ধি করে। অপমৃত্যু রোধ করে এবং অহমিকা দূর করে।’ (আল-মুজামুল কাবীর: ১৩৫০৮)

আল–কোরআনে রয়েছে, ‘কে আছে যে আল্লাহকে কর্জে হাসানা উত্তম ঋণ দেবে, তাহলে তিনি তার জন্য একে বর্ধিত করে দেবেন এবং তার জন্য সম্মানজনক প্রতিদানও রয়েছে।’ (সুরা-৫৭ হাদিদ, আয়াত: ১১)

‘আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও তাদের সম্পদ খরিদ করে নিয়েছেন, তাদের জন্য জান্নাত আছে, এর বিনিময়ে।’ (সুরা-৯ তাওবা, আয়াত: ১১১)

‘নিশ্চয়ই দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, যে ক্ষেত্রে তারা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান করে তাদের প্রতিদান বর্ধিত করা হবে এবং তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক প্রতিদান।’ (সুরা-৫৭ হাদিদ, আয়াত: ১৮)

ইসলাম মানুষকে সর্বোচ্চ দয়া, স্নেহ-মমতা, আন্তরিকতা, মানবিক মূল্যবোধ, করুণা, সহমর্মিতা ও সহানুভূতির শিক্ষা দিয়েছে। মহান আল্লাহ তাআলা সহমর্মিতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে প্রেরণ করেছেন।

কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি আপনাকে বিশ্বজগতের জন্য অনুগ্রহস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সুরা-২১ আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭)

‘যারা আল্লাহর পথে নিজেদের ধনসম্পদ ব্যয় করে, কিন্তু রটনা করে না অর্থাৎ দানের কথা প্রচার করে না; আর যাকে দান করেছে তাকে কষ্টও দেয় না, এর প্রতিদান তাদের প্রতিপালকের কাছে আছে; পরকালে তাদের কোনো ভয় থাকবে না এবং তারা চিন্তিতও হবে না।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৬২) 

প্রিয় নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দুনিয়াবি সমস্যাগুলোর একটি সমাধান করে দেয়, আল্লাহ তাআলা তার আখিরাতের সংকটগুলোর একটি মোচন করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবগ্রস্তের অভাব মোচনে সাহায্য করবে, আল্লাহ তাআলাও তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে স্বাচ্ছন্দ্য দান করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ গোপন করবে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন করবেন। আল্লাহ বান্দার সাহায্যে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে।’ (মুসলিম: ২৬৯৯, সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৪৬; তিরমিজি: ১৪২৫; মুসনাদে আহমাদ: ৭৪২৭)

কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘ভালো ও মন্দ সমান হয় না। তুমি মন্দের জবাব দাও ভালোর দ্বারা। তাহলে যার ও তোমার মধ্যে শত্রুতা ছিল, সহসাই সে হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু।’ (সুরা-৪১, হা–মিম সাজদাহ-ফুসসিলাত: ৩৪)

হজরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আমি যেকোনো ব্যক্তির উপকার করেছি। পরে দেখা গেছে তার ও আমার মধ্যে এক স্নিগ্ধময় সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে গেছে। আর যার প্রতি কখনো আমার দ্বারা মন্দ ব্যবহার হয়ে গেছে, পরে দেখতে পেয়েছি—তার ও আমার মধ্যে সম্পর্কে মলিনতা সৃষ্টি হয়েছে।’ (উয়ুনুল আখবার, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ১৭৭)

উপকৃত ব্যক্তির কর্তব্য উপকারকারীর কাছে কৃতজ্ঞ থাকা বাঞ্ছনীয়। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি তোমাদের কোনো উপকার করে, তোমরা তার বদলা দিয়ো। যদি বদলা দেওয়ার মতো কিছু না পাও, তার জন্য দোয়া করো।’ (সুনানে আবু দাউদ: ১৬৭২; সুনানে নাসায়ি: ২৫৬৭; সহিহ ইবনে হিব্বান: ৩৪০৮)

  • মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

    যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

    [email protected]