যে কারণে এরদোয়ান জিতলেও হারতে বাধ্য

এরদোয়ান নির্বাচনে হেরে গেলে কোনোরকম ঝামেলা না করেই বিদায় হবেন, তা বিশ্বাস করা কঠিন
ছবি : রয়টার্স

তুরস্কে আগামী ১৪ মে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনে উতরে যাওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আগাম জরিপে তিনি পিছিয়ে আছেন। জনসমর্থনে তাঁর পিছিয়ে থাকার পেছনে মূলত তিনটি কারণ কাজ করছে।

প্রথম কারণ হলো এরদোয়ান রাজনৈতিক সমর্থন অথবা তাঁর শাসনের বিরুদ্ধে মুখ না খোলার বিনিময়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও ঊর্ধ্বমুখী গতিশীলতার যে প্রতিশ্রুতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলেন, তার ওপর আর তিনি ভরসা করতে পারছেন না। বিগত ২০ বছরের ক্ষমতাকালের বেশির ভাগ সময় এই হাতিয়ার তাঁকে মনোবল জুগিয়েছে।

কিন্তু এখন এটি এমনভাবে ভেঙে গেছে, যা একেবারেই সারাইয়ের অতীত। এরদোয়ানের একগুঁয়ে এবং গোপনীয় মুদ্রানীতি তুরস্কের অর্থনীতিকে ভঙ্গুর করে দিয়েছে এবং গোটা দেশকে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতিতে ভোগাচ্ছে। গত কয়েক বছরে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য ও আয়বৈষম্য সাধারণের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অর্থনীতির মন্দাবস্থার এই খবরেই এরদোয়ানের দুঃসংবাদের সমাপ্তি হচ্ছে না।

আরও পড়ুন

দ্বিতীয় এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো তুরস্কের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বরাবরই দুর্বল ও নানা দলে বিভক্ত বিরোধী দলগুলো এরদোয়ানের বিরুদ্ধে এবার একজোট হয়েছে। সামাজিক-গণতন্ত্রী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির নেতা কেমাল কিলিচদারোগলু এই নির্বাচনে এরদোয়ানের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়েছেন। কুর্দি রাজনৈতিক আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট হয়ে বিরোধী ছয়টি দল এক হয়ে নেশন অ্যালায়েন্স নামে যে জোট গঠন করেছে, তিনি সেই জোটের প্রার্থী। জরিপে কিলিচদারোগলু জনপ্রিয়তায় এরদোয়ানের চেয়ে এগিয়ে আছেন যদিও তাঁদের ব্যবধান খুবই সামান্য।

শেষ কারণ হলো গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কে ঘটে যাওয়া মহাভূমিকম্প, যাতে অর্ধলক্ষের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এরদোয়ানের এক ব্যক্তির শাসনে প্রতিষ্ঠানগুলোর পেশাদারি ও দক্ষতা যে কোন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তা এই দুর্যোগ প্রকাশ করে দিয়েছে। ভূমিকম্পের পরপরই ক্ষতিগ্রস্ত লাখ লাখ মানুষের পাশে দাঁড়াতে এরদোয়ান সরকার ব্যর্থ হয়েছে। স্বজনতোষণের ভারে আক্রান্ত অযোগ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি সংস্থাগুলো শুধু নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা ও উদ্ধারকাজ চালাতেই ব্যর্থ হয়নি, দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ ব্যবস্থাপনায়ও তারা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

তুরস্কের গণতন্ত্রের পরিপক্বতা নিয়ে সন্দিহান অনেক পশ্চিমা পর্যবেক্ষকের মতো তুর্কি জনগণেরও একটা অংশ মনে করে, এরদোয়ান নির্বাচনে হেরে গেলে কোনো ধরনের ঝামেলা না করেই বিদায় হবেন, তা বিশ্বাস করা কঠিন। অনেকের বিশ্বাস, তুরস্ককে নির্জলা স্বৈরশাসনে পতিত হওয়া থেকে বাঁচানোর এটিই সর্বশেষ সুযোগ।

স্বাভাবিক ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এই বিষয়গুলোই ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) পরাজয়ের বড় কারণ হতে পারে। তবে কথা হলো, এরদোয়ানের তুরস্কে এখন আর অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন হয় না। সেখানকার সরকার বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম ও বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দুই পর্বে ভোট হয়ে থাকে।

দুটি পর্বেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রথম পর্বের ভোটে যদি কিলিচদারোগলু ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পান, তাহলে তাঁকে অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত আরেক রাজনীতিক মুহাররেম ইনচের সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হবে না। তরুণদের মধ্যে সরকারবিরোধিতার উন্মাদনা ছড়িয়ে হঠাৎ জনপ্রিয় হওয়া মুহাররেম বর্তমান সরকার এবং বিরোধী জোট—উভয়েরই কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। জরিপে দেখা গেছে, তিনি ৫ থেকে ৭ শতাংশ ভোট পেতে পারেন। এ অবস্থায় গোটা তুরস্কবাসী বড় বিভক্তির মধ্যে পড়ে গেছে। জনগণের একটি বিরাট অংশ পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত। অন্যদিকে একটি অংশ এরদোয়ানের ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন ও বিচলিত।

আরও পড়ুন

তুরস্কের গণতন্ত্রের পরিপক্বতা নিয়ে সন্দিহান অনেক পশ্চিমা পর্যবেক্ষকের মতো তুর্কি জনগণেরও একটা অংশ মনে করে, এরদোয়ান নির্বাচনে হেরে গেলে কোনো ধরনের ঝামেলা না করেই বিদায় হবেন, তা বিশ্বাস করা কঠিন। অনেকের বিশ্বাস, তুরস্ককে নির্জলা স্বৈরশাসনে পতিত হওয়া থেকে বাঁচানোর এটিই সর্বশেষ সুযোগ।

তবে এটি সত্য, তুরস্কে কর্তৃত্ববাদী শাসন থাকলেও তা রাশিয়া বা চীনের মতো শাসন নয়। সেখানে এখনও জনগণের রুখে দাঁড়ানোর অবস্থা কিছুটা হলেও অবশিষ্ট আছে। এ কারণে এরদোয়ান অনুদার শক্তিমান শাসক হলেও তুরস্কের মানুষ যদি তাঁর ভয়ে গুটিয়ে না গিয়ে থাকে তাহলে আগামী নির্বাচন তাঁর নিয়তি নির্ধারক হতে পারে।

নির্বাচনে যদি তিনি জিতেও যান, তাহলেও বিরোধীদের শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে কারসাজিমুক্ত রাখতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে বিরোধীরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন। তুরস্কে গণতন্ত্রের ধারা ধরে রাখতে পারলে এরদোয়ান ভোটে জেতার পরও সে জয়কে দীর্ঘ মেয়াদে ধরে রাখতে পারবেন না।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • ওমার তাসপিনার ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক