ইসির সংলাপ ও দিনের কাজ রাতে হওয়া

বিদ্যমান অবস্থা বদল না করলে নির্বাচন কমিশনের জায়গায় ফেরেশতা্ এলেও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয় বলে জাপা মহাসচিব ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ শেষ হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই দেশবাসী জানতে চাইবেন, সংলাপের ফল কী হলো? এ উত্তরে এককথায় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না বলা যাবে না। সংলাপের উদ্দেশ্য যেহেতু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ করা, সেহেতু চূড়ান্ত ফল পেতে আমাদের সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

তবে এই সংলাপের মধ্য দিয়ে একটি বিষয়টি পরিষ্কার হলো যে, নির্বাচন নিয়ে দেশে একটি সংকট আছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন সেটি বুঝতে পেরেই রাজনৈতিক দল ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে। ভবিষ্যতেও বলবে আশা করা যায়।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, এই সংলাপে নিবন্ধিত ৩৯টি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এর মধ্যে বিএনপিসহ ৯টি দল অংশ নেয়নি। দুটি দল অংশ নিতে আগ্রহ দেখালেও নির্ধারিত সময়ে যোগ দিতে পারেনি। ২৮টি দলের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে নানা বক্তব্য ও দাবি উত্থাপিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালও তাঁর প্রতিক্রিয়ায় অনেক কথা বলেছেন। আমরা মনে করি, কেবল নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কেন, সব সক্রিয় দলের সঙ্গেই ইসির কথা বলা উচিত। নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে এমন দলও আছে, যারা সাইনবোর্ডসর্বস্ব। আবার অনিবন্ধিত দলের মধ্যে অনেকে বেশ সক্রিয়। বিভিন্ন স্থানে সাংগঠনিক শক্তিও তাদের আছে।

আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টির মহাসচিবের সত্য ভাষণের পর আওয়ামী লীগের নেতারা কী বলবেন? বিদ্যমান অবস্থা বদল না করলে নির্বাচন কমিশনের জায়গায় ফেরেশতা্ এলেও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয় বলে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। বিদ্যমান অবস্থা কি দলীয় সরকার? বিদ্যমান অবস্থা কি ক্ষমতাসীনদের প্রতি আনুগত্যশীলতা? বিদ্যমান অবস্থা কি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দলীয় কর্মীর ভূমিকায় নামা?

এই সংলাপে সবার আগ্রহ ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কী বলে, সেটা শোনার। শেষ দিনের শেষ সংলাপে যোগ দিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ‘পাস্ট অ্যান্ড ক্লোজড’ বা ‘অতীত ও সমাপ্ত’ বিষয় বলে অভিহিত করেছেন। তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা ছাড়া আওয়ামী লীগ একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করে দেখাতে পারলে মানুষ একে পাস্ট অ্যান্ড ক্লোজড বিষয় ভাবতে পারত। কিন্তু তারা তো দুটো পরীক্ষায় ফেল করেছে। এ কারণে অতীত ফিরে ফিরে আসে।

তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তাতে তত্ত্বাবধায়কের ছায়া আছে। তারা নির্বাচনসংক্রান্ত সবকিছুর তত্ত্বাবধান নির্বাচন কমিশনকে নিতে বলেছেন। এ রকম বা এর কাছাকাছি প্রস্তাব আরও কয়েকটি দল রেখেছে। কেউ কেউ নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশনের হাতে স্বরাষ্ট্র ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয় দেওয়ার কথা বলেছেন।

এই সংলাপে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়েছে ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন নিয়ে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেকোনো মূল্যে ইভিএমের মাধ্যমে ৩০০ আসনে ভোট করতে চাইলেও বেশির ভাগ দল এর বিরোধিতা করেছে। এমনকি গত দুই নির্বাচনের আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টিও ইভিএম মানতে চায়নি। দলের মহাসচিব মুজিবুল হক বলেছেন, ‘আমরা ইভিএমে বিশ্বাস করি না।’

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আমরা ইভিএম মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, চেতনায় ধারণ করি। আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনেই ইভিএমে ভোট চায়।’ ইভিএম একটি মেশিন। ভোট গ্রহণের একটি পদ্ধতি। এটি চেতনায় কীভাবে ধারণ করা যায়? চেতনায় ধারণ করতে হয় সুষ্ঠু ও অবাধ ভোট। সমস্যাটা ইভিএমের নয়। ইভিএমের পেছনে যে মানুষটি থাকে তার। আমরা একসময় ভুয়া ভোটার বাদ দিতে ছবিযুক্ত নির্ভুল ভোটার তালিকা করলাম। তারপরও মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা গেল না। এই ব্যর্থতার দায় আওয়ামী লীগ এড়াবে কীভাবে?

ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এ দেশে ভোট ডাকাতি ও ভোট জালিয়াতির সবচেয়ে বড় শিকার আওয়ামী লীগ। সেটাই যদি সত্যি হয়, তাদের উচিত ছিল ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ করে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি থেকে নিজেদের আলাদা প্রমাণ করা। এখন সবাই একই কাতারে চলে গেছে। রঙে নয়, ফলেই বৃক্ষের পরিচয়।

আওয়ামী লীগ বলছে, ইভিএমই একমাত্র ত্রাতা। আর তাদের জোটসঙ্গী বলছে, ইভিএমে তাদের বিশ্বাস নেই। এই অবিশ্বাস কেন তৈরি হলো, তা-ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মেশিনে ত্রুটি থাকলে সংশোধন করা যায়, মেশিনের পেছনের মানুষ সংশোধন করা খুবই কঠিন।

আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচনের সময় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ নির্বাচন পরিচালনার জন্য আবশ্যকীয় সব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে ন্যস্ত করার কথা বলেছে। তাদের প্রস্তাবে নির্বাচনকালীন সরকারের কর্মপরিধি কেবল আবশ্যকীয় দৈনন্দিন (রুটিন) কার্যাবলির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা; অ্যাডহক বা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার পরিবর্তে টেকসই সাংবিধানিক, আইনি ও রেগুলেটরি ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিরুদ্ধে নানা যুক্তি দেখাত। এখন যেমন আওয়ামী লীগ ক্লোজড অ্যান্ড পাস্ট বলে দাবি করছে।

আরও পড়ুন

নির্বাচন নিয়ে সেরা কথাটি বলেছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক। তাঁর ভাষায়, ‘বিদ্যমান ব্যবস্থায় কমিশনের জায়গায় ফেরেশতা এলেও সুষ্ঠু ভোট সম্ভব হবে না।’ ভোটের আগের রাতে ব্যালট পেপার ভোটকেন্দ্রে পাঠালে কী হয়, তা-ও পরিষ্কার করেছেন তিনি। মুজিবুল হক সরাসরি ২০১৮ সালের নির্বাচনের কথা উল্লেখ না করলেও স্বীকার করেছেন, ‘রাতে সিল মেরে রাখা হয়, এটি প্ল্যান করা যায়, ব্যালট পেপার সকালে চলে যাবে। তাহলে রাতের বিষয়টা আসে না। রাতে কিন্তু কাজটা হয়।’ এরপর হাসতে হাসতে তিনি বলেন, ‘হয় মানে কী, কাজটা আমরাই করাইছি। কী বলব, এটা হয়। এ রকম হয় না ঠিক না।’ প্রথম আলো, ১ আগস্ট, ২০২২)

বিএনপিসহ অনেক দল অভিযোগ করে এসেছিল, ২০১৮ সালের নির্বাচনে অনেক কেন্দ্রে রাতেই ভোট হয়েছে। বিবিসিসহ বিদেশি গণমাধ্যমও এ নিয়ে প্রতিবেদন করেছে। টিআইবি ৫০টি আসনের চিত্র দেখিয়েছে তাদের গবেষণা জরিপে। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদাও ইভিএমের পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে বলেছিলেন, এটি ব্যবহার করলে আর রাতে ভোট হবে না।

আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টির মহাসচিবের সত্য ভাষণের পর আওয়ামী লীগের নেতারা কী বলবেন? বিদ্যমান অবস্থা বদল না করলে নির্বাচন কমিশনের জায়গায় ফেরেশতা্ এলেও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয় বলে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। বিদ্যমান অবস্থা কি দলীয় সরকার? বিদ্যমান অবস্থা কি ক্ষমতাসীনদের প্রতি আনুগত্যশীলতা? বিদ্যমান অবস্থা কি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দলীয় কর্মীর ভূমিকায় নামা?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]