পেলে: যার খেলা দেখতে থেমে গিয়েছিল যুদ্ধ

পেলে ফুটবলের অবিনশ্বর কীর্তি দিয়ে এক অপূর্ব ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছিলেন বিশ্বে।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ছোট্ট একটি নাম ‘পেলে’। তবে বাবার দেওয়া নামটি বেশ বড়। এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো। কোটি কোটি ভক্ত–সমর্থকদের ভালোবাসার এক নাম পেলে। কারও কাছে নিরন্তরের অনুপ্রেরণার নাম পেলে। বিশ্ব ফুটবলকে নাড়িয়ে দেওয়া, আলোড়িত করা, আলোকিত করা এক অনিন্দ্যসুন্দর প্রতিভার নাম পেলে। পেলের থেকে বেশি কেউ কি নাড়া দিতে পেরেছিলেন—ফুটবলকে, সমাজকে। পেলেই প্রথম ফুটবল দিয়ে সারা বিশ্বকে এক সুতোয় গেঁথেছিলেন। পেলের ছোঁয়ায় ফুটবল জাদুকরি জনপ্রিয়তা লাভ করে। ফুটবলকে সর্বজনীন করেছিলেন পেলে। বিশ্ব ফুটবলের প্রথম কিংবদন্তি পেলে। ফুটবলকে অসম্ভব আলোকিত করা লোকটির নামই কিনা ‘কালো মানিক’। না, এতে কোনো সমস্যা নেই। উজাড় করে দেওয়া ভালোবাসার নামে কোনো সমস্যা থাকে না, তা সে কালোই হোক, আর সাদাই হোক।

ফুটবলের রাজা, জাদুকর, কালো মানিক নানা নামে ও ভাষায় কোটি কোটি ভক্তের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন পেলে। পেলেই একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি তাঁর স্বর্ণালি সময়ে ইউরোপের যশ, খ্যাতি ও অর্থের হাতছানিকে উপেক্ষা করে নিজ দেশেই খেলে গেছেন। ব্রাজিল সরকার তাঁকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। তিনি এর বিরোধিতা করেননি বা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেননি, বরং ব্রাজিলের জনসাধারণের ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে দেশীয় ক্লাব ও জাতীয় দলের পক্ষে খেলেছেন পেশাদার ফুটবলের শেষ দিন পর্যন্ত। পেশাদার ফুটবল থেকে অবসর নিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দল নিউইয়র্ক কসমসের হয়ে খেলেছিলেন। লোভ সংবরণ করতে পারা বা সংযত থাকা এক ইস্পাতকঠিন দৃঢ় সংকল্পের নাম পেলে।

পেলে সেই বিরল ফুটবল প্রতিভা, যাকে নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। ঈশ্বর প্রদত্ত এক প্রাকৃতিক প্রতিভা ছিলেন পেলে। তিনি আজীবন নিজের মেধা, প্রতিভা ও সামর্থ্যের ওপর নির্ভর করেই খেলেছেন। শঠতা ও বিতর্ক তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি।

পেলে কি শুধুই একজন ফুটবলার ছিলেন? না। পেলে সারা বিশ্বের কোটি কোটি বালকের স্বপ্ন নির্মাণের সারথি। পেলেকে দেখে, পেলের খেলা দেখে, পেলের নাম শুনে সারা বিশ্বের অগণিত বালক, কিশোর ফুটবলকে নিজের করে নিয়েছে। মাঠ মাতিয়েছে। সমাজ ও পরিবারকে বদলে দিয়েছে। সারা বিশ্বের মানুষের চোখে পেলে এক অনবদ্য স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিলেন। এই স্বপ্ন হচ্ছে—ফুটবল দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন, অভাব দূর করা। পেলেই দেখিয়েছিলেন, ফুটবলশিল্প দিয়ে দারিদ্র্যকে পরাভূত করা যায়। সমাজ থেকে নানা অনাচার দূর করা যায়। বিশ্বকে জয় করা যায়। মাঠ এবং মাঠের বাইরে কেউই পেলেকে এ বিষয়ে ছাপিয়ে যেতে পারেননি।

বিশ্বকাপ ফুটবল দিয়েই বিশ্ব ফুটবলে পেলের উত্থান। আরেক বিশ্বকাপের পরই পেলে আমাদের মধ্য থেকে বিদায় নিলেন। ১৯৫০–এর বিপর্যয়ের পর ব্রাজিলের ফুটবল ধুঁকছে হতাশায়। ১৭ বছরের এক সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ যুবক স্টকহোমে গেলেন ৮ বছর আগে বাবাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের স্বপ্ন নিয়ে। ১৯৫০–এর ফাইনালে ব্রাজিলের পরাজয়ে কেঁদেছিলেন পেলের বাবা। বাবার চোখের জলকে বুকের ভেতর পুষে নিয়ে ইউরোপে যাত্রা করলেন বাউরুতে বেড়ে ওঠা কালো মানিক। পেলের মাঠে নামার কথা ছিল না, যদি দলের মনস্তত্ত্ববিদের কথা মেনে নিতেন দলের কোচ ভিসেন্তে ফিওলা। কিন্তু সময়ের ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। পেলেকে ভবিষ্যৎ ডেকে নিয়ে গিয়েছিল স্টকহোমে ইতিহাস গড়ার জন্য। তাই পেলে প্রথমে মাঠে বদলি হিসেবে নামলেন। এরপর ইতিহাস বদলে দিলেন।

পেলেই তিনটি বিশ্বকাপজয়ী একমাত্র খেলোয়াড়। বিশ্বকাপ ফুটবলে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা। সেমিফাইনালে হ্যাটট্রিকও করলেন সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে। ফাইনালেও গোল ওই সর্বকনিষ্ঠ হিসেবেই। বিশ্ব ফুটবলের অনেক কিছুরই প্রথম এই পেলে। যা ছিল অনেকের কল্পনার অতীত, পেলে তা–ই করে দেখিয়েছেন। গতি, ড্রিবলিং, ডজ, দুই পায়েই জোরালো শট, দুর্দান্ত হেড, হালকা ফ্লিক, বাইসাইকেল কিক—কী ছিল না পেলের তূণে।

পেলে সর্বযুগের, সব দেশের সেরা খেলোয়াড়ই নন শুধু, এই পেলে সবার। ব্রাজিলের সীমানায় পেলে বন্দী ছিলেন না। তিনি রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক সীমানাকে অতিক্রম করেছিলেন। ব্রাজিলের মতোই পেলে বাংলাদেশেও সমান জনপ্রিয়। আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত দেশেও পেলের জনপ্রিয়তায় কোনো ঘাটতি ছিল না কোনো কালেই। দক্ষিণ আফ্রিকাতে বিশ্বকাপ হাওয়ায় পেলে সব থেকে বেশি খুশি হয়েছিলেন।

পেলে ফুটবল দিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধ থামাতে ভূমিকা রাখেন পেলে। সেবার নাইজেরিয়া গিয়েছিল সান্তোস। পেলের খেলা দেখতে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিল নাইজেরিয়া ও বায়াফ্রা। কারণ মানুষ এক নজরে তাঁকে দেখতে চায়, তাঁর খেলা দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হতে চায়। এ ছাড়া অল্পবয়সেই কিংবদন্তী হয়ে ওঠে পেলের নিরাপত্তার বিষয়টিও তখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছিল।

পেলের বিদায়ে বিশ্ব আজ শোকের চাদরে ঢেকে গেছে। সাও পাওলো থেকে বেইজিং, নিউইয়র্ক থেকে মস্কো—সর্বত্রই শোকের ছায়া। পেলেদের মৃত্যু হয় না। পেলেরা যুগে যুগে বেঁচে থাকেন নিজস্ব কীর্তি দিয়ে। পেলে অফুরন্ত অনুপ্রেরণার উৎস। পেলে সবার মানসপটে টিকে থাকবেন অনন্তকাল ধরে।

ফুটবলের রাজা পেলেকে বিদায় বলা কঠিন। পেলে ফুটবলের অবিনশ্বর কীর্তি দিয়ে এক অপূর্ব ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছিলেন বিশ্বে। এই নশ্বর দুনিয়া থেকে শারীরিক প্রস্থান ঘটলেও, পেলে আমাদের মধ্যেই বিরাজ করবেন নানা ভাবনা ও চিন্তায়। পেলের সব থেকে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে, ফুটবলের গতিপথই বদলে দিয়েছিলেন। ফুটবলকে সর্বজনীন ও গণমানুষের বিষয়বস্তুতে পরিণত করতে পেলের অবদান অসামান্য।

কিংবদন্তির মৃত্যু নেই। পেলে এক চিরন্তন কিংবদন্তি। চির ভাস্বর এক অমিত প্রতিভার নাম পেলে। পেলে প্রথাবিরোধী ছিলেন, এ কথা বলা যাবে না। কিন্তু পেলে প্রথার ভেতরে অবস্থান করেই যাবতীয় প্রথাকে বদলে দিয়েছিলেন।

শান্তিতে ঘুমান ফুটবলের জাদুকর পেলে।

  • মারুফ মল্লিক লেখক ও বিশ্লেষক