পশ্চিম বা রাশিয়া যা বলবে আমরা তা–ই শুনব, সেই বাস্তবতা এখন আর নেই

ড. আমেনা মহসিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে নানা মহলে আলোচনা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও ভূরাজনীতি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন এই আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ। 

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান মনোজ দে

আমেনা মহসিন

প্রশ্ন :

ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে। সেটাকে কতটা কাজ লাগানো যাচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?

আমেনা মহসিন: ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশ অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। আজকে যে সুবিধাজনক অবস্থানের কথা বলা হচ্ছে, সেটা অবশ্য আগেও ছিল। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সুবিধাজনক জায়গা হলো, বঙ্গোপসাগরের উপকূলে এর অবস্থান। ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের রাজ্যগুলোর কারণেও বাংলাদেশের একটা ভালো অবস্থান আছে। ভারত বহুবার চেয়েছে বাংলাদেশ যেন উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরালো করে। কিন্তু ভূরাজনীতির এসব সুবিধাজনক অবস্থান থেকে আমরা কতটা সুবিধা আদায় করতে পারছি, সেটাই মূল প্রশ্ন। এটা অনেকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য কী, আমরা কী অর্জন করতে চাই, আমাদের দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি আছে কি না, নাকি স্বল্প মেয়াদে গেম জিততে চাইছি—এসব মৌলিক প্রশ্ন জড়িত। এর সঙ্গে অবশ্যই আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, সরকার, শাসনব্যবস্থাও জড়িত। একটা বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রেখে আমরা যদি এগোতে পারি, তাহলে ভূরাজনৈতিক জায়গায় বাংলাদেশের যে সুবিধাজনক অবস্থান আছে, সেটাকে কাজে লাগানো সম্ভব।

প্রশ্ন :

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘের প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থেকেছে বাংলাদেশ। এই সিদ্ধান্তকে কীভাবে দেখছেন?

আমেনা মহসিন: ভারসাম্যমূলক অবস্থান বলব না, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশ একধরনের কৌশলগত দূরত্ব বজায় রাখছে। বৈশ্বিক ফোরামে বাংলাদেশের যে নিজস্ব অবস্থান আছে, এটা তারই প্রকাশ। এ যুদ্ধ নিয়ে অনেক ধরনের মতামত আছে। যুদ্ধটা এখন যে রূপ ধারণ করছে, সেটা অনেকটা বৈশ্বিক যুদ্ধের দিকে চলে যাচ্ছে। এটা শুধু ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যকার যুদ্ধ নয়। যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর মাধ্যমে একটা প্রক্সি যুদ্ধ করছে। সাম্প্রতিককালে উপসাগরীয় দেশগুলোর ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থানের বদল হয়েছে। যে আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের আগে সম্পর্ক ছিল না, তাদের সঙ্গেও সম্পর্ক হয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, ইন্দো-প্যাসিফিকে যদি তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তাহলে উপসাগরীয় দেশগুলোকেও হাতে রাখতে হবে। এ কারণেই ইসরায়েলকে ব্যবহার করেই আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারা একধরনের স্থিতিশীলতা আনতে চাইছে। রাশিয়ার একেবারে ঘাড়ের কাছে যদি এমন কোনো দেশ থাকে, যেটি ন্যাটোর সদস্য না হলেও ন্যাটোই তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে, তাহলে সেটা কিন্তু রাশিয়া মেনে নেবে না।

প্রশ্ন :

এ যুক্তিতে কি আপনি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে ন্যায্যতা দিতেই চাইছেন?

আমেনা মহসিন: আমি যুদ্ধকে ন্যায্যতা দিতে চাইছি না। তবে এ যুদ্ধের জন্য একমাত্র রাশিয়া দায়ী, সেটা আমি মনে করি না। ওয়ারশ যখন বিলুপ্ত হয়েছিল, তখন ন্যাটোরও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। রাশিয়া ন্যাটোর সদস্যপদ চেয়েছিল। মানছি, ন্যাটোর সদস্য হতে গেলে গণতন্ত্র থাকতে হয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হয়। কিন্তু রাশিয়াকে ন্যাটো একটা সুযোগ দিতে পারত। রাশিয়াকে অন্তত অবজারভার স্ট্যাটাস দিতে পারত, কিন্তু সেটা করা হয়নি। আমেরিকা চেয়েছে এক মেরুর বিশ্ব, যেখানে পশ্চিমের একক আধিপত্য থাকবে। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে অনেক ধরনের মতামত থাকতেই পারে। কিন্তু আমাদের মেনে নিতে হবে যে বহু মেরুর বিশ্ব এখন একটি বাস্তবতা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি দেখছি, দক্ষিণ বিশ্বের আওয়াজ বেশ জোরালো হচ্ছে। উত্তর বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করছে দক্ষিণ। এই যে ভিন্ন ভিন্ন মেরু তৈরি হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ কোনো এক দিকে যেতে চাইছে না। বাংলাদেশ নিজেদের স্বার্থগুলোকে ধরে রাখতে চাইছে। কিন্তু একই সঙ্গে বাংলাদেশ যে খুব টান টান দড়ির ওপর দিয়ে যে হাঁটছে, সেটাও আমাদের মনে রাখতে হবে।

আমেনা মহসিন
ছবি : প্রথম আলো

প্রশ্ন :

ভারত-পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষেত্রেও স্বতন্ত্র একটি অবস্থান দেখা যাচ্ছে।

আমেনা মহসিন: দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নিজস্ব অবস্থান রয়েছে। ভারতের নিজস্ব অবস্থান আছে, পাকিস্তানেরও একটা অবস্থান আছে। বিভিন্ন বৈশ্বিক ফোরামে দেশগুলো তাদের অবস্থান জোরালোভাবে প্রদর্শন করছে। এর কারণ হলো, বহু মেরুর বিশ্বে দক্ষিণ বিশ্বের দেশগুলোর একটা আওয়াজ তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এখন আর সেই ধরনের বিশ্ব নেই যে একটা কেন্দ্র থাকবে, একটা প্রান্ত থাকবে। এ ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। আমরা এখন এমন একটি বিশ্বে বাস করছি, যেখানে সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী দেশগুলো প্রতিযোগিতা করছে সেসব দেশের সঙ্গে, যাদের হয়তো সামরিক শক্তি সেভাবে নেই, কিন্তু অন্যান্য ক্ষমতা আছে। প্রযুক্তির বিকাশের কারণে দক্ষিণ বিশ্বের এই আওয়াজ আর দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। আমরা যখন বহু মেরুর বিশ্বের কথা বলছি, সেটা কিন্তু শুধু চীনের কথা বলছি না, দক্ষিণ এশিয়া, আমাদের বাংলাদেশের আওয়াজগুলোও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। সরাসরি পশ্চিম যা বলবে, আমরা তা-ই শুনব, সরাসরি রাশিয়া যা বলবে, আমরা তা-ই শুনব—এমন বাস্তবতা এখন আর নেই।

প্রশ্ন :

পররাষ্ট্রনীতি অনেক সময় অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকা সফর করে গেলেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, নির্বাচন, মানবাধিকারের বিষয়ে তিনি কথা বলেন। আবার দুই দেশের সুসম্পর্কের বিষয়েও গুরুত্ব দেন তিনি। তাঁর এ সফরকে কীভাবে দেখছেন?

আমেনা মহসিন: প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আসার পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একটা পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় থাকলে তারা একটা স্থিতিশীল নীতি বজায় রাখে। তারা গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলে। শাসনপদ্ধতির দিক থেকে একটা দেশ কোন দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটাও তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয়। এ কারণে নির্বাচন কি অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে নাকি একটা দেশ কর্তৃত্ববাদের দিকে যাচ্ছে, সেটা ডেমোক্র্যাটদের বিবেচ্য বিষয়।

আবার যুক্তরাষ্ট্রের নিজেদেরও অনেক ধরনের স্বার্থ আছে। বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি নিয়ে যখন তারা এগোচ্ছে, তখন নিরাপত্তার বিষয়টিও এখানে আছে। তবে নিরাপত্তা বলতে শুধু অস্ত্র দিচ্ছে বা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলছে, ব্যাপারটা তেমন নয়। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এর কারণ হলো চীনের উত্থান। আমার মনে হয়, আমেরিকান পররাষ্ট্র নীতিনির্ধারকেরা বিশ্বকে একটা ‘জিরো সাম গেম’ তত্ত্ব দিয়ে দেখে। তারা এখনো একটা এক মেরুর বিশ্বে যেতে চাইছে, যেখানে পশ্চিমা দেশগুলোর আধিপত্য বজায় থাকবে। কিন্তু ইউরোপও এখন নিজেদের আমেরিকা থেকে একটা দূরত্ব তৈরি করছে।  বিশ্বে বড় শক্তিগুলো যত তাড়াতাড়ি বহু মেরুর ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে নিতে পারবে, আমাদের জন্য ততই মঙ্গল।

প্রশ্ন :

চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্বে বাংলাদেশ কি ঠিক অবস্থানে আছে? কোনো ঝুঁকি দেখছেন কি?

আমেনা মহসিন: চীনের সঙ্গে আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক আছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোডস উদ্যোগকে আমরা অনেক আগেই স্বাগত জানিয়েছি। বাংলাদেশের অবস্থানটা ভালো করে লক্ষ করলে দেখতে পাবেন, বাংলাদেশ অনেক ধরনের বহুপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে যাচ্ছে। তালুকদার মনিরুজ্জামান অনেক আগে বলেছিলেন, আমাদের মতো দেশগুলো যত দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারবে, ততই ভালো। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সেটা ঠিকঠাকমতো করে চলেছে। বাংলাদেশ সবকিছু এক ঝুড়িতে রাখতে পারে না। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা উচিত।

বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ দেশ। জোটনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কখনোই যারা স্নায়ুযুদ্ধের মধ্যে আছে, তাদের কোনো একটি পক্ষের সঙ্গে সামরিক চুক্তিতে ঝুঁকে পড়তে পারবে না। তত্ত্বগতভাবে আমরা অবশ্য বলি, এখন স্নায়ুযুদ্ধ নেই। কিন্তু বাস্তবে তো আমরা দেখছি অন্য রকমের একটা স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। একদিকে আমেরিকা, অন্যদিকে চীন এখন রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দিকে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, সব পক্ষের সঙ্গেই একটা কৌশলগত দূরত্ব বজায় রেখে চলা। এটা আগামী দিনেরও চ্যালেঞ্জ।

প্রশ্ন :

এশিয়ায় দুই বড় প্রতিবেশী ভারত-চীনের মধ্যকার সম্পর্কের টানাপোড়েনের প্রভাব অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের ওপর এসে পড়ে। এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান কী হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

আমেনা মহসিন: ভারত কিন্তু চীনের সঙ্গে খুব ভালো বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখে। আবার ভারত থেকে চীনে পড়াশোনা করতেও অনেক শিক্ষার্থী যায়। দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে যে দ্বন্দ্ব আছে, সেটা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় অনেক জায়গায় ভারত-চীন সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ। ভারতে চীন নিয়ে অনেক গবেষণাও হচ্ছে।

চীন ও ভারতের এ ধরনের দ্বন্দ্ব থেকেই যাবে। কেননা, দ্বন্দ্ব একটা পর্যায় পর্যন্ত বাড়ে, কিন্তু সেটা মাত্রা ছাড়ায় না। ১৯৬২ সালের পর দুই দেশের মধ্যে বড় কোনো সংঘাত হয়নি। ফলে চীন-ভারত দ্বন্দ্ব নিয়ে বাংলাদেশের মাথা ঘামানোর কোনো দরকার আছে বলে মনে করি না।

চীনের বিষয়ে ভারত যদি উদ্বেগ প্রকাশ করে, তাহলে আমাদেরও উচিত ভারতকে এটা বুঝিয়ে দেওয়া, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক আজকের নয়।

প্রশ্ন :

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্বে একটা স্পষ্ট মেরুকরণ দৃশ্যমান। বাংলাদেশ কোনো পক্ষে অবস্থান না নেওয়ায় কেউ কেউ বলছেন, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি  সুস্পষ্ট নয়। আপনি কী মনে করেন?

আমেনা মহসিন: এ ক্ষেত্রে আমার দ্বিমত আছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি দৃশ্যমান এবং অবশ্যই একটা পরিপক্ব রূপ পেয়েছে। আপনি সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বে অনেকগুলো বিভাজন তৈরি করেছে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, যুদ্ধটা ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। বাংলাদেশ নিজেই তো গণহত্যার শিকার হয়েছে ১৯৭১ সালে। সে ক্ষেত্রে আমরা কোনো যুদ্ধকে সমর্থন করতে পারি না। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে লাখ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়েছে। একাত্তরে আমাদের এখানেও এক কোটির মতো মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। আমি মনে করি, ইউক্রেন যুদ্ধে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ঠিকই আছে—আমরা কারও পক্ষে বা বিপক্ষে নই। সমদূরত্ব বজায় রেখে চলেছি। আমরা আমাদের স্বার্থকে সমুন্নত রাখব, কিন্তু কারও সঙ্গে বৈরিতা দেখাব না।

প্রশ্ন :

অনেকে বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে একটা দোদুল্যমানতা আছে। কখনো এদিকে, কখনো ওদিকে ঝুঁকছে।

আমেনা মহসিন: আমি মনে করি না আমাদের পররাষ্ট্রনীতি দোদুল্যমান অবস্থায় আছে। পররাষ্ট্রনীতি গৃহীত হয় ভূরাজনীতিসহ আরও অনেক বিষয় বিবেচনায় রেখে। বাংলাদেশ কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধকে সমর্থন করেনি। আমরা যুদ্ধ চাই না বলেই রোহিঙ্গারা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে আছে। যুদ্ধটা হচ্ছে রাশিয়া ও আমেরিকান নেতৃত্বাধীন ন্যাটো দেশগুলোর মধ্যে। বাংলাদেশ শুরু থেকে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সঙ্গে আছে। আমরা কোনো সামরিক জোটে যাইনি। অনেকে এটাকে সুবিধাবাদী নীতি বলতে পারেন, কিন্তু যে নীতি আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে, সেটাই তো নিতে হবে। পাকিস্তান একসময় সিয়াটো ও সেন্টোর সদস্য ছিল। তাদের অবস্থা কী হয়েছে, আমরা জানি। আমাদের দেখতে হবে, ভূরাজনৈতিক কূটনীতি থেকে আমরা কত বেশি সুবিধা নিতে পারি। আমরা কোনো শিবিরে চলে গেলে সেই সুবিধা পাব না।

প্রশ্ন :

২০০৯ সালের পরে ও আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন দেখেন কি?

আমেনা মহসিন: ২০০৯ সালের পর বিশ্বরাজনীতিতে কিন্তু বড় ধরনের পরিবর্তন হয়ে গেছে। পরিবর্তন যদি বলেন, ভারতের সঙ্গে স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছে, সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছে। সার্বিকভাবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। আবার তিস্তার পানিবণ্টনসহ অনেকগুলো সমস্যার সমাধান হয়নি। বিএনপি নেতাদের জিজ্ঞাসা করলে বলেন, তাঁরাও সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ভারত থেকে সাড়া পাননি। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিএনপির আমলেও আমাদের সম্পর্ক ভালো ছিল।

প্রশ্ন :

কিন্তু বিএনপির সময়ে চীনের সঙ্গে তো সম্পর্ক নাজুক হয়েছিল তাইওয়ানের বাণিজ্যিক অফিস খোলার কারণে।

আমেনা মহসিন: সেটা বড় ভুল ছিল বলে মনে করি।

প্রশ্ন :

প্রতিবেশী মিয়ানমারের বিষয়ে আমাদের জানাশোনা খুবই কম। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে এই কম জানাশোনা কী প্রভাব রাখছে?

আমেনা মহসিন: আমরা ভারত নিয়ে যতটা মাথা ঘামিয়েছি, মিয়ানমার নিয়ে ঘামাইনি। রোহিঙ্গা সমস্যাটি তো শুরু হয়েছে সত্তর দশকের শেষ দিকে। পরে তাদের ফেরত পাঠিয়েছি। আবার নব্বইয়ের দশকে যারা এসেছিল, তাদের বেশির ভাগ থেকে গেছে। আমাদের উচিত ছিল উচ্চপর্যায়ে আলোচনা করে এর একটি টেকসই সমাধান বের করা। সেটা করতে পারিনি। সর্বশেষ ২০১৬ সালে সাত লাখের বেশি বাংলাদেশে আসে। অন্যদিকে মিয়ানমার কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। এখানে কী হচ্ছে না হচ্ছে, গণমাধ্যম এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী লেখা হচ্ছে, সেসবের ওপর তারা তীক্ষ্ণ নজর রাখছে। এটা একাডেমিক স্তরে যেমন হচ্ছে, তেমনি নীতিনির্ধারক স্তরেও। মিয়ানমার যেভাবে বাংলাদেশকে ফোকাস করছে, আমরা সেভাবে করিনি। একাডেমিক বা নীতিনির্ধারক কোনো স্তরেই নয়।

প্রশ্ন :

রোহিঙ্গা সমস্যাটি আন্তর্জাতিক মহলের যথেষ্ট মনোযোগ আকর্ষণ করল না কেন? এ ক্ষেত্রে আমাদের কোনো ঘাটতি ছিল কি?

আমেনা মহসিন: আন্তর্জাতিক মহলে যেভাবে রোহিঙ্গা ইস্যুটি প্রাধান্য পাওয়ার কথা, সেভাবে পায়নি। যেমনটি ইউক্রেন যুদ্ধ পেয়েছে। প্রথম দিক থেকে পশ্চিমা বিশ্ব কিছুটা তৎপরতা দেখালেও এখন প্রায় নীরব। তাই আমি মনে করি না, তাদের সহজে ফেরত পাঠানো যাবে। একাত্তরের বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বের বহু স্থানে কনসার্ট হয়েছে, রোহিঙ্গাদের নিয়ে কিন্তু কোনো কনসার্ট হয়নি। সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বসে। সে সময়ে নিউইয়র্কে একটি কনসার্ট হলে জনমত গঠনে সহায়ক হতো।

প্রশ্ন :

এ ব্যাপারে ভারত ও চীনের এগিয়ে না আসার কারণ কী?

আমেনা মহসিন: আমার মনে হয়, তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারত। ভারতে নাগরিক সমাজ থেকেও সে রকম সাড়া মেলেনি। ভারতের নীতিনির্ধারকেরা সব সময় বলেন তাঁরা বাংলাদেশের পাশে আছেন, কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখছি না। ভারতের শিক্ষাবিদদের মধ্যে আমাদের বন্ধু যাঁরা আছেন, তাঁরা বলেন, বাংলাদেশই একমাত্র দেশ নয় যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বোঝা বহন করছে। ভারতেও রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে, কিন্তু সেই সংখ্যা কত? আমাদের ছোট্ট দেশে ১০ থেকে ১২ লাখ শরণার্থী এসে চেপে বসেছে।

প্রশ্ন :

ইউক্রেন যুদ্ধ কবে শেষ হবে বলে মনে করেন?

আমেনা মহসিন: আমি মনে করি না যুদ্ধ শিগগিরই শেষ হয়ে যাচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ভ্লাদিমির পুতিন মনে করেন তাঁর জন্য ইউক্রেন বিপজ্জনক, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন।

প্রশ্ন :

আপনাকে ধন্যবাদ।

আমেনা মহসিন: আপনাদেরও ধন্যবাদ।