ভারতের ভোটাররা অবশেষে জেগে উঠছেন

ভারতের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলে কংগ্রেসের সমর্থকদের উল্লাসছবি: এএফপি

ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের প্রতি ভারতের ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতির বিষয়টিকে দেশটির যে কোটি কোটি নাগরিক অন্তরে লালন করে আসছেন, তাঁদের কাছে কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশটির নির্বাচনী ফল ঘোষণা একটি শঙ্কার মুহূর্ত হিসেবে দেখা দিয়েছিল। এর কারণ হলো, ভারতের ভিত্তি হিসেবে পরিচিত মৌলিক মূল্যবোধ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং সামাজিক শিষ্টাচারগুলোর ওপর আঘাত হেনে সমাজে চরম ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদ গেড়ে দেওয়া নরেন্দ্র মোদি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হবেন—ভোটের দীর্ঘ প্রক্রিয়া চলাকালে এটি প্রায় অনিবার্য হিসেবে সবার কাছে প্রতিভাত হয়েছিল। 

মোদির বিজেপি এবারের নির্বাচনে আরও বড় জয়ের বিষয়ে এতটাই নিশ্চিত ছিল যে নির্বাচনী প্রচারণার সময় তারা ‘আগলি বার, চার শ পার’ স্লোগান দিয়ে বিরোধীদের টিটকারি পর্যন্ত করেছিল। কিন্তু মঙ্গলবার যখন নির্বাচনের ফলাফল আসতে শুরু করল, তখন মনে হচ্ছিল কেউ যেন ভারতের চোখের ওপর রাখা বিজেপির আঙুলগুলো সরিয়ে দিয়েছে এবং ভারত দীর্ঘ সম্মোহন অবস্থা থেকে থেকে বেরিয়ে চেতনাবস্থায় ফিরে আসছে। 

আরও পড়ুন

এই ফলাফলের পর দেখা গেল, যে মোদি মাত্র কয়েক দিন আগে দাবি করেছিলেন, তাঁর জন্মটা আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো ‘জৈবিক’ ঘটনা নয়, বরং তিনি ঈশ্বরের বিশেষ ইচ্ছাপূরণের জন্য প্রেরিত একজন মানুষ, সেই মোদি তাঁর দলকে সাধারণ সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। সরকার গঠন করতে তাঁর দলকে এখন অন্যদের অনুগ্রহের জন্য গলবস্ত্র হয়ে থাকতে হবে। 

মোদি হয়তো আরও পাঁচ বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। কিন্তু তাঁর ভোটার বশীকরণ মন্ত্র নষ্ট হয়ে গেছে। এর ফলে ভারতকে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু-জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য ‘হিন্দুত্ববাদ’ নামে বিজেপি যে প্রকল্পটিকে দুর্দমনীয় গতিতে এগিয়ে নিচ্ছিল, অবশেষে সেটি সম্ভবত বড় ধরনের বাধার মুখে পড়ল। 

 গত ১০ বছর ক্ষমতায় থেকে বিজেপি কর্তৃত্ববাদী শাসনের স্টাইলে ভারতের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। বেনামি রাজনৈতিক অনুদানের সুবিধা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য বিশ্বের অন্যতম ধনী এই রাজনৈতিক দলটি ইলেকটোরাল বন্ড নামের একটি তহবিল সংগ্রহের প্রক্রিয়া চালু করেছিল। চলতি বছরের শুরুতে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই তহবিল সংগ্রহকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে। 

ইন্ডিয়া জোটের ওপর সবকিছুর সমাধানের আশা করাটা হয়তো বাড়াবাড়ি হবে। তবে এটি ঠিক যে নির্বাচনে তাদের এই কৃতিত্বকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা হিসেবে মনে করা যেতে পারে। সেই ঘোষণাটি হলো, ভারতে এখনো এমন দল রয়েছে যারা তাদের মতপার্থক্য এবং মোদির ভয়ভীতি (যা কিনা মোদিকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে) কাটিয়ে উঠে সাংবিধানিক মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকার রক্ষায় এবং হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস রাখে। 

বিজেপি তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের হয়রানি করতে সরকারি সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করেছে। তারা বিরোধীদের সীমাহীন মামলা ও তদন্তের প্যাঁচে জড়িয়েছে। বিরোধী দলগুলোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে। এমনকি বিরোধী-নিয়ন্ত্রিত রাজ্যের দুই মুখ্যমন্ত্রীকে কারাগারে পর্যন্ত পাঠিয়েছে।

বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ভাঙন ধরাতে ও নিজেদের জোটে ভাগিয়ে আনতে বিজেপি তার ক্ষমতা, অর্থ এবং চাপ ব্যবহার করেছে। তারা কার্যকরভাবে প্রধান প্রধান টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্রকে নিজেদের প্রচারের অস্ত্রে পরিণত করেছে। যারা কথা শুনেছে তাদের আর্থিকভাবে পুরস্কৃত করেছে। আর যারা শোনেনি তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে লেলিয়ে দিয়েছে। 

সরকার-নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমগুলো নির্বাচনকে একটি পূর্বনির্ধারিত লড়াই এবং স্বাভাবিক বিজয়ীর সঙ্গে একগুচ্ছ নামমাত্র মামুলি প্রতিযোগীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে বিবেচনা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে ইন্ডিয়া জোট সেই সব ভোটারের মন জয় করেছে, যঁারা মোদির শাসনের ব্যর্থতা ও মিডিয়ায় প্রচারিত অপতথ্যের ফল ভোগ করে আসছিলেন। 

আরও পড়ুন

উচ্চ বেকারত্ব, জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতি ও আর্থিক বাজারে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের সম্মুখীন হওয়া জনগণের কাছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদির অসংখ্য ব্যর্থতাকে এই তরুণ জোটটি কার্যকরভাবে তুলে ধরতে পেরেছে। এর মাধ্যমে তাঁরা মোদির অজেয় ভাবমূর্তির অত্যুজ্জ্বল আভাকে নিষ্প্রভ করে দিতে পেরেছেন। 

ইন্ডিয়া জোটের ওপর সবকিছুর সমাধানের আশা করাটা হয়তো বাড়াবাড়ি হবে। তবে এটি ঠিক যে নির্বাচনে তাদের এই কৃতিত্বকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা হিসেবে মনে করা যেতে পারে। সেই ঘোষণাটি হলো, ভারতে এখনো এমন দল রয়েছে যারা তাদের মতপার্থক্য এবং মোদির ভয়ভীতি (যা কিনা মোদিকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে) কাটিয়ে উঠে সাংবিধানিক মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকার রক্ষায় এবং হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস রাখে। 

 এ বছরের গোড়ার দিকে মোদি একজন রাজর্ষির ভূমিকা নিয়ে অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধন করেছিলেন। ১৯৯২ সালে উগ্র হিন্দু জনতার অবৈধভাবে শতাব্দীপ্রাচীন বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার পর সেখানে এই মন্দির নির্মাণ হিন্দু ডানপন্থী প্রচারণার চূড়ান্ত পরিণতি ছিল। মোদি ও তাঁর দল মনে করেছিল, রামমন্দির প্রতিষ্ঠার কারণে হিন্দু ভোটাররা বিজেপিকে সহজ বিজয়ের দিকে নিয়ে যাবেন। কিন্তু মন্দিরের পাশাপাশি তীর্থযাত্রীদের আসা–যাওয়ার সুবিধার্থে অযোধ্যার কাছে একটি নতুন বিমানবন্দর, নতুন রাস্তা এবং রেলস্টেশন নির্মাণের পরও রামমন্দির যেখানে অবস্থিত, সেই ফয়েজাবাদ এলাকার সংসদীয় আসনটি বিজেপি হারিয়েছে। 

ইন্ডিয়া জোটের প্রচারাভিযানে মোদির শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা এবং দেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক সংবিধানকে বিজেপির পাল্টে দেওয়ার লক্ষ্যের দিকে জোর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মোদি ইন্ডিয়া জোটের এসব অভিযোগ খণ্ডন না করে তাঁর গৎবাঁধা সুরে বলে যাচ্ছিলেন, বিরোধীরা ক্ষমতায় এলে দেশ হিন্দুদের হাত থেকে আবার মুসলমানদের হাতে চলে যাবে। মোদির এসব মুসলিমবিরোধী বক্তব্য এবার তাঁকে সাহায্য তো করেইনি, উল্টো বুমেরাং হয়ে তাঁকে আঘাত করেছে বলে মনে হচ্ছে। 

গত ১০ বছরে মোদি হিন্দুত্ববাদের নামে যা সমাজে গেড়ে দিয়েছেন, তা এই ভোটের ফলাফল উপড়ে ফেলতে পারবে না। তার জন্য অনেক কাজ করতে হবে। তবে এই ফলের কারণে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতের সমর্থকেরা এখন একটু সহজে শ্বাস নিতে পারবে। সেটিও কম কথা নয়। 

অঞ্জলি মোদি নয়াদিল্লিভিত্তিক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

দ্য নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ