দায় ও দরদের দেশে কৃষকের অধিকার কোথায়

কৃষকের সুরক্ষায় তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে নাফাইল ছবি : প্রথম আলো

‘লাঙল বেচায় জোয়াল বেচায় আরও বেচায় ফাল/ খাজনার তাপতে বেচায় দুধের ছাওয়াল।’ চিলমারীর ওয়ারি এলাকার রাজা গোপীচন্দ্রের গান এটি।

ফিরছিলাম গরুর হাট হয়ে। সেখানে কয়েকজন গরু ক্রেতার কাছ থেকে খাজনার রসিদের ফটো ও ক্রেতার ভিডিও রেকর্ড নিই। দেখে ফেলেন ইজারাদারের লোক। জোর করে ভিডিও ও ছবি মুঠোফোন থেকে মুছে দেন। সেখান থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে ফিরতি একটি গরুবাহী ভটভটিকে থামায়। গরুর পাইকারেরা খাজনার রসিদ দেখান। রসিদে গরুর মূল্য লেখা ৫০ হাজার, কিন্তু খাজনার ঘর ফাঁকা। তাঁরা জানান, বিক্রেতার কাছে খাজনা নিয়েছে ৩০০ টাকা ও তাঁদের কাছে ৪০০ টাকা।

কৃষকের ভাষায়, ‘জমিদার হৈল ইজারাদার। —রাজা হৈলে দয়া বুঝে করিত পালন/ পরে দয়া নাহি বুঝে বেসি লইতে মন।’ আর এই জমিদারদের সবার ঠিকানা হলো কলকাতা নগরী। কুড়িগ্রামের বর্তমান উলিপুরের বাহারবন্দ পরগনার কৃষকের ভাষায়, ‘এক বারি কাশিম (বাজার) বারি বানজিটা।/ এক বারি আছে রাজার সহর কলিকাতা। —ধন কাঙ্গালি হৈল রাজা রাজ্যেরও ভিতর/ এয়ার বিচার করবেন ধর্ম নিরঞ্জন।’

দুই.

চিলমারী বন্দর থেকে রৌমারী। একটি ৪০ হাত নৌকা। একবারে যাত্রী পারাপার সম্ভব ১৫০ জনের। সোয়া ঘণ্টার পথ। একই শক্তির শ্যালো ইঞ্জিনচালিত একটি ভটভটি একই সময়ে চিলমারী বন্দর থেকে কুড়িগ্রাম শহরে যায় ১০ জন যাত্রী নিয়ে। ভাড়া জনপ্রতি ৫০ টাকা। তাহলে ১০ থেকে ১৫ গুণ যাত্রী নিয়ে নৌকা চললে ভাড়া হওয়ার কথা ৩ থেকে ৫ টাকা। সেখানে ১০০ টাকা ভাড়া কেন? বাড়তি ৯৫ টাকা নৌযাত্রীরা কেন দেবেন? এই টাকা ভাগাভাগি হয় নেতা থেকে পাতি নেতায়।

পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি ছিল জমিদারি উচ্ছেদ। কৃষকেরা যে হাটে কৃষিপণ্য কেনাবেচা করেন, সেটা নিয়েও ব্যাপক আন্দোলন ছিল। জমিদারের হাটের খাজনার অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকেরা নিজেরা হাট বসিয়েছেন। নৌপথে খাজনার অত্যাচারে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার ঘটনা আছে। হাট ও ঘাট থেকে ইজারার নামে জমিদারি প্রথাটি রয়ে গেছে। ফলে সড়কপথের চেয়ে নৌপথে তেল-মবিল খরচ কম লাগলেও সড়কপথের চেয়ে নৌপথে ভাড়া দু-তিন গুণ গুনতে হয়।

ভারতবর্ষে প্রথম ভূমি থেকে জমিদারি উচ্ছেদ হয় এই পূর্ব বাংলাতেই। এ দেশের কৃষক-প্রজা পার্টি ও পাকিস্তান আন্দোলন গড়ে উঠেছিল এই দাবিতেই। নদীমাতৃক দেশে নৌকা যে ঘাটে ভেড়ে আর কৃষকেরা ধান-পাট বেচেন যে হাটে, সেখানে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইজাদারি আইন কেমনে বহাল থাকে? নাকি স্বাধীন বাংলাদেশ এখনো কোম্পানিগুলো চালায়?

বাড়ি পুড়লেও ভিটা থাকে, কিন্তু নদী ভাঙলে তা–ও থাকে না। অথচ নদীতে চর জাগলে সেই জমি খাস হয়ে যায়। খাসজমি কে পায়? প্রভাবশালী চেয়ারম্যান–মেম্বার ও কোম্পানির মালিকেরা। কিন্তু কৃষকের জমি কৃষকেরা পান না। একবার নদী খায়, জমি জাগলে দ্বিতীয়বার খায় সরকার, মানে কোম্পানি। এত আইন পাস হলো, এই আইন বদলের খবর নেই।

তিন.

আমাদের কবিরা কৃষককে কবিতায় দধীচির (হিন্দু পুরাণের একজন ঋষি, যিনি তাঁর বুকের অস্থি দিয়ে মানুষকে বাঁচিয়েছিলেন) চেয়েও বড় সাধক বলেন। কিন্তু কৃষকের সঙ্গে সরকারের পণ্যের দাম ঠিক করা নিয়ে চুপ থাকি। পাটের মৌসুমে পাটে আগুন লাগিয়ে, আলুর মৌসুমে রাস্তায় আলু ফেলে আর সবজির মৌসুমে খেতে সবজি পচিয়ে কৃষক প্রতিবাদ করেন। সেগুলো খবরের কাগজেও ওঠে না।

ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র কৃষকদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) দেয়, যাতে কৃষকেরা ন্যায্য দাম পান এবং কৃষি উৎপাদন স্থিতিশীল থাকে। এ ছাড়া কৃষিপণ্যের ভবিষ্যৎ মূল্য নির্ধারণের জন্য ‘ফিউচার মার্কেট’ চালু আছে। এতে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা আগাম চুক্তির মাধ্যমে নির্দিষ্ট মূল্যে পণ্য বিক্রির নিশ্চয়তা পান।

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো কৃষকদের আর্থিক সহায়তা দেয়। এতে কৃষকেরা উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করলেও ক্ষতির সম্মুখীন হন না।

কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ ও সংগ্রহমূল্য নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন দেশে রয়েছে ‘অ্যাগ্রিকালচারাল প্রাইজ কমিশন’। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখন কৃষিমূল্য কমিশন কার্যকর রয়েছে। ভারতের কথাই ধরা যাক। সেখানে কৃষিমূল্য কমিশন স্থাপিত হয়েছে ১৯৬৫ সালে। বর্তমানে ২৩টি কৃষিপণ্যের সমর্থন মূল্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। নির্ধারিত মূল্যের নিচে যাতে বাজারদর নেমে না যায়, সে জন্য সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে উৎপাদিত পণ্য ক্রয় করে নেয় সরকার।

২০১৮-১৯ সালের বাজেটে ভারত সরকার বিভিন্ন কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করেছে উৎপাদন খরচের ওপর ৫০ শতাংশ মুনাফা হিসাব করে। মোট উৎপাদিত পণ্যের ১৫ শতাংশ ক্রয় করা হচ্ছে এরূপ পূর্বনির্ধারিত মূল্যে।

তারপরও ভারতের কৃষকেরা প্রায় ১০ বছর ধরে আন্দোলন করছেন ‘সর্বনিম্ন বিক্রয়মূল্য’ বা এমএসপির জন্য। শিল্পপতিদের জন্য যেমন আছে এমআরপি, কৃষকের জন্যে দরকার এমএসপি। পৃথিবীর বহু দেশে এটা নেগোশিয়েটেড হয় ইউনিয়নের মাধ্যমে। মওলানা ভাসানীও নেই, কৃষকসংগঠনও নেই।

চার.

বাচ্চু মিয়া (৫৭), জমির পরিমাণ ১৬ বিঘা, বাড়ি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নে। তাঁর জমি বছর বিশেক আগে নদীভাঙনে ধরলায় চলে যায়। তারপর বছর দশেক পর জেগে ওঠে। সেখান আশ্রয়কেন্দ্র হবে শুনে আদালতে মামলা করেন। কিন্তু মামলা চলমান অবস্থাতেই সেই জমিতে ওঠে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর।

বাড়ি পুড়লেও ভিটা থাকে, কিন্তু নদী ভাঙলে তা–ও থাকে না। অথচ নদীতে চর জাগলে সেই জমি খাস হয়ে যায়। খাসজমি কে পায়? প্রভাবশালী চেয়ারম্যান–মেম্বার ও কোম্পানির মালিকেরা। কিন্তু কৃষকের জমি কৃষকেরা পান না। একবার নদী খায়, জমি জাগলে দ্বিতীয়বার খায় সরকার, মানে কোম্পানি। এত আইন পাস হলো, এই আইন বদলের খবর নেই।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক সিনেমা, সংগীত, কবিতা, নাটক, গল্প, উপন্যাস হয়েছে! বহু চিত্রকর্ম, শিল্প, ভাস্কর্য হয়েছে। কিন্তু মানুষের মুক্তি? সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার কোথায়?

জুলাইয়ে দায় ও দরদের অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশে কৃষকদের অধিকার কোথায়? কোথায় তাঁদের জমি ও জীবিকার নিরাপত্তা?

নাহিদ হাসান: লেখক ও সংগঠক।

[email protected]