বলসোনারোর সমর্থকেরা তখন হয়তো ভেবে নিয়েছিলেন, যে পুলিশ সদস্যরা তাঁদের কর্ডন করে নিয়ে এসেছেন, তাঁরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন, যাতে করে ‘নির্বাচনী জালিয়াতির’ কারণে দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হওয়া থেকে বঞ্চিত তাঁদের নেতা বলসোনারোকে ক্ষমতায় বসানো যায়। তাঁদের ধারণা ছিল ‘বামপন্থী একনায়কতন্ত্র’ উৎখাতে পুলিশ সহযোগিতা করবে।

কিন্তু বলসোনারো সমর্থকদের সেই আশা হতাশায় পরিণত হতে কয়েক মিনিটের বেশি সময় লাগেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের ন্যাশনাল ফোর্সের একই সদস্যরা বলসোনারোর সমর্থকদের আছড়ে ফেলতে শুরু করে এবং ঠেলতে ঠেলতে তাদের পুলিশের গাড়িতে ওঠায়। সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এক হাজারের বেশি আন্দোলনকারীকে। বলসোনারো সমর্থকদের ‘বিদ্রোহের’ প্রথম পর্বটি সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নয় বরং কাতরানি-গোঙানির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে।

সরকারি স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণভাবে দখলে নেওয়ার উদ্দেশ্য থেকে বলসোনারোপন্থীরা রোববারের ঘটনা ঘটালেও শেষ পর্যন্ত তা তর্জন-গর্জন ছাড়া কিছু হয়নি। স্থাপনাগুলোর জানালার কাচ ভেঙে ফেলা, আধুনিক শিল্পকর্মগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া, আসবাব ও ইলেকট্রনিক পাখা ভেঙে ফেলার মতো ঘটনা ঘটলেও শেষ পর্যন্ত এটিকে প্রথম ধাপের বিদ্রোহের মর্যাদা দেওয়া যায় না। রোববারের এ হামলার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ কি? স্বল্প মেয়াদে লুলা দা সিলভার অবস্থান শক্তিশালী হবে।

এ আন্দোলনের প্রাথমিক ফলাফল অতিডানপন্থীদের কাছে হতাশাজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এখন তাঁদের জন্য দুঃসময়। নেতা বলসোনারো নিজেও তাঁদের জন্য খুব বেশি অনুপ্রেরণা জোগাতে পারছেন না। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে খুব কম ব্যবধানে হেরে যাওয়ার পর গম্ভীর আর প্রায় নিশ্চুপ হয়ে পড়েছেন তিনি। সেনাবাহিনীর সাবেক এই ক্যাপ্টেন দেশও ছেড়েছেন। রাজনৈতিক যে দায়মুক্তি তিনি একসময় উপভোগ করতেন, তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দেখে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় চলে যান। কৃতকর্মের জন্য আইনের আওতায় আনা হবে এ ভয়েই তিনি ফ্লোরিডার মতো রংক্ষণশীলদের ঘাঁটিতে (কিউবা কিংবা লাতিন আমেরিকার অন্য কোনো দেশে কমিউনিস্টবিরোধী অবস্থান সেখানে প্রবল) আস্তানা গেড়েছেন।

যে সেনাবাহিনীর প্রশংসায় বলসোনারোর সমর্থকেরা এত উচ্ছ্বসিত ছিলেন, আন্দোলনের সময় তাঁরা কোনো সাড়া দেয়নি। অথচ দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে সেনা ব্যারাকগুলোর কাছে অস্থায়ী শিবির গড়ে হাজার হাজার আন্দোলনকারী ধরনা দিয়ে পড়ে আছেন। আর সেনা হস্তক্ষেপের যে দাবি তাঁরা করে আসছিলেন এ দফায় তা শেষ পর্যন্ত বৃথা গেল। ইতিমধ্যে শিবির ছেড়ে অনেকে চলে গেছেন। যাঁরা থেকে গেছেন, তাঁদের মাথায় নানা ধরনের ষড়যন্ত্র কল্পনা উড়ছে। তাঁদের কেউ কেউ আবার দিবাস্বপ্নে মশগুল যে জেনারেল আগস্তো হেলেনো (সম্ভবত বলসোনারোর সবচেয়ে কট্টর সমর্থক) এরই মধ্যে পর্দার আড়ালে তার ক্ষমতার চর্চা শুরু করে দিয়েছেন এবং নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভাকে গদিচ্যুত করে ফেলেছেন।

কিন্তু বাস্তব জগতে এরই মধ্যে লুলা দা সিলভা অনড় অবস্থানে থেকে সরকার গঠন করে ফেলেছেন। এ জন্য তিনি নির্দলীয় আইনপ্রণেতা ও মধ্যডানপন্থীদের সঙ্গে জোট গড়ে নিয়েছেন। ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতি অনুগত আইনপ্রণেতারা মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পেয়েছেন। কিন্তু রক্ষণশীল দলগুলো থেকেও বেশ কয়েকজন মন্ত্রী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে এমন কয়েকজন আছেন, যাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহও আছে।

বলসোনারোর আমলে নেওয়া বেশ কিছু বিধ্বংসী পদক্ষেপ এরই মধ্যে বাতিল করেছেন লুলা। উদাহরণস্বরূপ অস্ত্র ব্যবহারের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছেন তিনি।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম সপ্তাহেই লুলা ব্রাজিলের রাজধানীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য রাজ্য সরকারের হাত থেকে পুলিশের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নিয়ে নিয়েছেন। ওয়াশিংটনের মতো ব্রাসিলিয়া ফেডারেল জেলা হলেও অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা পায়। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সরকারি স্থাপনা রক্ষার কাজে প্রাথমিকভাবে যে পুলিশ নিয়োগ করেছিল, তারা হামলাকারীদের বাধা দিতে ব্যর্থ হয়। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ব্রাসিলিয়ার গভর্নর ও নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে (যিনি বলসোনারো সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন) বহিষ্কার করা হয়।

ব্রাজিলের রাজনৈতিক নাটকীয়তা এখানেই শেষ হচ্ছে, তা বলা যাচ্ছে না। বলসোনারো কুখ্যাত সমর্থক হিসেবে পরিচিত লরিচালকেরা যদি সত্যি সত্যিই সড়ক ও তেল পরিশোধনাগার (তাতে শহরগুলোয় জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে) অবরোধ শুরু করে তাহলে এ সপ্তাহেই ‘বিদ্রোহের দ্বিতীয় ঢেউ’ শুরু হয়ে যাবে। নির্বাচনের সময় মালবাহী ট্রাকগুলো কয়েক সপ্তাহ ধরে সড়কে ফেলে রাখা হয়েছিল। আদালতের আদেশের পরও ধীরে ধীরে অবরোধ প্রত্যাহার করেছিলেন চালকেরা। রোববার রাতেই বেশ কয়েকটি রাজ্যে সড়ক অবরোধের খবর এসেছে। বলসোনারোপন্থীদের ওয়েবসাইটগুলো বিদ্রোহের তৃতীয় ঢেউয়ের হুমকিও দিয়েছে। এটা খুব সাধারণ একটা ধারণা যে বিশৃঙ্খল অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সামরিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

সরকারি স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণভাবে দখলে নেওয়ার উদ্দেশ্য থেকে বলসোনারোপন্থীরা রোববারের ঘটনা ঘটালেও শেষ পর্যন্ত তা তর্জন-গর্জন ছাড়া কিছু হয়নি। স্থাপনাগুলোর জানালার কাচ ভেঙে ফেলা, আধুনিক শিল্পকর্মগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া, আসবাব ও ইলেকট্রনিক পাখা ভেঙে ফেলার মতো ঘটনা ঘটলেও শেষ পর্যন্ত এটিকে প্রথম ধাপের বিদ্রোহের মর্যাদা দেওয়া যায় না। রোববারের এ হামলার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ কি? স্বল্প মেয়াদে লুলা দা সিলভার অবস্থান শক্তিশালী হবে। মধ্যপন্থী রক্ষণশীলেরা রোববারের ঘটনায় খুব দ্রুত নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু তাঁরাও কিন্তু সরকার বিরোধী নেতা। প্রকৃতপক্ষে ব্রাজিলের অতিডানপন্থীদের মধ্যেও হ্যামিল্টন মুহায়োর মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বেশ কয়েকজন নেতা রয়েছেন। রাজনীতির মাঠে দীর্ঘ খেলার সক্ষমতা তাঁদের রয়েছে।

সম্প্রতিক বছরগুলোয় ব্রাজিলে সামাজিক রক্ষণশীলতা জনপ্রিয় করার পেছনে তাঁদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এর বড় দৃষ্টান্ত হলো, ব্রাজিলের সমাজে ইভ্যানজেলিক্যাল প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি। অক্টোবরের নির্বাচনে ২০১৮ সালের তুলনায় আইনসভায় ডানপন্থীদের প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে। ফ্লোরিডায় শ্রুশ্রূষাধীন বলসোনারো ছাড়াই তাঁরা রাজনৈতিক সংকটকে পুঁজি করতে দুবারও ভাববে না।

  • রিচার্ড ল্যাপার বিফ, বাইবেল অ্যান্ড বুলেটস: ব্রাজিল ইন দ্য এজ অব বলসোনারো বইয়ের লেখক
    দা গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে