শিবিরের উত্থানের রাজনীতি, বাস্তবতা ও নানা সমীকরণ

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাফল্য রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। শিবিরের এ উত্থান নিয়ে এখন সর্বত্র আলোচনা। ছাত্রসংগঠনটির এ সাফল্যের নানা রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সমীকরণ নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন রাফসান গালিব

কোলাজ: প্রথম আলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) এবারের নির্বাচন এতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও উত্তেজনাপূর্ণ হবে, তা ছিল অভাবনীয়। মূলত চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানই সেটি সম্ভব করেছে।

একইভাবে নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির–সমর্থিত প্যানেলের যে ভূমিধস বিজয়, সেটিও ছিল অভাবনীয়, অনেকের কাছে অপ্রত্যাশিতও। নির্বাচনের দিন ও আগের দিন রাত পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে এবং ফলাফল ঘোষণার পর অনেকের প্রতিক্রিয়া দেখে, তেমনটিই মনে হলো।

ডাকসু নির্বাচনে এবার ভোটগ্রহণও হয় রেকর্ড পরিমাণ, বলা যায় প্রত্যাশার বাইরে। শিবির–সমর্থিত প্যানেলের বিপক্ষে ছাত্রদল, বামপন্থী ও এনসিপি–সমর্থিত সংগঠনের প্যানেলের প্রার্থীদের প্রচারণায় একটি বিষয় লক্ষণীয় ছিল, বেশিসংখ্যক ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে উদ্বুদ্ধ করা। তাঁদের ধারণা ছিল, শিবির–সমর্থিত প্যানেলের ভোট ‘ফিক্সড’, মানে তাদের ভোটব্যাংক নির্দিষ্ট। সেটাকে ছাপিয়ে যেতে পারে বেশিসংখ্যক ভোট গ্রহণের মধ্য দিয়েই।

অবাক করা বিষয় হচ্ছে, শিবিরই বরং এটির সবচেয়ে বেশি সুফলভোগী হয়েছে। প্রাপ্ত ভোটে কয়েকটি পদে তাদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে ব্যবধানকে ‘নিকটতম’ বলা যায় না, দূরবর্তীই বলতে হবে। এমনকি স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ছাড়া বিভিন্ন দল–সমর্থিত প্রার্থীদের ভোটের যোগফল থেকেও কয়েকটি পদে শিবিরের প্রার্থীরা বেশি ভোট পেয়েছেন। ফলে বিভিন্ন দল–সমর্থিত প্রার্থীদের মধ্যে ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ায় শিবির–সমর্থিত প্রার্থীরা জিতে এসেছেন, সেই যুক্তিও আসলে সব ক্ষেত্রে টেকে না।

যেসব প্রশ্ন সামনে এসেছে

সর্বত্র এখন একটাই আলোচনা, শিবিরের এই অভাবনীয় বিজয়ের কারণ কী? এখানে যেমন শিবিরের পরিকল্পিত সাংগঠনিক প্রস্তুতির বিষয়টি সামনে এসেছে, আবার রেকর্ডসংখ্যক ভোট পড়া নিয়ে কোনো সূক্ষ্ম কারচুপি বা ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং হয়েছে কি না, সেই সন্দেহেরও প্রকাশ ঘটেছে। নির্বাচনের দিন দৃশ্যমান কিছু অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দেখা গেলেও যাকে মোটাদাগে কারচুপি বলাটা সংগত হবে না। যদিও ডাকসু নির্বাচনের প্রায় দুই সপ্তাহ পর কয়েকটি প্যানেলের ভিপি–জিএস প্রার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে নির্বাচন নিয়ে তাঁদের কিছু অভিযোগ জানিয়েছেন।

শিবির অপেক্ষাকৃত ভালো করতে যাচ্ছে, বিশেষ করে প্রধান তিন পদের একটিসহ আরও কিছু পদে জিততে যাচ্ছে, সেটি প্রচারণার শুরু থেকে ধারণা করা যাচ্ছিল। কিন্তু প্রধান তিনটি পদই তারা পেতে যাচ্ছে, এটি যখন নির্বাচনের দিন সন্ধ্যার কিছু সময় পর থেকে ক্যাম্পাসজুড়ে চাউর হতে থাকল, তা অনেকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। সে সময় শিবিরের বিপক্ষে তো অবশ্যই, পক্ষে থাকা কয়েকজন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, তাঁদের কাছেও বিষয়টি অবিশ্বাস্য ঠেকছে।

ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের প্রার্থী বাছাই বেশ আলোচিত ছিল
ছবি: প্রথম আলো

পরে তো আমরা দেখলাম, কী একচেটিয়াভাবে তারা জিতে এল এবং কিছু পদে বিপুল ভোট পেল। ক্যাম্পাসে অনেকের কাছে বিভিন্ন হলের কেন্দ্রে কোনো কোনো হেভিওয়েট প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর এত কম ভোট পাওয়ার বিষয়টিও অকল্পনীয় ছিল।

এ রকম অনেক না–মেলা হিসাব-নিকাশ থেকে হয়তো কারও কারও মনে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিষয়টি ঢুকে গেছে। কিন্তু বিষয়টিকে এখন পর্যন্ত আমাদের সন্দেহ, অবিশ্বাস বা অভিযোগ আকারেই দেখতে হবে। কারণ, এর কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ আমাদের কাছে নেই। আবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জাকসুতেও শিবিরের অধিকাংশ পদে জিতে আসার বিষয়টিও আমাদের মাথায় রাখতে হবে।

আরও পড়ুন

অনেকের মতে, ক্যাম্পাসগুলোতে শিবিরের সাংগঠনিক ভিত্তি কতটা শক্তিশালী ছিল, সেটি অধিকাংশের কাছে স্পষ্ট ছিল না। ফলে শিবিরের এই সাফল্য অনেকের কাছে অকল্পনীয় মনে হচ্ছে, অনেকে মেনে নিতে পারছেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের এই উত্থানের পেছনে অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে আসছে। যেমন কেন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তচিন্তাচর্চার বৃহত্তর পরিসরে শিবিরের মতো ধর্মীয় রাজনীতির ছাত্রসংগঠন এতটা জনপ্রিয়তা পেল? তাদের কী ধরনের সাংগঠনিক প্রস্তুতি ছিল? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা জাহাঙ্গীরনগরকে চিন্তাগত জায়গায় যেসব মানদণ্ডে দেখা হতো, সেখানে কী পরিবর্তন ঘটে গেছে? এ ছাড়া শিবিরের এ সাফল্যের বিপরীতে অন্য ছাত্রসংগঠনগুলোর ব্যর্থতা কতটা ভূমিকা পালন করেছে?

ডাকসুর ফলাফল ঘোষণার পর থেকে এসব নিয়ে নাগরিক সমাজে নানামুখী চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। ডান-বাম-মধ্যপন্থী রাজনীতি নির্বিশেষে রাজনৈতিক কর্মী, সাবেক রাজনৈতিক কর্মী, সাবেক ডাকসু সদস্য, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, অ্যাকটিভিস্ট—যাঁর যাঁর পর্যবেক্ষণ হাজির করছেন। তাঁদের অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এমন কয়েকজনও আছেন।

৩৫ বছরের বড় ‘বিনিয়োগ’ 

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নিঃসন্দেহে শিবিরকে ক্যাম্পাস রাজনীতিতে প্রকাশ্যে আসতে, স্বাভাবিক সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রভাব বিস্তার করতে বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। অধিকাংশজনের বক্তব্যে প্রকাশ পাচ্ছে, ফ্যাসিবাদী শাসনে ক্যাম্পাসে যে অগণতান্ত্রিক ও বলপ্রয়োগের রাজনীতি ছিল, সেখানে সবচেয়ে বেশি কোণঠাসা ছিল শিবির।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নব্বইয়ের পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের রাজনীতি একপ্রকার ‘নিষিদ্ধ’ ছিল। প্রায় কাছাকাছি সময় থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রদলের সঙ্গে সংঘর্ষের জেরে ক্যাম্পাস-ছাড়া হয় শিবির। ফলে কয়েক দশকের বাস্তবতা এখানে হাজির আছে। অনেকে এখন স্বীকার করছেন যে শিবিরকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে না দেওয়াটাই বরং ভুল ছিল।

এ দীর্ঘ সময়ে অপ্রকাশ্যে বিভিন্ন কৌশলে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে শিবির এমন পদ্ধতি বেছে নিয়েছিল, যেটি পরবর্তী সময়ে ‘গুপ্ত রাজনীতি’ হিসেবে আলোচিত হয়েছে। তাদের রাজনীতির এমন ধরন নিয়ে যদিও নানা সমালোচনা আছে।

কয়েক দশকের চর্চা থেকে এই গুপ্ত রাজনীতির কাঠামোগত বিস্তার এতটা শক্তিশালী ছিল যে ছাত্রলীগের কঠোর প্রভাব, নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য, ক্ষমতা ও শক্তিচর্চার মধ্যেও সেটির উন্মোচন হয়নি। এমনকি ছাত্রলীগের ভেতরেও বিভিন্নভাবে তারা তাদের অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।

শিবিরের পক্ষে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বড় একটি সমর্থনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, ছাত্রদলের ‘ছাত্রলীগ’ হয়ে ওঠার আশঙ্কা। জাতীয় নির্বাচনে জিতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ছাত্রদলের ‘পুরোনো রূপ’ প্রকাশ ঘটতে পারে, এমন ভীতিও কাজ করেছে তাদের মধ্যে। কারণ, ছাত্রলীগের নিপীড়নের ট্রমা এখনো সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে গেঁথে আছে।

যাহোক, দীর্ঘ সময় ধরে এমন পদ্ধতি ও কৌশল অবলম্বন করতে গিয়ে শিবির যেদিকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগী হয়, তা হচ্ছে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিতর্ক ও আঞ্চলিক সংগঠনগুলোতে, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতিতেও নিজেদের জোরালোভাবে সংযুক্ত করা। এসব পরিসরে বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্বেও তাদের নেতা-কর্মীরা জায়গা করে নেন। বলা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পরিসরগুলোতে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করার কৌশল এবারের ডাকসু নির্বাচনে তাদের বিজয়ের ক্ষেত্রে বড় ‘বিনিয়োগ’ হিসেবে কাজ করেছে।

অভ্যুত্থানের পর হলে হলে দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’রূপে শিবির অপ্রকাশ্যভাবে তার পুরোনো রাজনৈতিক অবস্থান ধরে রাখে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতামূলক মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। অনেকের মতে, ক্যাম্পাসে বিশেষ করে হলে হলে কৌশলগতভাবে এই ‘অন্যায্য’ সুবিধা নিয়ে শিবির আসলে সাংগঠনিকভাবে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে গিয়েছিল এবং শিক্ষার্থীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল।

টিএসসি কেন্দ্রে ভোট দিতে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোটাররা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ছবি: সাজিদ হোসেন

প্রস্তুতির দৌড়, অন্যদের ব্যর্থতা এবং পরোক্ষ বাস্তবতা

 শিবিরের এ বিজয়ের পেছনে অন্যতম বড় কারণ হিসেবে যুগপৎভাবে সামনে আসে গণ-অভ্যুত্থানের পর ডাকসুকে ঘিরে তাদের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি এবং সে জায়গায় অন্য রাজনৈতিক পক্ষগুলোর ব্যর্থতা। গত এক বছর শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে বহুমুখী কর্মসূচি ও কর্মকাণ্ড তারা গ্রহণ করেছে।

এর পেছনে অর্থের জোগান নিয়ে প্রশ্ন উঠলে বলতে হয়, শিবিরের সাংগঠনিক ‘অর্থনৈতিক মডেল’ এখানে বড় ভূমিকা রেখেছে। অন্য সংগঠনগুলোর নিজস্ব অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত নেই বললেই চলে।

সেই সঙ্গে শিবিরের প্যানেলে কারা নেতৃত্বে থাকছে, সেটিও অন্তত ছয় মাস আগে নিশ্চিত করা হয়। প্রধান প্রার্থী সাদিক কায়েমকে, যিনি ৫ আগস্টের পর গণ-অভ্যুত্থানের ভূমিকার জন্য আলোচনায় আসেন, নির্বাচনের জন্য নানাভাবে ব্র্যান্ডিং করে তাঁকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা হয়।

সেদিক দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলো ছিল অনেক পিছিয়ে, বিভক্ত ও অগোছালো বা কার্যত পরিকল্পনাহীন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরও তাদের প্যানেলের প্রার্থিতা নিশ্চিত করা যায়নি। অন্যদিকে শিবির সর্বোচ্চভাবে ক্যাম্পাসের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছে তথা ডোর টু ডোর, ম্যান টু ম্যান প্রচার-প্রচারণা ও সংযোগ স্থাপন করেছে। কিন্তু অন্যরা সেই সময়টুকুই পায়নি প্রস্তুতি ও পরিকল্পনায় পিছিয়ে থাকায়। উমামা ফাতেমার মতো গণ-অভ্যুত্থানের আলোচিত নেত্রীর ক্ষেত্রেও তেমনটি আমরা দেখতে পাই।

ডাকসুর সাবেক একজন সদস্যের মতে, ফ্যাসিবাদী আমলে গণতান্ত্রিক রাজনীতি কোণঠাসা থাকায় দেশজুড়ে পরোক্ষভাবে দক্ষিণপন্থীরা প্রভাব বিস্তার করা শুরু করে এবং চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর তাদের উত্থান ঘটে। শিবিরের এ বিজয় আসলে দক্ষিণপন্থী রাজনীতি উত্থানেরই প্রতিফলন।

আবার নাগরিক সমাজের কারও কারও মতে, একসময়কার শহুরে মধ্যবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সাংস্কৃতিক ভিত্তি ছিল, সেখানে বড় একটি পরিবর্তন ঘটে গেছে। এসব পরিবারের দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের সন্তানেরা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়কেই বেছে নিচ্ছেন। তাঁদের জায়গায় চলে এসেছেন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা এবং গ্রাম-মফস্‌সলের স্কুল-কলেজ বা মাদ্রাসা থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থীরা, যাঁদের অনেকের উঠে আসার পেছনে শিবিরের সাংগঠনিক অনেক কর্মসূচি ও পরিকল্পনা বড় ভূমিকা রাখে। এটি ক্যাম্পাসে শক্ত ভিত তৈরিতে শিবিরের জন্য একটি জোরালো পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে।

তবে শিবিরের রাজনীতির একজন পর্যবেক্ষক ডাকসুর সাবেক সদস্যের দাবিটি নাকচ করে দিয়ে শিবিরের প্রচলিত ধর্মীয় রাজনীতি থেকে বের হয়ে প্যানেল গঠনে ‘সেক্যুলার অ্যাপ্রোচ’ রাখার দিকটিকে বরং অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন।

তাঁর মতে, শিবির নিয়ে প্রচলিত যেসব ধ্যানধারণা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত, সেসব ভাঙতে এবং এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনে ও আস্থা অর্জনে তারা ক্যাম্পাসে বহুমুখী কৌশলগত প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের তাদের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। তবে কারও কারও মধ্যে এই আশঙ্কাও আছে, নির্বাচিত হওয়ার পর শিবির ক্যাম্পাসে তাদের সেই ‘সেক্যুলার অ্যাপ্রোচ’ ধরে রাখবে, নাকি আগের প্রচলিত রূপেই ফেরত যাবে?

শিবিরের পক্ষে ক্যাম্পাসে জনমত তৈরিতে আরেকটি মাত্রা যুক্ত করেছে, তা হচ্ছে দেশে–বিদেশে তাদের নেতাকর্মী ও আলোচিত বড় বড় ইউটিউবার ও ইনফ্লুয়েন্সাদের প্রচার–প্রচারণা। যেখানে শিবিরের পক্ষে ন্যারেটিভ বা বয়ান তৈরি করতে, তাদের বিপক্ষে প্রচারণার জবাব দেয়া বা প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেল বা প্রার্থীদের সমালোচনার মধ্য দিয়ে পাল্টা বয়ান হাজির করতে দেখা গেছে, যা নির্বাচনে শিবিরের পক্ষে প্রভাব ফেলেছে বলেও কেউ কেউ মনে করেন।

বিগত ট্রমা ও পুরোনো রাজনীতির অসাড়তা

শিবিরের পক্ষে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বড় একটি সমর্থনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, ছাত্রদলের ‘ছাত্রলীগ’ হয়ে ওঠার আশঙ্কা। জাতীয় নির্বাচনে জিতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ছাত্রদলের ‘পুরোনো রূপ’ প্রকাশ ঘটতে পারে, এমন ভীতিও কাজ করেছে তাদের মধ্যে। কারণ, ছাত্রলীগের নিপীড়নের ট্রমা এখনো সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে গেঁথে আছে। ফলে নির্বাচনের দিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ‘শিবির বনাম ছাত্রদল’—এমনটা প্রকাশ পাওয়ার সুবিধাও শিবিরের পক্ষে যায়।

ছাত্রদল নিয়ে শঙ্কা ও আগের ট্রমার বিষয়টি সাধারণ নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যেও গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে শিবিরের বিরুদ্ধে ‘নারীবিরোধী অবস্থান’ নিয়ে প্রচারণাও খুব একটা জোর পায়নি। ক্যাম্পাসে শিবিরের ‘মোরাল পুলিশিং’ নিয়ে অভিযোগ থাকলেও শিবিরের ক্যাম্পেইন সেটিকে ছাপিয়ে গেছে।

প্যানেলে নিজেদের সংগঠনের বাইরে অন্য নারীদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি ইতিবাচক বার্তা দেয়। ফলে মেয়েদের হলে হলে শিবিরের প্রচার-প্রচারণার বিপুল উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে লাগানো পোস্টারে প্যানেলের হিজাবপরিহিত এক নারী সদস্যের ছবি বিকৃতির ঘটনাকে শিবির প্রচারণা হিসেবে কাজে লাগায়। ক্যাম্পাসে আওয়ামী শাসনামল থেকে নানা ঘটনায় ‘ইসলামোফোবিক’ বা ‘হিজাবোফোবিক’ ইস্যুগুলোও এখানে গুরুত্ব পায়।

জাকসু নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর বিজয়ীদের উচ্ছ্বাস। ভিপি পদ ছাড়া শীর্ষ সবগুলো পদেই জিতে শিবির সমর্থিত প্যানেল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ১৩ সেপ্টেম্বর
ছবি: প্রথম আলো

শিবিরের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অবস্থান নিয়ে প্রতিপক্ষদের প্রচারণাও খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি। কারণ, ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বলে শিবির তকমা দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছিল। সেই দুর্বিষহ স্মৃতি শিক্ষার্থীরা এখনো ভুলতে পারেননি। একইভাবে আওয়ামী শাসনামলে শিবির প্রার্থীদের ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়া নিয়ে প্রচারণাও খুব একটা কাজে আসেনি বলে মনে করেন ক্যাম্পাসের শিবিরের সাবেক নেতারা। কারণ, বিগত আমলে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর হলে থাকতে গিয়ে বাধ্য হয়ে এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।

সব পক্ষের সব প্যানেলের একমাত্র প্রতিপক্ষ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি শিবিরের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আগ্রহ আরও বাড়িয়েছে। শুধু ‘অ্যান্টি-শিবির’ অবস্থানে জোর দিয়ে প্রতিপক্ষদের হিতে বিপরীতও হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

যেমন গণ-অভ্যুত্থানের পরিচিত মুখদের নিয়ে গঠিত নতুন ছাত্রসংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ (বাগছাস)–সমর্থিত প্যানেলের ভরাডুবির এটিও একটি কারণ। গণ-অভ্যুত্থানের আলোচিত মুখ আবদুল কাদের এতটা কম ভোট পাবেন, তা ছিল কল্পনাতীত। একই নীতিতে তথা ‘অ্যান্টি-শিবির’ অবস্থানে তাদের চেয়ে বাম ছাত্রসংগঠনদের প্রতিরোধ পর্ষদ প্যানেলই বরং বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। কেন্দ্রীয় সংসদে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে চব্বিশের আরেক আলোচিত মুখ মেঘমল্লার বসুর প্রাপ্ত ভোট সেটিই ইঙ্গিত দেয়।

আরও পড়ুন

শিবিরের পক্ষে ক্যাম্পাসে জনমত তৈরিতে আরেকটি মাত্রা যুক্ত করেছে, তা হচ্ছে দেশে–বিদেশে তাদের নেতাকর্মী ও আলোচিত বড় বড় ইউটিউবার–ইনফ্লুয়েন্সাদের প্রচার–প্রচারণা। যেখানে শিবিরের পক্ষে ন্যারেটিভ বা বয়ান তৈরি করতে, তাদের বিপক্ষে প্রচারণার জবাব দেয়া বা প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেল বা প্রার্থীদের সমালোচনার মধ্য দিয়ে পাল্টা বয়ান হাজির করতে দেখা গেছে, যা নির্বাচনে শিবিরের পক্ষে প্রভাব ফেলেছে বলেও কেউ কেউ মনে করেন।

নির্বাচন–পরবর্তী চ্যালেঞ্জ

জাকসুতেও প্রতিপক্ষ প্যানেলগুলোর পরিকল্পনায়, প্রস্তুতিতে ও কৌশলগত প্রচার-প্রচারণায় ব্যর্থতা শিবিরকে সেখানে বড় সাফল্য এনে দিয়েছে। তবে শিবিরের রাজনীতির পর্যবেক্ষণকারী ও সাবেক শিবির নেতাদের মধ্যে অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের একচেটিয়া জয় আশা করেননি। এটিকে তাঁরা শিবিরের জন্য চ্যালেঞ্জিংও মনে করছেন। এতে শিবিরের রাজনীতি জন্য ‘বুমেরাং’ হওয়ার আশঙ্কাও করছেন তাঁরা। আর, ক্যাম্পাসে কোনো কিছু ঘটলে সবাই মিলে শিবিরের ওপর চাপ তৈরি করবে। ফলে শিবিরের পক্ষে ছাত্র সংসদ চালানো সহজ হবে না।

অন্যদিকে শিবিরের রাজনীতির সমালোচকদের মতে, দলটির প্যানেলের একচেটিয়া জয় ক্যাম্পাসে নতুন আধিপত্যবাদী রাজনীতির প্রকাশ ঘটাতে পারে। শিবির-প্রভাবিত ক্যাম্পাসের পুরোনো দিনগুলোর কথাও স্মরণে করিয়ে দেন তাঁরা। তবে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর সেটি কতটা সম্ভব হবে, সেই প্রশ্নও আছে কারও কারও।

রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী।  [email protected]   

*মতামত লেখকের নিজস্ব