এটাও দেখেছেন, ওটাও দেখেছেন, শান্তি শুধু...?

‘ধানমন্ডি গিয়েও দেখেছি, মোহাম্মদপুর গিয়েও দেখেছি, শান্তি শুধু মিরপুরে’; ‘প্যান্ট পিন্দাও দেখছি, পায়জামা পিন্দাও দ্যাখলাম, শান্তি খালি লুঙ্গিতে’; ‘প্রেম করেও দেখেছি, বিয়ে করেও দেখেছি, শান্তি শুধু সিংগেল থাকাতে’; ‘দাবড়ানি দিয়েও দেখেছি, দাবড়ানি খেয়েও দেখেছি, শান্তি শুধু দর্শক হয়ে দাবড়ানি দেখাতে, ’ ‘সরকারি দল করেও দেখেছি, বিরোধী দল করেও দেখেছি, শান্তি শুধু কিংস পার্টিতে’।

গত চার–পাঁচ দিন ফেসবুকে এই ধরনের শান্তি বিষয়ক নানান কিসিমের পোস্টে নিউজফিড সয়লাব হয়ে গেছে। যার যাতে শান্তি সে তা ফেসবুকে উগরে দিচ্ছে।

আরও পড়ুন

ইন্টারনেটের উইন্ডো খোলার সঙ্গে সঙ্গে ভার্চুয়াল জানালা দিয়ে মারাত্মক শান্তির বাতাস শো শো করে মনের কামরায় ঢুকে লাফালাফি দাপাদাপি করছে। সেই দাপানি মনের এক কক্ষবিশিষ্ট ফ্ল্যাটের মধ্যে একেবারে বিতিকিচ্ছি ল্যাপ্টালেপ্টি অবস্থা করে ফেলছে।

কয়দিন আগেও যাকে ‘শান্তির মা মইরা গেছে রে!’ বলে আছাড়িপিছাড়ি মার্কা হাহাকারবিশিষ্ট র‍িয়াক্ট দিয়ে স্ট্যাটাস দিতে দেখা গেছে, সে লোকও এখন স্ট্যাটাস দিচ্ছে, ‘সুচিত্রা সেন দেখেছি, মুনমুন সেন দেখেছি, রাইমা সেনও দেখেছি, আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছে খালি বনলতা সেন’।

অর্থাৎ শান্তির মায়ের মৃত্যু শোক কাটিয়ে আঁতকা প্রবল শান্তিতে বলশালী হওয়া লোকটা ‘ও টুনির মা, তোমার টুনি কথা শোনে না’ টাইপের গানবাজনায় তাল মেলাচ্ছে। ফলে ফেসবুকের লুকটাই বদলে গেছে। সবার নিউজফিডে ‘ওম শান্তি! ওম শান্তি!’ টাইপের একটা পরিবেশ নেমে এসেছে।

আপনারা খেয়াল করেছেন কিনা জানি না, পাবলিক শান্তি ঠিকই পাচ্ছে; কিন্তু প্রথম ‘চান্সে’ পাচ্ছে না। দুই তিন জায়গায় ঠ্যালা-গুঁতো খেয়ে তারপর কোনো এক জায়গায় তারা শান্তি আবিষ্কার করছে।

আরও পড়ুন

এদের মধ্যে কেউ হয়তো প্রথমে ধানমন্ডি গিয়ে ঠ্যালা খেয়েছে, তারপর মোহাম্মদপুরে গিয়ে গুঁতো খেয়েছে, ফাইনালি মিরপুরে গিয়ে ‘শান্তি’ পেয়েছে। কেউ আবার প্রথমে টাইট ফিটিং প্যান্ট ‘পিন্দা’ দম আটকানো শরমিন্দা অবস্থায় পড়েছে, তারপর পায়জামা ‘পিন্দাও’ আরাম পায়নি, অবশেষে লুঙ্গি পরে শান্তির চোটে লুঙ্গি ড্যান্স দিয়েছে। কেউ হয়তো প্রথমে প্রেম করে সুখ পায়নি, পরে বিয়ে করে অসুখ-বিসুখ বাঁধিয়েছে, অ্যাট লাস্ট বাই ফোর্স ডাইভোর্সড হয়ে এখন সিংগেল খাটে বসে শান্তিপুরী বাংলায় শান্তির বাণী ঝাড়ছে।

অর্থাৎ ফার্স্ট চান্সে কেউ শান্তি পাচ্ছে না। দুই চার ঘাট ঘুরে ফিরে, সেগুলোরই কোনো এক ঘাটে শান্তির নৌকা বাঁধতে হচ্ছে।

মনে হলো, মনের মধ্যে আয়মান সুখন মার্কা মোটিভেশনাল স্পিকারের মতো যাত্রাপালার কোনো এক বিবেক এসে বললেন, ‘শান্তি একটা আপেক্ষিক জিনিস রে পাগলা! অ্যাবসলিউট শান্তি বলে কিছু নাই। পরম শান্তি বলে কিছু নাই।’
বিবেক ভদ্রলোককে বললাম, ‘মুরব্বি, বুঝলাম না, জিনিসটা আরেকটু ভাঙ্গায় কনতো দেখি।’

আমার এক ফেসবুক বন্ধু স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ‘হাতিরপুল কাঁচাবাজার দেখেছি, এজিবি কলোনির বাজার দেখেছি, শান্তি শুধু কারওয়ানবাজারে।’

কমেন্টের ঘরে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভাই, কারওয়ানবাজারে কোন কায়দায় শান্তি পাইছেন?’

সেই বন্ধু তখন ইনবক্সে লিখেছেন, ‘ভরা মৌসুমে যে সবজির দাম কেজি প্রতি বড় জোর ৩০ টাকা হওয়ার কথা, সেই সবজি এখন হাতিরপুলে ৮০ টাকা, এজিবি কলোনি বাজারে ৯০ টাকা আর কারওয়ানবাজারে ৭০ টাকা। তাইলে কারওয়ানবাজারে শান্তি না পাইয়া উপায় আছে?’

ভেবে দেখলাম, কথা সত্য।

মনে হলো, মনের মধ্যে আয়মান সুখন মার্কা মোটিভেশনাল স্পিকারের মতো যাত্রাপালার কোনো এক বিবেক এসে বললেন, ‘শান্তি একটা আপেক্ষিক জিনিস রে পাগলা! অ্যাবসলিউট শান্তি বলে কিছু নাই। পরম শান্তি বলে কিছু নাই।’
বিবেক ভদ্রলোককে বললাম, ‘মুরব্বি, বুঝলাম না, জিনিসটা আরেকটু ভাঙ্গায় কনতো দেখি।’

বিবেক বললেন, ‘রি-রোলিং মিলে, মানে লোহা গলায়ে রড বানানোর কারখানায় যখন কেউ কাজ করে তখন গনগনে গরমে তার সারা গায়ে ঘাম ঝরে। সে ছটফট করে। গা-গতর আগুন বরাবর গরম হয়ে ওঠে। সেই লোক কারখানা থেকে বের হয়ে বৈশাখের কাঠ ফাটা রোদের মধ্যেও এসে দাঁড়ালে শান্তি পায়। ঠা ঠা রোদের তাপ তখন তার কাছে পৌষালি সকালে রোদ পোহানো তাপের মতো লাগে। সে তখন শান্তি পায়। আবার সেই রোদের মধ্যে অন্য কোনো লোক হাঁসফাঁস করে। সেই অন্য কোনো লোকটা রোদ থেকে সরে গিয়ে গাছের ছায়ায় দাঁড়ালে শান্তি পায়। আসলে একেকজনের শান্তি একেকখানে; আর পাগলের শান্তি মনে মনে।’

বিবেক ভদ্রলোকের কথায় ধাক্কা খেলাম। ‘পাগলের শান্তি মনে মনে’ কথাটা কি উনি আমাকে বললেন? নাকি উনি হঠাৎ করেই হরেদরে ‘শান্তি’ পাওয়া নেটিজেন ভাইবোনদের পাগল ঠাওরালেন?

দেশে কত রকমের অনিয়ম, সমস্যা, অশান্তি; বিদেশে যুদ্ধে কত লোক বেঘোরে মারা পড়ছে। এসব কাউকে কি ছুঁচ্ছে না? সবাই কি ‘মনে মনে সুখ’ নিচ্ছে? সব কি তারা মনে নিচ্ছে? নাকি মেনে নিচ্ছে? নাকি সবাই কোনটা মিষ্টি আর কোনটা তিতা, তা বোঝার বোধশক্তি হারিয়ে ফেলছে?

ফেসবুকের এই ট্রেন্ড দেখছি আর মনে মনে গাইছি সেই মরমি সংগীত—‘পাগল তিতা-মিঠা বোঝে না, পাগলারে জিলাপি দিয়ো না।’

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    [email protected]