বাংলাদেশ কতগুলো মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করবে?

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে বেরিয়ে আসার বা উত্তরণের মতো অর্জন নিয়ে উচ্ছ্বাস সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যৌক্তিকভাবেই থিতিয়ে এসেছে। তার বদলে এই উত্তরণ-পরবর্তী সময়ের সুযোগ-সম্ভাবনা কাজে লাগানো ও বিভিন্ন প্রতিকূলতা মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে তৎপরতা জোরদার হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ জাতিসংঘের এলডিসি তালিকা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বেরিয়ে আসবে। বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তরণের এই তালিকায় আরও আছে নেপাল ও লাওস। সেই সঙ্গে এলডিসি হিসেবে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে যে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত বাজারসুবিধা মিলেছিল, সেটারও অবসান ঘটবে পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে।

তখন ওই সব বাজারে ভারত, পাকিস্তান বা ভিয়েতনামের মতো প্রতিযোগী দেশ যেভাবে শুল্ক দিয়ে পণ্য রপ্তানি করে, বাংলাদেশকেও তাই করতে হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৭০ শতাংশ এখন এই বাজার–সুবিধার আওতায় আছে। পাশাপাশি পণ্য মানের বিষয়ে বাড়তি কড়াকড়ির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা আছে, আছে নানা ধরনের অশুল্ক পদক্ষেপের মুখোমুখি হওয়ার।

এগুলো মোকাবিলা করতে না পারলে বাজার হারানোর ঝুঁকি তৈরি হবে। এলডিসি হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিভিন্ন চুক্তির আওতায় যে ২৫টি বিশেষ ও পৃথক সুবিধা (এস অ্যান্ডডিটি) মিলছে, সেগুলোও কিছু কাটছাট হবে। যেমন রপ্তানিতে ভর্তুকি দেওয়া ও বাণিজ্যের জন্য সহায়তা পাওয়া।

এমতাবস্থায় এলডিসি-পরবর্তী সময়ে রপ্তানির বাজার ধরে রাখা ও তা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করা ও বাণিজ্য জোটে যোগদানের বিষয়টি সঠিকভাবেই এক গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। মানে, কোনো দেশের সঙ্গেই কোনো এফটিএ স্বাক্ষর হয়নি। যদিও কয়েক দিন পরপরই গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয় যে বাংলাদেশ শিগগিরই কোনো না কোনো দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করতে যাচ্ছে বা এই চুক্তি করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে ইত্যাদি।

আরও পড়ুন

আর গত জুনে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে এক প্রশ্নের উত্তরে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন যে সরকার ২৩টি দেশের সঙ্গে এফটিএ এবং অগ্রাধিকার অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (প্রেফারেনশিয়াল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট বা পিটিএ) করার বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে। এর মধ্যে ১০টি দেশ ও ৩টি আঞ্চলিক জোটের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে প্রাথমিক সমঝোতার বা দর–কষাকষির কাজ শুরু হয়েছে। দেশগুলোর মধ্যে আছে—ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা।

বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ বা পিটিএ করা নিয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ ও তৎপরতা অবশ্য অনেক পুরোনো। গত দুই দশকে এ নিয়ে কম আলোচনা-বিতর্ক ও গবেষণা হয়নি। বারবারই মুক্তবাণিজ্য চুক্তির লাভ-ক্ষতির হিসাব কষা হয়েছে।

এলডিসি হিসেবে এত দিন বাংলাদেশ যাদের সঙ্গে এফটিএ নিয়ে আলোচনা করেছে, তাদের কাছে পণ্য রপ্তানিতে অধিক শুল্ক ছাড় চেয়েছে ও পণ্য আমদানিতে কম শুল্ক ছাড় দিতে চেয়েছে। কেননা, দেশের মোট রাজস্ব আয়ের প্রায় ১১ শতাংশ আসে সরাসরি আমদানি শুল্ক থেকে। এটি কমলে তা রাজস্ব আয়ে প্রভাব ফেলবে, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অধিক রাজস্ব আদায়ের চাপ তৈরি হবে। এই চিন্তার ফলে এফটিএ করতে গিয়ে ‘এক পা এগোনো, দু পা পেছানো’-র মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।

তবে যাদের সঙ্গে এই চুক্তি করা হবে, তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরুর পর পুরো বিষয়টি শ্লথ হয়ে গেছে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে পাঁচ বছর আগে দ্বিপক্ষীয় এফটিএ স্বাক্ষরের সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিল, আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও এসেছিল। তারপর তা থমকে যায়। তবে ২০২০ সালের ৬ ডিসেম্বর ভুটানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিপক্ষীয় পিটিএ স্বাক্ষরিত হয়। এখন পর্যন্ত এটাই বাংলাদেশের একমাত্র মুক্তবাণিজ্য চুক্তি, যদিও পিটিএ হলো এফটিএর আগের ধাপ বা আংশিক এফটিএ।

এফটিএ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একটি বড় বাধা হলো শুল্ক ছাড় দেওয়ার ফলে আমদানি শুল্ক কমে যাওয়ার আশঙ্কা। এফটিএর মৌলিক বৈশিষ্ট্যই হলো যে দেশের বাজারে প্রবেশের জন্য শুল্ক ছাড় মিলবে, সেই দেশের পণ্যকেও শুল্ক ছাড় দিতে হবে।

আরও পড়ুন

এলডিসি হিসেবে এত দিন বাংলাদেশ যাদের সঙ্গে এফটিএ নিয়ে আলোচনা করেছে, তাদের কাছে পণ্য রপ্তানিতে অধিক শুল্ক ছাড় চেয়েছে ও পণ্য আমদানিতে কম শুল্ক ছাড় দিতে চেয়েছে। কেননা, দেশের মোট রাজস্ব আয়ের প্রায় ১১ শতাংশ আসে সরাসরি আমদানি শুল্ক থেকে। এটি কমলে তা রাজস্ব আয়ে প্রভাব ফেলবে, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অধিক রাজস্ব আদায়ের চাপ তৈরি হবে। এই চিন্তার ফলে এফটিএ করতে গিয়ে ‘এক পা এগোনো, দু পা পেছানো’-র মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।

আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই অবস্থা থেকে কিছুটা উত্তরণ ঘটেছে। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই উপলব্ধি করেছে যে এতটা রক্ষণশীল অবস্থান নিলে কোনো এফটিও করা যাবে না বা করলেও সুবিধা পাওয়া যাবে না। কারণ, বাংলাদেশ শুল্ক ছাড় না দিলে অন্যপক্ষও ছাড় দেবে না।

তা ছাড়া, ডব্লিউটিওর বিধি অনুসারে চুক্তি সম্পাদনের পর ‘একটি যুক্তিসংগত সময়সীমা’-র মধ্যে যেকোনো মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল বা শুল্কসংঘ বাস্তবায়ন করতে হয় (গ্যাট অনুচ্ছেদ ২৪, ধারা ৫-সি)। আর এই সময়সীমা ১০ বছরের বেশি হলে তা ব্যতিক্রম ধরা হয়, যার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আবার ডব্লিউটিওকে অবহিত করতে হয়। তার মানে হলো, একবারে নয় বরং ধাপে ধাপে শুল্কমুক্ত সুবিধাপ্রাপ্ত পণ্যের আওতা বাড়াতে হয়।

আর দর–কষাকষির মাধ্যমেই এটা ঠিক করতে হবে। এ ছাড়া এফটিএ করা হলে পণ্য আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধার সুযোগ নিয়ে অন্য দেশ থেকে বিভিন্ন পণ্য কম খরচ ও অবাধে বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করতে পারবে। তাতে স্থানীয় কিছু শিল্প স্বাভাবিকভাবেই প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। আর তাই স্থানীয় শিল্প ও ব্যবসার পক্ষ থেকে সংরক্ষণের যুক্তিতে আমদানি শুল্ক ও বিধিনিষেধে ছাড় না দেওয়ার একটা জোর দাবি বা তৎপরতা রয়েছে।

আরও পড়ুন

আবার এটাও খেয়াল রাখা দরকার যে কম খরচে কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানির ফলে শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যয় কমতে পারে, আর প্রস্তুত করা পণ্য আমদানি থেকে ভোক্তারা কিছুটা উপকৃত হতে পারে। সুতরাং পুরো বিষয়টি সঠিকভাবে মোকাবিলা করার কাজটিও কঠিন বটে।

আবার এফটিএ বললে এখন আর শুধু পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত অবাধ সুবিধাকে বোঝায় না। বরং এফটির পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। এফটিএর মধ্য সেবা খাতের বাণিজ্য অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। এই চুক্তিতে এখন শুল্কহার ও পণ্যের উৎসবিধির পাশাপাশি পণ্যের গুণগত মান ও মেধাস্বত্বের সুরক্ষার বিষয় জড়িয়ে গেছে।

আছে বাণিজ্য সহজীকরণের বিষয়টি, যেখানে মূলত ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে দ্রুততম সময়ে আমদানি করা পণ্যের শুল্কায়ন করে সহজে তা বন্দরে খালাস করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ডব্লিউটিওর ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন অ্যাগ্রিমেন্ট বা টিএফএর আওতায় বাংলাদেশসহ সংস্থার সব সদস্য এ জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। এসব চুক্তিতে বিদেশি বিনিয়োগ সুরক্ষার ধারাও এখন যুক্ত করা হচ্ছে।

এফটিএর অর্থ ও পরিধি এখন কতখানিক বিস্তৃত, তার একটি উদাহরণ হলো বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রস্তাবিত কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা) বা সর্বাত্মক অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তি। এতে পণ্য ও সেবা খাতের বাণিজ্য আছে, আছে বিনিয়োগ ও সরকারি ক্রয়।

পাশাপাশি বাণিজ্য বিরোধ নিরসন, পণ্য মানসহ বিভিন্ন অশুল্ক পদক্ষেপ এবং মেধাস্বত্বের বিষয় আছে। এতে জ্বালানি, বাণিজ্য ও ডিজিটাল বাণিজ্যও যুক্ত হতে পারে। মোদ্দা কথা, অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশ কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করবে, সে বিষয়েই এই চুক্তি, যার পরিধি অনেক বড় এবং প্রভাব সুদূরপ্রসারী। একইভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গেও অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি করার কথা ভাবা হচ্ছে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করতে গিয়ে এক দশক আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি কাজ করতে ও প্রস্তুতি নিতে হয়। এমন কিছু বিষয়ও চলে আসছে, যেগুলোয় বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা অল্প ও দক্ষতা সীমিত। আর তাই এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটার আগেই বা আগামী তিন বছরে তিন-চারটার বেশি চুক্তি হবে বলে মনে হয় না। আর তা হলেও এর সুফল দেখতে আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে।

  • আসজাদুল কিবরিয়া সাংবাদিক। ই–মেইল: [email protected]