গ্রামই কেন বারবার বাংলাদেশকে বাঁচায়

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে ঠাঁই দিয়েছে গ্রাম। করোনাকালে গ্রাম আবার নিজেকে প্রমাণ করেছিল।
ছবি : লেখক

চিলমারী থেকে কুড়িগ্রামে আসছিলাম সিএনজিতে। ড্রাইভারসহ ছয়জন। ড্রাইভার রফিকুল ইসলাম (৩৫) ও পাশে বসা মঞ্জু ভাই (৫২)—দুজনেই করোনার সময় গ্রামে এসেছেন, আর ফিরে যাননি। চিলমারীর পানাতিপাড়া গ্রামের মঞ্জু ভাই কোনাবাড়ী, গাবতলি এলাকায় রিকশা ও ভ্যান চালাতেন। বললেন, ‘প্রয়োজন নাই, তাই ঢাকায় ফিরি নাই। বাড়িতেই কাজকাম আছে। ঢাকায় আয় যেমন, খরচাও তেমন। ঢাকায় একটা মানুষ খাইতে ৩০০ টাকা নাগে। আর গ্রামোত ৩০০ টেকা বাজার কইরলে ৭–৮ জনে খাওয়া যায়।’

রফিকুল ইসলামের ২ ছেলে। বাড়ি রংপুরের কাউনিয়ায় পূর্ব চানহাটে। তিনি কেন ঢাকায় ফিরলেন না, জানতে চাইলে বলেন, ‘অসুস্থ ছিলাম, তারপর গাড়ি কিনলেম। ঢাকায় আয়–রোজগার ভালো হইলেও ওখানে তো ফ্যামিলি নাই। এখানে ফ্যামিলির সঙ্গে আছি।’ এগুলোই হচ্ছে সাধারণ গল্প। সবার গল্প। করোনা শহরের মুখোশ খুলে দিয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে ঠাঁই দিয়েছে গ্রাম। করোনাকালে গ্রাম আবার নিজেকে প্রমাণ করেছিল। কেউ কেউ অতীতের ভাবালুতায় আচ্ছন্ন হওয়ার নিন্দা করবেন। কিন্তু অতীতকে কেবল নেতিবাচক বলে উপস্থাপন করাটা ওই কথিত ভাবালুতার চেয়ে বিভ্রান্তিকর।

২.

কুড়িগ্রাম জেলা। বলা হয়, এটি নাকি দারিদ্র্যের শীর্ষে। আর এর পেছনের বড় কারণ হিসেবে বলা হয়, এই জেলার অধিবাসীরা ‘কুড়িয়া’ (অলস)। অন্যান্য জেলায় গড় প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা যেখানে লাখখানেক, সেখানে এ জেলায় মাত্র হাজার দশেক। কেন তারা দেশের বাইরে যেতে অনাগ্রহী?

দারিদ্র্যের একটি বড় সূচক ধরা হয় হাতে টাকা না থাকা। কুড়িগ্রামের প্রায় সবারই বড় পরিসরে নিজস্ব বাড়ি আছে। গৃহহীন মানুষ কম। নিজেদের প্রয়োজনীয় প্রায় সব ফসলই এখানে ফলে। যে পানি ও বাতাস তারা ভোগ করেন, তা তো টাকায় কিনতে পাওয়া যায় না।

শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের আনন্দিত জীবন যাপনের পর্যাপ্ত অবসর আছে। ফলে শহরের মানসিক বৈকল্যে তাঁরা ভোগেন না।

অর্ধশতাধিক নদ–নদীর যে সুস্বাদু মাছ তারা ভোগ করে তা উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তুলনীয়। চরাঞ্চলের শিশুরা হয়তো শহরের শিশুদের মতো বই পড়তে পারে না। কিন্তু তারা প্রত্যেকে সাঁতার জানে, প্রচুর গাছের নাম জানে। এমনকি কোন গাছের কোন ফলের স্বাদ কেমন, কোন রোগে কোন উদ্ভিদ কাজে লাগে—এসবও তাদের জানা।

জনগণের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, মানবিক মূল্যবোধ, পারিবারিক সংহতি, সামাজিক বন্ধন শহরের এক ব্যক্তির সংসারে পাওয়া যাবে না। তারা যখন নৌকার জন্য ঘাটে অপেক্ষা করে, তখন পরস্পরের সম্পর্ক মজবুত হয়ে ওঠে। চরের হাটগুলো এখনো নগরের পণ্যে ভর্তি হয়ে ওঠেনি; এখনো বেকিং সোডানির্ভর খাবার চরের সুস্বাদু খাবারের জায়গা নিতে পারেনি।

এখনো হঠাৎ কোনো নৌ দুর্ঘটনায় ৫০ ঘরবিশিষ্ট চরে ২০০ যাত্রী আটকা পড়লে গোটা চরবাসী তাদের দায়িত্ব নেবে। পরিবারগুলো চারজন করে লোকের দায়িত্ব নেবে। ঘরে যা খাবার আছে, তা ভাগ করে খাবে। এটা পৃথিবীর কোন শহরে পাওয়া যাবে? আপন জীবনে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আছে, এমন গ্রাম বা মফস্‌সলের স্নিগ্ধ অভিজ্ঞতা যদি না থাকে, তাহলে প্রযুক্তিচালিত ঝলমলে একক পৃথিবীই কাম্য হবে।

৩.

একমাত্রিক উন্নয়ন ধারণায় সংকটের স্থানভিত্তিক আঞ্চলিক সমাধানের কোনো জায়গা একেবারেই নেই। অসীম সম্ভাবনাময় মানুষের জীবনকে রাষ্ট্র দ্বারা একসূত্র দিয়ে চালানো হয়। অথচ কত ভিন্নতা সংস্কৃতিতে আর উৎপাদনব্যবস্থায়। বৈচিত্র্য–বিধ্বংসী উন্নয়ন ধারণা কোনোমতেই সংগতিপূর্ণ নয়। দেশজ সম্পদ ও সনাতনী জ্ঞান প্রয়োগ করে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ও টাকা ছাড়াই যে মানুষের বৈষয়িক চাহিদা মেটানো যায়– এ শিক্ষা একমাত্রিক নাগরিক উন্নয়ন ধারণায় পাওয়া যাবে না।

শহর–প্রভাবিত অদ্ভুত জীবন তো আমরা দেখছিই। গৃহহীনতা, মাদকাসক্তি ও বৃদ্ধাশ্রম আর তার পরিণতি তো আত্মহত্যা। বিষময় খাবার, পানির বোতল, টাকার বিনিময়ে পানি পান থেকে মলত্যাগ পর্যন্ত। দূষিত নদী বুড়িগঙ্গার ‘স্নিগ্ধতা’–ও টাকায় কিনতে হয়। ফলে গাঁয়ে যে লোকের ১০ হাজার টাকায় চলে, ঢাকায় তা লাখের নিচে মেলে না। অথচ উত্তরবঙ্গে বাতাসে–ঝড়ে ফল মাটিতে পড়লে যে কুড়াবে, ফল তারই। তাই জিডিপি আর প্রবৃদ্ধির কথা শোনামাত্রই প্রশ্ন রাখতে হবে, কার জন্য প্রবৃদ্ধি আর কিসের বিনিময়ে জিডিপি। নিজ ভূমি, স্বাস্থ্যকর খাবার আর আনন্দমুখর উৎপাদনব্যবস্থার বিনিময়েই নয় কি?

ইউরোপে আজ স্থানীয় প্রকল্পের মাধ্যমে আবার সামাজিক বন্ধন ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদনব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ শুরু হয়েছে। এই উদ্যোগগুলোর সঙ্গে ব্রহ্মপুত্রের চরাঞ্চলের জীবনের ব্যাপক মিল আছে। জৈব কৃষি, প্রাকৃতিক আঁশ ও ঘর নির্মাণের উপকরণ ব্যবহার এবং অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের অনুশীলন। প্লাস্টিকের দড়ির বদলে এখনো পাটের আঁশ ব্যবহৃত হয়। ধরা যাক, এই পাট বড় কারখানানির্ভর বস্তু। তার জায়গায় যে তুলা আবাদ করা হতো, সেই তুলা থেকে সুতা আর সুতা থেকে কাপড়—পুরো প্রক্রিয়াটাই কারিগর পরিবারের হাতে ঘরেই উৎপাদিত হয়। এমনকি সুতা ও কাপড়ের রং পর্যন্ত প্রাকৃতিকভাবে সংগৃহীত হতো।

বরং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেন জবরদস্তির ভূমিকায় হাজির থাকে। যে কৃষক ৫ টাকায় নৌকায় পারাপার হতে পারেন, ইজারার নামে সেখানে তিনি ১০০ টাকা দিতে বাধ্য হন। রেহাই পাওয়ার উপায় কী? উপায় হলো রাষ্ট্র ও কোম্পানির আধিপত্যবাদী আষাঢ়ে গল্পের মায়াজাল ছিন্ন করে জরুরি সমাজের কর্তৃত্ব স্থাপন। সংবিধান সংস্কার করে দরকার স্থানীয় শাসনের বদলে স্থানীয় সরকার। স্থানীয় সরকার ঠিক করবে উন্নয়নের পথ ও পদ্ধতি। আর সমাজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যেকোনো সময় প্রত্যাহারের ব্যবস্থা।

ঔপনিবেশিক ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গিমূলক অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী যে আওয়াজ উঠেছে, তা–ই বাংলাদেশকে বাংলাদেশে ফেরাবে, গ্রাম বাঁচাবে বাংলাদেশকে।