বিগত কয়েক সপ্তাহে প্রথম আলো পত্রিকায় গণভোট নিয়ে বেশ কয়েকটি লেখা পড়ে মনে হলো এ বিষয়ে আরও গবেষণাধর্মী লেখার প্রয়োজন রয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সিপিডি পার্লামেন্টারি স্টাডিজের পক্ষ থেকে গণভোট–সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের বেশ কিছু বিশ্লেষণের ভিত্তিতে আজকের লেখাটি তৈরি করা হয়েছে। এ লেখাটি তৈরিতে অন্তর্বর্তী সরকারের নিম্নলিখিত দলিলগুলো বিবেচনা করা হয়েছে— (ক) জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫, (খ) জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং (গ) জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ অনুসারে সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত কিছু প্রস্তাবের বিষয়ে জনগণের সম্মতি রয়েছে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য গণভোটের বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত অধ্যাদেশ। এ তিনটি দলিলের মধ্যে প্রথমটি—জুলাই জাতীয় সনদটি একটি রাজনৈতিক দলিল। এ সনদে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অংশগ্রহণকারী ৩৩টি দল/জোটের মধ্যে ২৪টি দল/জোট স্বাক্ষর করেছে। তবে জাতীয় নাগরিক পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ এবং চারটি বামঘেঁষা দল এ সনদে এখনো স্বাক্ষর করেনি। দ্বিতীয় ও তৃতীয়টি হলো দুটি অধ্যাদেশ, যা রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে সরকার জারি করেছে। অধ্যাদেশ হিসেবে জারি করার কারণে এ দুটি দলিল আগামী জাতীয় সংসদে অনুমোদনের প্রয়োজন পড়বে—যা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ গঠনের পর প্রথম অধিবেশনে উত্থাপন করে সংসদের অনুমোদন নিতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের এ তিনটি দলিলে মূলত জুলাই সনদের আলোকে আগামী দিনের জন্য আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য স্বাধীন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে করণীয় বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের আকাঙ্ক্ষা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের নীতি ও প্রক্রিয়াগত সিদ্ধান্তগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। এ তিন দলিলের আলোকে গণভোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিছু বিষয়ের ওপর জনরায় গ্রহণ করে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর একটা জনভিত্তি গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের আগামী গণভোটকে সংবিধান সংস্কার–বিষয়ক গণভোট বলা হলেও গণভোটের প্রশ্নটি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় সেখানে সাংবিধানিক বিষয়ের পাশাপাশি আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং শাসন বিভাগের কার্যক্রম সম্পর্কিত সর্বমোট ১২২টি বিষয়ের ওপর জনগণের মতামত চাওয়া হচ্ছে। এত বিপুলসংখ্যক বিষয়ে জনগণের মতামত নেওয়া সম্পূর্ণ অবাস্তব। গণভোটের বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়— এগুলো জটিল এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিষয় সম্পর্কে উপযুক্ত জ্ঞান থাকা দরকার। এসব জটিল বিষয়ে একক ‘বাইনারি’ মতামতের মাধ্যমে গণভোটের আয়োজনের ফলে জনগণের পক্ষে বোধগম্যভাবে তার মতামত দেওয়া কার্যত অসম্ভব।
গণভোট: গত ১৩ নভেম্বর ২০২৫–এ জারিকৃত জুলাই সনদ সম্পর্কিত অধ্যাদেশের ৩ নং, ৪ নং, ৫ নং ও ৬ নং অনুচ্ছেদে গণভোট অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয় আইনি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ৫ নং অনুচ্ছেদে গণভোটের ব্যালটে উপস্থাপনীয় প্রশ্নটি উল্লেখ রয়েছে। বর্তমান প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয় এ প্রশ্নটিকে ঘিরে। গণভোট নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক আলোচনায় বলা হচ্ছে—গণভোটে চারটি প্রশ্নের ওপর সম্মিলিতভাবে একটি (‘হ্যাঁ’/‘না’) ভোট দিয়ে জনগণ তাঁদের মতামত জানাতে বাধ্য হবেন। এ রকম প্রশ্নের কারণে জনগণ চারটি প্রশ্নের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদাভাবে তাঁদের মতপ্রকাশের সুযোগ পাবেন না। বরং একটি মাত্র উত্তর অপশন থাকার কারণে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জনগণের প্রকৃত মূল্যায়ন জানা সম্ভব হবে না। কোনো কোনো প্রবন্ধে একটি প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠান করার সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করা হলেও বৃহত্তর স্বার্থে এভাবেই গণরায় মেনে নেওয়ার বিষয়টি মেনে নেওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে।
গণভোটে আসলে কয়টি প্রশ্ন? গণভোটের প্রশ্নটি আলাদাভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। সিপিডির গবেষণায় প্রশ্নটি বিশ্লেষণ করে গণভোট–সংক্রান্ত বিষয়গুলোর গভীরতা, জটিলতা ও দীর্ঘমেয়াদি অভিঘাত ফুটে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে একটি হ্যাঁ বা না উত্তরের মাধ্যমে এর সরলীকৃত সমাধান খোঁজার সুযোগ নেই বলে প্রতীয়মান হয়। গণভোটের প্রশ্নটি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে এ প্রশ্নে অনেকগুলো অংশ রয়েছে, যা গভীর পর্যালোচনার দাবি রাখে।
গণভোটের প্রশ্নে তিনটি বৃহদাকার ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে জনসম্মতি চাওয়া হচ্ছে। এগুলো হলো—(ক) জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান) সংস্কার বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫-এর জন্য সম্মতি; (খ) জুলাই সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত কিছু প্রস্তাবের ব্যাপারে সম্মতি; এবং (গ) জুলাই জাতীয় সনদে বর্ণিত অপরাপর সংস্কার সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক তা বাস্তবায়নের ব্যাপারে সম্মতি। এ তিনটি অংশের মধ্যে জুলাই সনদ সম্পর্কিত বিষয় সংযুক্ত রয়েছে ৮৪টি। এর সঙ্গে গণভোটের অধ্যাদেশের ২৩টি অনুচ্ছেদ এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন অধ্যাদেশের ১৫টি অনুচ্ছেদ যোগ করলে সর্বমোট ১২২টি বিষয়/অনুচ্ছেদ বিষয়ে জনগণের মতামত চাওয়া হচ্ছে আলোচ্য গণভোটে। এর অর্থ দাঁড়ায় জনগণকে চারটি বিষয়ে নয়, সর্বমোট ১২২টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হবে মাত্র একটি প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমে—যা হাস্যকর।
অন্তর্বর্তী সরকারের তিনটি দলিল ধরে বিস্তারিত আলোচনা করলে বিভিন্ন দুর্বলতা ফুটে উঠবে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন অধ্যাদেশে সর্বমোট ১৫টি বিষয়ে অনুচ্ছেদ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—(ক) জুলাই সনদে বর্ণিত সংবিধান সংস্কার গণভোট; (খ) গণভোটে উপস্থাপনীয় প্রশ্ন; (গ) গণভোট অনুষ্ঠান; (ঘ) গণভোটের জন্য আইন প্রণয়ন; (ঙ) সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের কার্যাবলি ও বিলুপ্তি; (চ) শপথ ও শপথ পাঠ পরিচালনা; (ছ) পরিষদের সভা প্রধান; (জ) পরিষদের অধিবেশন আহ্বান, কোরাম, ভোট দান; (ঝ) পরিষদ ও উহার সদস্যদের দায়ভুক্তি; (ঞ) জুলাই জাতীয় সনদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ; (ট) পরিষদ কর্তৃক সংবিধান সংস্কার অবিলম্বে কার্যকর করা; (ঠ) পরিষদ কর্তৃক সংবিধান সংস্কার চূড়ান্তকরণ ও প্রকাশ এবং (ড) সরকার কর্তৃক নির্দেশনা জারি। বলা হয়েছে, এ অধ্যাদেশের কিছু কিছু অনুচ্ছেদ অবিলম্বে কার্যকর হবে। এগুলো হলো— ওপরে বর্ণিত (ক), (খ), (গ), (ঘ), (ঞ) এবং (ড) অনুচ্ছেদ। বাকি অনুচ্ছেদগুলো গণভোটের ইতিবাচক ফলাফল সাপেক্ষে সরকারি গেজেটে প্রকাশের তারিখে কার্যকর হবে। এ অনুচ্ছেদগুলো হলো— (ঙ), (চ), (ছ), (জ), (ঝ), (ট) এবং (ঠ)। এ অনুচ্ছেদগুলো মূলত সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন সম্পর্কিত। এ অধ্যাদেশ থেকে বোঝা যায়, গণভোটে চারটি প্রশ্নের বাইরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনগণকে ভোট দিতে হচ্ছে, যা তাঁদের কাছে এখনো অজানা। যার মধ্যে রয়েছে—জুলাই সনদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্তি, সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে আগামী সংসদের কার্যক্রম পরিচালনা এবং পরিষদ সদস্যদের দায়মুক্তি ইত্যাদি। এ ছাড়া জনগণ অধ্যাদেশ মোতাবেক কিছু বিষয়ে তাৎক্ষণিক বাস্তবায়ন এবং কিছু বিষয় গণভোটের ফলাফল সাপেক্ষে বাস্তবায়ন বিষয়ে মতামত দেবেন।
এবার আসা যাক গণভোট অধ্যাদেশ বিষয় সম্পর্কে। গণভোট অধ্যাদেশে বর্ণিত রয়েছে মোট ২৩টি অনুচ্ছেদ। বর্ণিত অনুচ্ছেদের মধ্যে রয়েছে—(ক) গণভোটের প্রশ্ন; (খ) ভোটকেন্দ্র; (ঘ) প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ও পোলিং অফিসার নিয়োগ; (ঙ) ভোটার ও ভোটার তালিকা; (চ) গণভোট গ্রহণের সময়; (ছ) মূলতবি ভোট গ্রহণ; (জ) ভোটদান পদ্ধতি; (ঝ) ব্যালট বাক্স; (ঞ) ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ, শৃঙ্খলা, নষ্ট ও বাতিল ব্যালট পেপার; (ট) ভোট গ্রহণ সমাপ্তির পর অনুসরণীয় পদ্ধতি; (ঠ) ফলাফল একীভূতকরণ; (ড) ফলাফল ঘোষণা; (ঢ) পোস্টাল ব্যালটে ভোট গ্রহণ; (ণ) কমিশনের আদেশ জারির ক্ষমতা; (ত) নির্বাচন কমিশনের পরিপত্র জারি করার ক্ষমতা; (থ) কমিশনকে সহায়তা প্রদান; (দ) অপরাধ, দণ্ড ও বিচারপদ্ধতি; (ধ) দায়মুক্তি; এবং (ন) বিধি প্রণয়ন। এ অধ্যাদেশটি মূলত গণভোট আয়োজন–সংক্রান্ত হলেও এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—নির্বাচন কমিশনকে গণভোট আয়োজনের জন্য দায়মুক্তি দেওয়া–সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ। অধ্যাদেশের শেষে জুলাই জাতীয় সনদে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে তার একটি তালিকা সন্নিবেশিত রয়েছে। এ তালিকাটি যেহেতু আইনি দলিল, তাই গণভোটের অধ্যাদেশের বিষয়টি গণভোটে জনমতামত নেওয়ার ক্ষেত্রে আলাদা গুরুত্ব বহন করে।
গণভোট অধ্যাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—এর সংযুক্তি তালিকায় থাকা জুলাই সনদে ঐকমত্য পোষণ করা বিষয়গুলো। আগেই বলা হয়েছে, জাতীয় সনদে মোট ৩৩টি দল/জোটের মতামত দেওয়া ও স্বাক্ষর করার কথা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—যে ৩৩টি দল ও জোট ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অংশ নিয়েছে, তাদের সবাই কোনো একটি বিষয়েও সর্বসম্মত ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে নিম্নরূপ—(ক) বিভিন্ন বিষয়ে দলগুলোর ভিন্ন অবস্থান থাকা; (খ) বিভিন্ন বিষয়ে দলগুলোর ‘নোট অব ডিসেন্ট’ থাকা এবং (গ) বিভিন্ন বিষয়ে দলগুলোর কোনো অবস্থান না থাকা। তবে সর্বোচ্চ ৩২টি দল ও জোট ঐকমত্য হয়েছে মাত্র একটি বিষয়ে—তা হলো সনদে বর্ণিত ১ নং বিষয় রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত বিষয়। সর্বোচ্চ ৩১টি দল ও জোট পাঁচটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে— তা হলো: (ক) ডেপুটি স্পিকার পদে বিরোধী দল থেকে মনোনয়ন; (খ) আপিল বিভাগের বিচারক সংখ্যা; (গ) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা; (ঘ) বিচারকদের চাকরির নিয়ন্ত্রণ; এবং (ঙ) সাংবিধানিক ও আইনগত ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে সংবিধান সংশোধন। ওপরে বর্ণিত বিষয়গুলোর মধ্যে অন্তত দুটি বিষয়ে জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য আলাদা নোট সংযুক্ত রয়েছে। এ নোটে বলা হয়েছে— ‘এসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী ইশতেহার মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে পারবে।’ এ ধরনের শর্তযুক্ত রাজনৈতিক ঐকমত্যের বিষয়গুলোকে গণভোটে আওতাভুক্ত করার মাধ্যমে ভিন্নমতের বিভিন্ন বিষয়কে অন্যান্য বিষয়ের মতো সমানভাবে দেখার জন্য দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলো।
অধ্যাদেশে এমন কিছু বিষয়কে ঐকমত্য বলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন বেশ কম ছিল। জুলাই সনদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ঐকমত্য পোষণকারী বিষয়ের মধ্যে ৩৩টি দল/জোটের মধ্যে মাত্র ২৩টির সমর্থন রয়েছে সনদে বর্ণিত ক্রমিক নং ৪ ‘ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি’ বিষয়ে। ২৫টি দল/জোটের সমর্থন রয়েছে ‘আইন সভা গঠনসংক্রান্ত’ বিষয়ে। ২৪টি দল জোটের সমর্থন রয়েছে ‘উচ্চকক্ষের সদস্যদের যোগ্যতা ও অযোগ্যতা’ বিষয়ে। ২৬টি দল/জোটের সমর্থন রয়েছে ‘জাতীয় সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি সংক্রান্ত’ বিষয়ে। ঐকমত্য হিসেবে ঘোষিত তালিকায় বেশ কিছু বিষয়ে দলগুলোর ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তালিকায় বর্ণিত ৫ নং বিষয় ‘জরুরি ব্যবস্থা ঘোষণা’; ৬ নং বিষয় ‘সব সম্প্রদায়ের সহাবস্থান’; ৭ নং বিষয় ‘মৌলিক অধিকারসমূহের তালিকা সম্প্রসারণ’; ৮ নং বিষয় ‘রাষ্ট্রপতি নির্বাচন’; ৯ নং বিষয় ‘রাষ্ট্রপতির অভিশংসন’; ১২ নং বিষয় ‘দ্বিকক্ষীয় আইনসভা গঠন’; ১৫ নং বিষয় ‘নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির পদ্ধতি’; ১৮ নং বিষয় ‘সীমানা পুনর্নির্ধারণ’; ২০ নং বিষয় ‘প্রধান বিচারপতি নিয়োগ’; ২৩ নং বিষয় ‘বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ’। এমনকি কিছু কিছু বিষয়ে বিরোধিতাও রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর; তালিকায় বর্ণিত ২ নং বিষয় ‘নাগরিকের পরিচয়’; ৩ নং বিষয় ‘সংবিধান বিলুপ্তি’; ৪ নং বিষয় ‘ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি’; ১৬ নং বিষয় ‘ডেপুটি স্পিকার পদে বিরোধী দল থেকে মনোনয়ন’; ১৪ নং বিষয় ‘বিচারকের চাকরির নিয়ন্ত্রণ’; ২৫ নং বিষয় ‘স্থায়ী আটর্নি সার্ভিস গঠন’; ২৬ নং বিষয় ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তহবিল সংগ্রহ’; এবং ৩০ নং বিষয় ‘সংসদ সংসদের কমিটি এবং সদস্যদের অধিকার, অধিকারের সীমা ও দায়’। এত বিপুলসংখ্যক বিষয়ের ক্ষেত্রে দ্বৈততার বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করে সে বিষয়কে ‘সাধারণ ঐকমত্য’ হিসেবে গণভোটের অধ্যাদেশে অন্তর্ভুক্ত করা সঠিক হয়নি। এসব দুর্বলতাকে উপেক্ষা করে এ বিষয়গুলোকে আবার গণভোটের প্রশ্ন আকারে ‘ঐকমত্য’ ঘোষিত বলে জনরায়ের জন্য উপস্থাপনের বিষয়টি ত্রুটিপূর্ণ।
এবার বিশ্লেষণ করা যাক, জুলাই জাতীয় সনদে বর্ণিত সংবিধান সম্পর্কিত প্রস্তাব হিসেবে যে চারটি প্রশ্ন করা হয়েছে তা নিয়ে। বলা ভালো, এগুলো কোনো ‘একক প্রশ্ন’ নয় বরং চারটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নগুচ্ছ। প্রথম প্রশ্নে অন্তর্ভুক্ত জুলাই সনদের বিষয়গুলো হলো—(ক) নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, (খ) নির্বাচন কমিশন এবং (গ) অন্যান্য সংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, যা জুলাই সনদে বর্ণিত তাদের গঠনপ্রক্রিয়া–সংক্রান্ত। অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে—(ঘ) ন্যায়পাল নিয়োগ–সংক্রান্ত, (ঙ) সরকারি কর্ম কমিশন নিয়োগ–সংক্রান্ত, (চ) মহাহিসাব নিরীক্ষক নিয়োগ–সংক্রান্ত, (ছ) দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়োগ–সংক্রান্ত বিষয়াদি। দ্বিতীয় প্রশ্নে রয়েছে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন সম্পর্কে মোট চারটি বিষয়। এগুলো হলো— (ক) দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, (খ) ১০০ সদস্যবিশিষ্ট উচ্চকক্ষ গঠন, (গ) নিম্নকক্ষের প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের সদস্য নিয়োগ–সংক্রান্ত, এবং (ঘ) সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন। এখানে বলে নেওয়া ভালো—উচ্চকক্ষ–সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন দলের ভিন্ন ভিন্ন মত এবং ‘নোট অব ডিসেন্ট’-এর বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো—তৃতীয় প্রশ্নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে উপরোক্ত বিষয়গুলো মেনে চলার একধরনের বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়েছে, যা অন্যান্য প্রশ্নগুলোর ক্ষেত্রে নেই। আগেই বলা হয়েছে—তৃতীয় প্রশ্নে উচ্চকক্ষ গঠনের ক্ষেত্রে জুলাই সনদের ঐকমত্যের বিষয়গুলোতে ব্যাপক ভিন্নমত রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে গণভোটের ফলাফলের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা মোটেও যথোপযুক্ত নয়। তৃতীয় প্রশ্নে জুলাই জাতীয় সনদে ৩০টি ঐকমত্যের বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। আগেই আলোচিত হয়েছে—খুব অল্পসংখ্যক বিষয়েই সর্বোচ্চ ঐকমত্য রয়েছে, যেগুলোকে ঐকমত্য বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। চতুর্থ প্রশ্ন জুলাই সনদের বাকি ৫৪টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর তাদের নিজস্ব প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান রয়েছে।
এ রকম পরিস্থিতিতে গণভোট আয়োজন হলে জনগণকে বেশ বড়সংখ্যক বিষয়ে না জেনেই গণরায়ে অংশ নিতে হবে। আলোচিত দুই অধ্যাদেশ ও জুলাই সনদের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো আগামী দিনে জাতীয় সংসদে গেলে ও সরকার গঠন করলে তাদের তিন ধরনের আইনি/নৈতিক দায় গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে দুটি অধ্যাদেশের ৩৮টি (১৫+২৩) অনুচ্ছেদের ক্ষেত্রে সংসদে দলগুলোর আইনি দায়বদ্ধতা থাকবে, তা পাস করার। জুলাই সনদে বর্ণিত (৩০+৫৪) ৮৪টি বিষয়ের ক্ষেত্রে আইনি ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা থাকবে, তা মেনে চলার। গণভোটে অন্তর্ভুক্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর গণদায়বদ্ধতা থাকবে। প্রশ্ন হলো—গণভোটের একটি মাত্র উত্তর (হ্যাঁ/না) ভোটের মাধ্যমে দিয়ে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ ফলাফলের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকে এত বিপুলসংখ্যক বিষয়ে দায়বদ্ধ করা সঠিক নয় বলে প্রতীয়মান হয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—বিভিন্নমুখী ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মতের ভিন্নতা রয়েছে, এমন বিষয়গুলোকে একত্র করে ‘গণভোট’ অনুষ্ঠানকে প্রকৃত অর্থে ‘গণভোট’ বলা যায় না। বিভিন্ন দেশের গণভোট বিশ্লেষণে দেখা যায়, গণভোট সাধারণত একটি একক বিষয়ের ওপর হয়ে থাকে, যা দেখা গেছে, আয়ারল্যান্ডে, বাংলাদেশে (১৯৭৭), পাকিস্তানে (১৯৬০, ১৯৮৪ ও ২০০২) এবং অস্ট্রেলিয়ায়। আবার একাধিক প্রশ্নযুক্ত/বিষয়যুক্ত ক্ষেত্রেও গণভোট আয়োজন করতে দেখা গেছে— লিথুয়ানিয়ায় ৪টি প্রশ্নে (১৯৯৬), এবং বেলারুশে ৭টি প্রশ্নে (১৯৯৬)। তবে সেসব ক্ষেত্রে প্রতিটি প্রশ্নের জন্য আলাদা আলাদা মতামত চাওয়া হয়েছে গণভোটে। এ ছাড়া গণভোটের প্রশ্নে বিভিন্ন দেশে হ্যাঁ/না ছাড়াও বহুনির্বাচনী প্রশ্ন, অথবা তুলনীয় পছন্দ নির্ধারণের জন্য প্রশ্ন বা ব্যবস্থা দেখা গেছে। তবে সেসব গণভোটের ক্ষেত্রে জনগণের প্রশ্ন ও উত্তর সম্পর্কে পর্যাপ্ত সচেতনতা ও বিষয়জ্ঞান থাকা দরকার। বিশ্বে গণভোট অনুষ্ঠানের সময়কালের ক্ষেত্রে দুই রকমের প্রবণতা দেখা যায়। একটি হলো— গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আইন প্রণয়ন-পূর্ব সময়কালে গণভোট আয়োজন (যেমন, স্কটল্যান্ড, ১৯৭৭) এবং আরেকটি হলো— গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আইন প্রণয়ন–পরবর্তী সময়কালে গণভোট আয়োজন (যেমন আয়ারল্যান্ড)। সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেশগুলো নির্ভর করেছে বিষয়ের গুরুত্বের ক্ষেত্রে গণরায় নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার নিরিখে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিষয় নির্ধারণে গণভোটে দুই ধরনের প্রবণতা দেখা যায়। একটি হলো—সাংবিধানিক বিষয়–সংক্রান্ত ক্ষেত্রে গণভোট, এবং আরেকটি হলো—আইনগত বিষয়ের ক্ষেত্রে গণভোট। তবে গণভোটের সাংবিধানিক ভিত্তি/আইন ভিত্তি কতটুকু হবে তা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম দেখা যায়। আয়ারল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াতে সাংবিধানিক বিষয়ের গণভোটের রায় ইতিবাচক হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই বিষয়গুলো সংবিধানে সংযোজন করতে দেখা যায়। অন্যান্য দেশে গণভোটের মর্যাদার ওপর নির্ভর করে গৃহীত বিষয়ের ক্ষেত্রে আইনি ভিত্তি কতটা শক্তিশালী হবে তা নির্ধারণ করতে দেখা গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গণভোটের পর তা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ঐক্যমত্য দরকার হয়েছে।
বাংলাদেশের আগামী গণভোটকে সংবিধান সংস্কার–বিষয়ক গণভোট বলা হলেও গণভোটের প্রশ্নটি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় সেখানে সাংবিধানিক বিষয়ের পাশাপাশি আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং শাসন বিভাগের কার্যক্রম সম্পর্কিত সর্বমোট ১২২টি বিষয়ের ওপর জনগণের মতামত চাওয়া হচ্ছে। এত বিপুলসংখ্যক বিষয়ে জনগণের মতামত নেওয়া সম্পূর্ণ অবাস্তব। গণভোটের বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়— এগুলো জটিল এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিষয় সম্পর্কে উপযুক্ত জ্ঞান থাকা দরকার। এসব জটিল বিষয়ে একক ‘বাইনারি’ মতামতের মাধ্যমে গণভোটের আয়োজনের ফলে জনগণের পক্ষে বোধগম্যভাবে তার মতামত দেওয়া কার্যত অসম্ভব।
এ রকম একটি গণভোটের মাধ্যমে (যদি ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হবে ধরে নেওয়া যায়) রাজনৈতিক দলগুলোকে বিভিন্ন বিষয়ে যে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে, তা কতটা যৌক্তিক? প্রকৃতার্থে এ রকমভাবে জনগণের মতামত নেওয়া জনভাবনার প্রতি অসম্মান করার নামান্তর। সবশেষে প্রশ্নটি ওঠে— কেন এভাবে গণভোট আয়োজন করা হচ্ছে? যে ১২২টি বিষয় নিয়ে এ গণভোট, এগুলোর ক্ষেত্রে সুদীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে জাতীয় সংসদে। দেখা গেছে, যেসব দেশে সংসদে এক কক্ষ থেকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হয়েছে—সেখানে, এই একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তাদের পার্লামেন্ট বছরের পর বছর আলোচনা করে অতিবাহিত করেছে। সার্বিক বিচারে, আগামী গণভোট আয়োজনের এ উদ্যোগকে কোনোভাবেই ন্যূনতম বিচারে গণভোট বলা যাবে না।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সিপিডি পার্লামেন্টারি স্টাডিজ
*মতামত লেখকের নিজস্ব