‘তারা আমাকে বাধ্য করেছিল তাদের মতো করে চুল আঁচড়াতে’—বাক্যটি হুমায়ুন আজাদ যখন উচ্চারণ করেন, তখন ত্রিভুবনের সব প্রপঞ্চ থরথর করে কেঁপে ওঠে। কারণ, স্বাধীন হয়ে জন্ম নেওয়া মানুষের পায়ে যখন শৃঙ্খল পরিয়ে দেয় রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার, তখন সেই বেদনার সীমা–পরিসীমা থাকে না। কেন তিনি স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছেন না, কীভাবে সব দিক থেকে শৃঙ্খলিত হয়ে পড়ছেন, এর একটি দীর্ঘ তালিকা আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন হুমায়ুন আজাদ। বলছেন, ‘আমি আমার মতো দাঁড়াতে পারিনি—ওরা আমাকে নির্দেশ দিয়েছিল ওদের মতো মাথা নিচু করে দাঁড়াতে, আমি ওদের সময়ে আমার মতো দিঘি খুঁড়েছিলাম ব’লে আমার দিঘিতে পানি ওঠেনি, আমার বাগানে একটিও ফুল ফোটেনি।’ বলছেন, ‘এমনকি নিজের নিশ্বাসটাও আমি নিতে পারিনি।’ তিনি তখন উপলব্ধি করেন, তিনি আসলে ভুল বৃক্ষে ফুটেছিলেন, ভুল সময়ে জন্মেছিলেন। তিনি আরও উপলব্ধি করেন, যে পৃথিবীকে তিনি চেয়েছিলেন, তা তো তাঁর পাওয়ার কথা নয়, কারণ তাঁর সময় তখনো আসেনি। পরিশেষে উপসংহার টানেন, তিনি ভুল সময়ে জন্মেছিলেন, বেঁচে ছিলেন অন্যদের সময়ে।
আমরা ভুলে যাই যে ৫২-র ভাষা আন্দোলন এবং দুই দশকের স্বাধীনতা আন্দোলনে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত অধিকারের সঙ্গে কথা বলার অধিকারও যুক্ত। মতপ্রকাশের তথা কথা বলার ও লেখার অধিকার ছাড়া অন্য সব অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। এ জন্য শুধু লেখক বা কবি-সাহিত্যিকই নন, সমাজের প্রতিটি মানুষেরই কথা বলার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বস্তরের মানুষের বক্তব্য সব রাজনৈতিক সংগঠনকে এবং সরকারকে শুনতে হবে। রাজনৈতিক সংগঠনকে কালের স্পন্দন বুঝতে হবে, আর কালের স্পন্দন মানেই মানুষের স্পন্দন। বস্তুত, রাজনীতির জন্য প্রয়োজনীয় যে জ্ঞান, তার উৎস হলো মানুষ। হুমায়ুন আজাদ থেকে শুরু করে অভিজিৎ রায় পর্যন্ত এবং গত ২৫ ফেব্রুয়ারি আটকাবস্থায় মৃত লেখক মুশতাক আহমেদের অপরাধ কী? তাঁদের অপরাধ হলো, তাঁরা এমন কিছু কথা বলতে চেয়েছিলেন, যা সমাজের কিছু লোকের পছন্দ নয়। সেটা হতে পারে পরকালের চেয়ে ইহকালকে বড় করে দেখা, হতে পারে নিরীশ্বরবাদের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন, অথবা ভাবের চেয়ে বিজ্ঞানকে গুরুত্ব প্রদান বা সরকারের সমালোচনা।
বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ধর্ম অবমাননা আইন যাঁরা প্রণয়ন করেছেন, এর একটা বড় অংশ দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার মূল চেতনা, মানুষের মুক্তি তথা ব্যক্তির লিবার্টির বিপরীতে গিয়ে এই আইন প্রণয়ন করেছেন তাঁরা। এর মানে হলো, লিবার্টি ছাড়া যে ভৌগোলিক স্বাধীনতার কোনো মূল্য নেই, তা তাঁরা মানেন না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও ধর্ম অবমাননা আইনের দোহাই দিয়ে অসংখ্য মানুষকে সরকার শাস্তি দিয়েছে, তাঁদের হত্যা করতেও প্ররোচনা জোগাচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাংলা প্রবন্ধেও ইংরেজি ‘নেশন’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। কারণ, ‘নেশন’-এর সম্পূর্ণ ব্যঞ্জনা এর বাংলা প্রতিশব্দ ‘জাতি’ পুরোপুরি ধারণ করে না। আমিও ইংরেজি থেকে সরাসরি ‘লিবার্টি’ শব্দটি ব্যবহার করতে চাই, কারণ এর জুতসই কোনো বাংলা শব্দ আমার জানা নেই। লিবার্টিকে ব্যক্তির স্বাধীনতা বলা যেতে পারে। আরও একটু পরিষ্কার করে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির’ অর্থাৎ নির্ভয়ে কথা বলার, কাজ করার ও নিজের ইচ্ছেমতো জীবন পরিচালনা করার সক্ষমতা ব্যক্তির লিবার্টি নির্দেশ করে। অমর্ত্য সেন যেটাকে বলছেন ‘ফাংকশনিংজ’, অর্থাৎ যে যা করতে চায়, তা করতে পারার সক্ষমতা সুখের অন্যতম প্রধান উপাদান।
বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ মত প্রকাশে বিরোধী অন্যান্য আইন যাঁরা প্রণয়ন করেছেন, এর একটা বড় অংশ দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার মূল চেতনা, মানুষের মুক্তি তথা ব্যক্তির লিবার্টির বিপরীতে গিয়ে এসব আইন প্রণয়ন করেছেন তাঁরা। এর মানে হলো, লিবার্টি ছাড়া যে ভৌগোলিক স্বাধীনতার কোনো মূল্য নেই, তা তাঁরা মানেন না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও ধর্ম অবমাননা আইনের দোহাই দিয়ে অসংখ্য মানুষকে সরকার শাস্তি দিয়েছে, তাঁদের হত্যা করতেও প্ররোচনা জোগাচ্ছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ এ সংক্রান্ত অন্যান্য আদতে সরকারের দমননীতিরই বহিঃপ্রকাশ আর দমননীতি সমর্থন করা মানে মানুষের লিবার্টির বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া, যা দেশের স্বাধীনতার মূল চেতনার পরিপন্থী। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, অনেক মুক্তিযোদ্ধাই মানুষের লিবার্টি তথা কথা বলা ও লেখার অধিকার কেড়ে নেওয়াকে সমর্থন করেন কখনো সরকারের নীতি সমর্থন করে, আবার কখনোবা সরাসরি বাধা দিয়ে। নিজের জীবনের কয়েকটি নজির উপস্থাপন করে বিষয়টি ব্যাখ্যা করি।
কানাডার মন্ট্রিয়ল শহরে অবস্থানকালে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বিভিন্ন সময়ে আমাকে বক্তৃতা রাখার জন্য ডেকেছেন মন্ট্রিয়লের বাঙালিরা। ২০২১ সালে ‘কোভিড ১৯’–বিষয়ক একটি বইয়ের প্রকাশনা উপলক্ষে আমাকে বক্তৃতা রাখতে বলা হয়েছিল। এখানে আমার বক্তব্য ছিল অনেকটা এ রকম—বিজ্ঞান জানাই যথেষ্ট নয়। দেশের মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে। না হলে বিজ্ঞানের আবিষ্কার কোনো কাজে আসবে না। তারপর কোভিডকালে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদির নীতির সমালোচনার পাশাপাশি বাংলাদেশে মাদ্রাসাশিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর সরকারি নীতির সমালোচনা করতেই মঞ্চের সামনে বসা দুই ভদ্রলোক প্রতিবাদ করলেন। আমার বক্তৃতার শেষে সভার সভাপতি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কোভিড ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে কেউ কোনো কথা বলবেন না।’ এতে তিনি ওই প্রতিবাদকারীদেরই পক্ষ নিলেন।
আর একবার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বক্তৃতা রাখতে গিয়ে আমি যখন বললাম, ‘যে বঙ্গবন্ধু সারা জীবন গণতন্ত্রের লড়াই করলেন এবং বাংলাদেশকে চমৎকার সংবিধান উপহার দিলেন, সেই তিনিই ’৭৪ সালে নিজ হাতে সংবিধান লঙ্ঘন করে একদলীয় শাসনব্যবস্থার সূচনা করলেন।’ আমার বক্তৃতার সঙ্গে সঙ্গে এক ভদ্রলোক আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করলেন।
আমার মন্ট্রিয়ল শহরের তিক্ত অভিজ্ঞতা এখানেই শেষ নয়, তবে এখানেও এমন কিছু মানুষের সন্ধান পেয়েছি, যাঁদের মস্তিষ্কে রয়েছে দেশ, জাতি, পতাকা, মুক্তিযুদ্ধ আর বাঙালি সংস্কৃতি, যাঁদের মন পড়ে থাকে প্রিয় জন্মভূমিতেই। তাঁদেরই একজন ড. রুমানা নাহিদ সোবহান। স্বদেশে যখন ‘ছোট পোশাক, বড় পোশাক’ নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে, তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। বললেন, বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষা করতেই হবে আর সব সম্প্রদায়ের মধ্যে মেলবন্ধন স্থাপন করতে হবে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ রাখিবন্ধন উৎসব আয়োজন করেছিলেন। তাঁরই অনুকরণে ড. রুমানা মন্ট্রিয়লের নিজের বাড়ি, ‘সোনার তরীতে’ ধর্মীয় সম্প্রীতি স্থাপনে আয়োজন করলেন রাখিবন্ধনের। ডাকলেন সব ধর্মের মানুষকে। একে অপরকে রাখি পরিয়ে দেওয়ার পর আমাকে বলা হলো বক্তৃতা রাখতে। আমি সংস্কৃতি ও ধর্ম বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানের আলোকে দীর্ঘ বক্তৃতা করতে চেয়েছিলাম। উপস্থিত সবাই যখন পিনপতন নীরবতায় আমার কথা শুনছিলেন, এক ভদ্রলোক আমাকে হঠাৎ থামিয়ে দিলেন।
কোভিড-১৯–বিষয়ক বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানের ওই সভাপতিসহ ওপরের সব ঘটনায় যাঁরা আমাকে বাধা দিয়েছেন, আমাকে আমার কথাটা বলতে দেননি, তাঁদের সবাই বীর মুক্তিযোদ্ধা। যাঁরা জীবন বাজি রেখে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। তাঁরাই আজকের বাংলাদেশে ব্যক্তির লিবার্টির হরণ করছেন। অথচ আজ কথা বলা খুব দরকার। মিথ্যাবাদীরা যখন মিথ্যা বারবার উচ্চারণ করেন, তখন সত্য উচ্চারণের কাজটা তো কাউকে না কাউকে করতেই হবে। না হলে সত্য প্রতিষ্ঠা বিলম্বিত হয়ে যেতে পারে বহুকাল। মিথ্যাবাদীরা যে কতটা সক্রিয়, তা পাবলো নেরুদা টের পেয়েছিলেন আর লিখেছিলেন এক মর্মস্পর্শী কবিতা:
‘ওরা মিথ্যাবাদী, যারা বলেছিল আমি হারিয়েছি নিবিড় জ্যোৎস্না,
বলেছিল আমার ভবিষ্যৎ হা হা মরু-বালুময়,
যারা ঠান্ডা জিহ্বায় ছড়িয়েছিল নির্দয় গুজব,
নিষিদ্ধ করেছিল বিশ্বের স্বাভাবিক ফুল।’
যাঁরা আজকে আমাদের কথা বলতে বাধা দিচ্ছেন, তাঁরা আদতে বাধা দিচ্ছেন শিশু-কিশোরদের মনের স্বাভাবিক বিকাশকে আর বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটিকে রাখতে চান পশ্চাৎপদ করে।
হুমায়ূন আজাদের মতো আমার মুখেও তাঁরা গুলে দিতে চান দূষিত কথামালা, তাঁরা চান আমিও তাঁদের মতো করে তাঁদের ভাষায় কথা বলি। বারবার মনে হয়, হুমায়ুন আজাদকে ডাক দিয়ে বলি, আপনি যেখানে চলে গেছেন, ওখানে কি আমাকেও একটু নিয়ে যেতে পারবেন? একটু কি জায়গা হবে?
ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected]