সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রয়োজন স্বাধীন তহবিল

প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় বহু মানুষ হতাহত হচ্ছেন
ফাইল ছবি

আমাদের যাতায়াতের প্রধানতম মাধ্যম সড়ক পরিবহন এখন পর্যন্ত যথেষ্ট মাত্রায় নিরাপদ হয়ে ওঠেনি। ফলে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় বহু মানুষ হতাহত হচ্ছেন। এসব দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকাংশই দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ এবং প্রায় ক্ষেত্রেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এই উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুর কারণে আয়রোজগার বন্ধ হয়ে এবং দুর্ঘটনায় আহত সদস্যকে সহায়–সম্পদ বিক্রি করে চিকিৎসা করতে গিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সর্বস্বান্ত হচ্ছে। চিকিৎসার পরও যাঁরা পঙ্গু হচ্ছেন, তাঁদের অবস্থা আরও করুণ! এভাবেই সড়ক দুর্ঘটনার কারণে অসংখ্য পরিবার সামাজিক অর্থনীতির মূল স্রোত থেকে হারিয়ে বিপন্ন হয়ে পড়ছে।

উল্লেখ্য, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিকে গোল্ডেন আওয়ারের মধ্যে উপযুক্ত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হলে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের হার কমানো সম্ভব। দুর্ঘটনা–পরবর্তী ছয় ঘণ্টা হলো গোল্ডেন আওয়ার। কিন্তু দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ব্যক্তিদের অধিকাংশই এই সময়ের মধ্যে উপযুক্ত চিকিৎসা পান না। এর কারণ তাঁদের আর্থিক সংকট এবং জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসা–সুবিধা না থাকা। জেলা সদর হাসপাতালগুলো গুরুতর আহত ব্যক্তিদের হামেশা ঢাকায় পাঠানো হয়। এ অবস্থায় অধিকাংশ রোগী অর্থের অভাবে তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকায় চিকিৎসা করাতে পারেন না। সহায়-সম্বল বিক্রি করে, ধারদেনা করে ঢাকার আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি হতে অনেক দেরি হয়ে যায়। ফলে রোগী গোল্ডেন আওয়ারের সুবিধাটা আর পান না।

নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের সুবিধাও সব সময় পাওয়া যায় না। ফলে মানুষের মৃত্যু ঘটে। চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল ফেনী সদর উপজেলায় ৩৮ বছর বয়সী হতদরিদ্র বিদ্যুৎমিস্ত্রি মো. শাহিন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। তাঁর স্বজনেরা চাঁদা তুলে তাঁকে ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে আইসিইউ সুবিধার জন্য তাঁরা তাঁকে প্রথমে অ্যাম্বুলেন্সে চট্টগ্রামে এবং পরে ঢাকায় নিয়ে আসেন। দুই দিন ঘুরেও কোনো সরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে একটি শয্যা পাননি তাঁরা। একরকম পথে ঘুরতে ঘুরতেই শাহিনের মৃত্যু হয়।

আমাদের দেশে মোটরযান অধ্যাদেশ আইন-১৯৮৩–তে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য সব ধরনের মোটরযানে তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকিবিমা বাধ্যতামূলক ছিল। এর আওতায় বিমাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিটি মোটরযান থেকে ঝুঁকিবিমার কিস্তি (প্রিমিয়াম) নিয়েছে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কেউ সেই ঝুঁকিবিমা থেকে ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন, এমন নজির পাওয়া যায় না। এই আইনে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালত ছিল ‘ক্লেইম ট্রাইব্যুনাল’। কিন্তু এই ট্রাইব্যুনালে ক্ষতিপূরণের জন্য কেউ মামলা করেছেন, এমন নজিরও তেমন নেই। কারণ, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা জানতেই পারেননি, তাঁদের জন্য আইনি প্রতিষ্ঠান আছে। রাষ্ট্রও এ নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে সাধারণ মানুষকে জানানোর চেষ্টা করেনি। অথচ মোটরযানে তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকিবিমা না থাকলে পুলিশ মামলা করেছে।

সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে, বিমা কোম্পানিগুলো লম্বা সময় ধরে যে কিস্তি নিল, সেই টাকা তো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা পেলেন না। তাহলে এই বিমার টাকা গেল কোথায়? কারা নিল? মূলত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিমা কোম্পানিগুলোকে এই প্রতারণা করার অনৈতিক সুবিধা দিয়েছে।

যেহেতু আগের আইনে তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকিবিমার মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা বিমাসুবিধা পাননি, তাই সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮–তে মোটরযানের তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকিবিমা উঠিয়ে দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য ‘ট্রাস্ট ফান্ড’–এর বিধান রাখা হয়েছে। ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর বিধি তৈরির মাধ্যমে এই ট্রাস্ট ফান্ড আইন হিসেবে কার্যকর হয়েছে। এই ফান্ডের মাধ্যমে ২২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করবেন।

যেকোনো মূল্যে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাহলে ফান্ডের অর্থের চাহিদা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকবে। উল্লিখিত স্বাধীন তহবিলকে জনবান্ধব করার জন্য এর গঠনকাঠামো ও পরিচালনাপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই এই ফান্ডের প্রয়োজনীয়তা এড়িয়ে যাওয়া উচিত হবে না। কারণ, সড়ক দুর্ঘটনার অভিঘাতে সাধারণ মানুষ চরম বিপর্যয়ে আছেন।

এই ট্রাস্ট ফান্ডের গঠন কাঠামোতে বিআরটিএর চেয়ারম্যানকে প্রধান করে ১২ সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিচালনা বোর্ড থাকবে। তিন মাস অন্তর বোর্ডের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থের উৎস হিসেবে বলা হয়েছে, প্রতিবছর বাস-ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, মোটরসাইকেল থেকে ১ হাজার টাকা, মিনিবাস-পিকআপ ভ্যান থেকে ৭৫০ টাকা, প্রাইভেট কার-জিপ থেকে ৫০০ টাকা এবং থ্রি-হুইলার থেকে ৩৫০ টাকা নেওয়া হবে। এ ছাড়া মোটরযানের রেজিস্ট্রেশন ফি, নবায়ন ফি, বিভিন্ন প্রকার চাঁদা ও অনুদান হবে এই তহবিলের উৎস। ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়া হবে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে পাঁচ লাখ টাকা, অঙ্গহানি হলে তিন লাখ টাকা এবং সুস্থ জীবনে ফেরার সম্ভাবনা না থাকলে এক লাখ টাকা। ক্ষতিপূরণ পেতে হলে দুর্ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে ট্রাস্টি বোর্ড বরাবর আবেদন করতে হবে। আবেদনপ্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন। প্রতিবেদন জমা হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে আবেদন মঞ্জুরপূর্বক ব্যাংক চেকের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদান করা হবে।

ট্রাস্ট ফান্ডের যে সাংগঠনিক কাঠামো ও ব্যবস্থাপনা, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ এবং প্রদানের যে পদ্ধতি, তাতে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের পক্ষে এই ফান্ড থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়া সময়সাপেক্ষ ও দুরূহ। ট্রাস্ট ফান্ড থেকে সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি হতে পারে। আবেদন করা, পুলিশি তদন্ত ও প্রতিবেদন জমা হওয়া, এরপর যাচাই-বাছাই ইত্যাদি করতেই অনেক সময় কেটে যাবে। উল্লিখিত সময়ের মধ্যে কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন না হওয়ার আশঙ্কা আছে।

কারণ, আমাদের দেশের কোনো দপ্তরেই নিয়ম অনুযায়ী কাজ হয় না। পুলিশি তদন্তে নানা প্রকার সমস্যা তৈরি হতে পারে। ধরুন, দিনাজপুরের একজন দরিদ্র মানুষ কুমিল্লায় দুর্ঘটনায় নিহত হলেন। এখানে পুলিশকে দুই জায়গায় তদন্ত করতে হবে। দুর্ঘটনার স্থান, সময়, দুর্ঘটনার কারণ, আক্রান্তের স্থায়ী ঠিকানা এবং ওয়ারিশ—এসব বিষয়ে ব্যাপক জটিলতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অথচ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের সর্বাগ্রে প্রয়োজন চিকিৎসা। এ জন্য তাৎক্ষণিক অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু এই ট্রাস্ট ফান্ড তাৎক্ষণিক তো নয়ই, তিন মাসের মধ্যেও চিকিৎসাসেবায় কোনো প্রকার অবদান রাখতে পারবে না।

এই বাস্তবতায় সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য স্বাধীন তহবিল (ইনডিপেনডেন্ট ফান্ড) গঠনের বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। একটি দুর্ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায় এভাবে—প্রত্যন্ত গ্রামের একটি দরিদ্র পরিবারের সদস্য সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন। স্থানীয় বা জেলা সদরের হাসপাতাল তাঁকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পরিবারটির হাতে কোনো টাকা নেই। টাকা জোগাড় করতে হলে ভিটেবাড়ি বিক্রি করতে হবে। এ অবস্থায় পরিবারটি কী করবে? কোথায় পাবে অ্যাম্বুলেন্সভাড়াসহ চিকিৎসার খরচ? এ ক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ফ্রি করা যেতে পারে সহজেই।

এ জন্য সড়ক পরিবহন আইনে বিদ্যমান ‘ট্রাস্ট ফান্ড’–এর পরিবর্তে ‘স্বতন্ত্র তহবিল’ তৈরি করতে হবে। এই তহবিলে প্রতিবছর সর্বোচ্চ তিন হাজার কোটি টাকা হলেই দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত সবার চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সম্ভব। যেসব উৎস থেকে ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থ সংগ্রহ করা হবে, সেসব উৎসসহ পুলিশ মোটরযান থেকে যে জরিমানা আদায় করে, তার একটি অংশ এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের যে সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল রয়েছে, সেখান থেকে এই পরিমাণ অর্থ খুব সহজেই সংগ্রহ করা সম্ভব।

তহবিল গঠিত হলে সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে আহত রোগীকে উপযুক্ত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে ব্যক্তিগত অর্থ ছাড়াই। রোগীকে একটি মেডিকেল কোড নম্বরে চিহ্নিত করে উপযুক্ত যেকোনো হাসপাতাল তার চিকিৎসা শুরু করবে। পরবর্তী সময়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর চিকিৎসা খরচ তহবিল থেকে গ্রহণ করবে। এই কার্যক্রম যথাযথ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতিমুক্তভাবে বাস্তবায়নের জন্য একটি শক্তিশালী বহুপক্ষীয় কেন্দ্রীয় কমিটি থাকতে হবে। প্রশাসন, পুলিশ, চিকিৎসক, সড়ক নিরাপত্তাবিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি, সড়ক নিরাপত্তায় কাজ করা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা এ কমিটির সদস্য হতে পারেন।

কমিটির একই ধরনের সাংগঠনিক কাঠামো জেলা-উপজেলা পর্যায়েও থাকতে হবে। কমিটির সদস্যসংখ্যা বেশি হলে সহজে দুর্নীতি করা যায় না। এতে করে সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তি ও পরিবার সহজে চিকিৎসাসেবা ও ক্ষতিপূরণ পাবে। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য সব জেলা সদর হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিশেষ করে নিউরোসার্জারি বিভাগ উন্নত করতে হবে। কারণ, সড়ক দুর্ঘটনায় মস্তিষ্কে আঘাতের ঘটনা বেশি ঘটে। এই আঘাত থেকে মৃত্যুও হয়।

এসব বিবেচনায় সড়ক পরিবহন আইনে বিদ্যমান ট্রাস্ট ফান্ডের পরিবর্তে স্বাধীন তহবিল গঠন করা জরুরি। একই সঙ্গে মোটরযানে ‘তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকিবিমা’ পুনঃপ্রবর্তন করতে হবে। প্রয়োজনে কিস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য বিমাসুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। যেকোনো মূল্যে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাহলে ফান্ডের অর্থের চাহিদা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকবে। উল্লিখিত স্বাধীন তহবিলকে জনবান্ধব করার জন্য এর গঠনকাঠামো ও পরিচালনাপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই এই ফান্ডের প্রয়োজনীয়তা এড়িয়ে যাওয়া উচিত হবে না। কারণ, সড়ক দুর্ঘটনার অভিঘাতে সাধারণ মানুষ চরম বিপর্যয়ে আছেন।

সাইদুর রহমান নির্বাহী পরিচালক, রোড সেফটি ফাউন্ডেশন