নিউইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু শহরে প্রবেশ করলেই তাঁকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হবে। কারণ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসি গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।
তবু নেতানিয়াহু নিউইয়র্ক সফরের ঘোষণা দিয়েছেন এবং মেয়রের মন্তব্যকে গুরুত্বহীন বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ফলে একটি মৌলিক প্রশ্ন সামনে এসেছে, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো শহরের মেয়রের কি বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানকে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা রয়েছে?
এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের আইসিসি–সম্পর্কিত অবস্থান বোঝা জরুরি। আইসিসি রোম সংবিধির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল দুটিই এই চুক্তির সদস্য নয়। সংবিধির ১২ থেকে ১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে অপরাধী যদি কোনো সদস্যদেশের নাগরিক হন অথবা কোনো সদস্যদেশের ভূখণ্ডে অপরাধ ঘটে, আদালত বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন।
সদস্যরাষ্ট্র কোনো পরিস্থিতি আদালতের কাছে উপস্থাপন করলে কিংবা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিলে আদালত বিচার শুরু করতে পারেন। অ–সদস্যরাষ্ট্রও বিশেষ ঘোষণাপত্র দিয়ে আদালতের এখতিয়ার স্বীকার করতে পারে এবং প্রসিকিউটর প্রয়োজন মনে করলে নিজ উদ্যোগে তদন্ত শুরু করতে সক্ষম।
ফিলিস্তিন ২০১৫ সালে রোম সংবিধিতে যোগ দেয়। ২০২১ সালে আইসিসি নিশ্চিত করে যে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সংঘটিত অপরাধ তাদের বিচারিক ক্ষমতার মধ্যে পড়ে। ২০২৪ সালে গাজায় অনাহার সৃষ্টির প্রচেষ্টা এবং বেসামরিক জনগণের ওপর হামলার অভিযোগে নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। তবে আইসিসির নিজস্ব কোনো পুলিশ নেই, ফলে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বাস্তবায়নে তারা সদস্যরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাদের কার্যক্রম সীমিত করেছে।
নিউইয়র্ক পুলিশ নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তার করতে পারবে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেউ মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রে ওয়ার ক্রাইমস অ্যাক্ট প্রয়োগ করতে হলে ফেডারেল সরকারের অনুমতি প্রয়োজন, যা পাওয়া কঠিন।
এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক আইনের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে আসে সর্বজনীন এখতিয়ার। গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধ যেমন যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রে যেকোনো রাষ্ট্র এসব অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার ও বিচার করতে পারে। অপরাধ কোথায় ঘটেছে বা অভিযুক্ত ব্যক্তি কোন দেশের নাগরিক, তা এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানিসহ নানা দেশ ইতিমধ্যে এই নীতি প্রয়োগ করে বিচার পরিচালনা করেছে। গাম্বিয়ার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওসমান সোনকোর সুইস আদালতে দণ্ড এবং সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের জারি করা পরোয়ানা এর সাম্প্রতিক উদাহরণ।
সর্বজনীন এখতিয়ারের সবচেয়ে আলোচিত উদাহরণ অ্যাডলফ আইখমানের মামলা। ১৯৬০ সালে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ তাঁকে আর্জেন্টিনা থেকে ধরে জেরুজালেমে নিয়ে যায় এবং ইহুদিদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। ইসরায়েল দাবি করেছিল যে আন্তর্জাতিক অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বজনীন এখতিয়ার রাষ্ট্রগুলোকে এই ধরনের ক্ষমতা প্রদান করে। আজ একই নীতি নেতানিয়াহুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে।
নিউইয়র্ক পুলিশ নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তার করতে পারবে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেউ মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রে ওয়ার ক্রাইমস অ্যাক্ট প্রয়োগ করতে হলে ফেডারেল সরকারের অনুমতি প্রয়োজন, যা পাওয়া কঠিন। আবার কেউ বলেন লিহি আইন বা যুক্তরাষ্ট্রের সেকশন ১০৯১ অনুযায়ীও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব। অন্য বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন যে সর্বজনীন এখতিয়ার আন্তর্জাতিক প্রচলিত আইনের বাধ্যতামূলক নীতি, তাই এতে পূর্বানুমতির প্রয়োজন পড়ে না।
সবশেষে বলা যায় যে নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তারের আইনি সম্ভাবনা আন্তর্জাতিক আইনেই নিহিত রয়েছে। আইসিসি যদি পরোয়ানা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হন, সর্বজনীন এখতিয়ার সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারে। আইখমান বা সোনকোর মতো উদাহরণ দেখায় যে রাজনৈতিক পদ বা কূটনৈতিক মর্যাদা কারও জবাবদিহি এড়াতে পারে না। নিউইয়র্ক মেয়রের বক্তব্য তাই আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারকে শক্তিশালী করার এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা
● ড. মোহাম্মদ ইউসেফ আন্তর্জাতিক আইন–গবেষক
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত