পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু আর কত?

যে শিশুদের জুতা আর জামা পড়ে আছে এই পানির কাছে, সে শিশু তিনটি আর বেঁচে নেই। এমনি করে প্রতিদিন পানিতে মৃত্যু হয় কমবেশি ৪০ শিশুর।

১২ মে শুক্রবার দুপুরে যখন ভাতঘুম দিচ্ছি বাসায়, তখন পরপর বেশ কিছু খুদে বার্তা এলো মুঠোফোনে, একটা সংবাদ আর কয়েকটা সংবাদপত্রের লিংক। বিষয় হলো, পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় তিন শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে। সারা দিনে একে একে ১৬টা সংবাদমাধ্যমে এই খবর খুঁজে পেলাম। বাদ যায়নি চ্যানেলগুলোর স্ক্রলও।

সব জায়গাতেই খুব সাদাসিধা শিরোনাম আর বর্ণনা। যতটুকু জানলাম, তা হলো, সারা দেশের মানুষ যখন ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়ে ব্যস্ত, এক পরিবারের তিন শিশু—শারমিন (৬), নোমান (৭) ও মরিয়ম (৫) তখন ব্যস্ত ছিল রান্নাবাটি খেলতে। খেলতে খেলতে দুপুর হয়ে যাওয়ায় গোসল করতে ওরা নেমে যায় রাস্তার ধারের জমিতে জমে থাকা পানিতে। কিন্তু কেউই আর উঠে আসতে পারেনি। ওদের প্রতিবেশী এক শিশুকে পানিতে ভেসে থাকতে দেখেন। তাকে পানি থেকে তুলে আনার পর পাড়ে দেখেন দুই জোড়া জুতা আর একটি জামা। তিনি ধারণা করেন, পানিতে ওর খেলার সাথিরাও আছে। অন্যদের সাহায্য নিয়ে একে একে আরও দুজনের নিথর দেহ তুলে আনেন তাঁরা।

সিআইপিআরবি নামের এমন একটি প্রতিষ্ঠানে আমি যুক্ত আছি, যারা পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধে কাজ করে। তাই আরও একটু বিস্তারিত জানতে চাই এই ঘটনার। শিশুদের পরিবারের বড়োরা তখন কোথায় ছিল, কী করছিল? ওরা কি রোজই এখানে এই পানির মধ্যে গোসলে নামত? ওরা কি আসলেই গোসলে নেমেছিল? বাড়ির এত কাছে কেন পানি জমে ছিল? কোথাও এই খবরের বিস্তারিত কিছু পেলাম না। এই সব তথ্য পেলে সতর্ক হতে পারত অন্য অভিভাবকেরা। তাঁরা জানতে পারতেন যে ওদের দুজনের মা মারা গেছেন মাস তিনেক আগে। আরেকজনের মা, তার বড় বোনকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। আমরা জানতে পারলাম, দাদি ওদের চোখে চোখে রাখার দায়িত্বে ছিলেন, কিন্তু সংসারের কাজে বাধা পড়ে গিয়েছিলেন বলে পানির পাশে তাদের দেখে রাখতে আসতে পারেননি। আরও জানতে পারলাম, ওই তিন ভাই-বোনের মধ্যে দুজনের সাঁতার শেখার বয়স হয়ে গেলেও তাদের সাঁতার শেখানোর দায়িত্ব নেয়নি কেউ।

এক পরিবারের তিনটি কাছাকাছি বয়সের শিশু মারা গেছে। মারা গেছে মির্জাগঞ্জে, কিংবা কুতুবদিয়ায় অথবা দেশের অন্য কোনোখানে। যেমন প্রতিদিনই ৪০ জন শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে, এই নদীমাতৃক দেশে। পানিতে ডুবে শিশু মারা যাওয়া খুবই সাদামাটা একটা খবর। অথচ এই ৪০টা শিশুর কেউ হতে পারত ভুবনবিখ্যাত। খবর হতে পারত দুনিয়াজুড়ে। আমরা ভাবি না, এর প্রতিটি শিশুকে বাঁচানো যেত, যদি আমরা তাদের বাঁচানোর বা নিরাপদ রাখার উপায় জানতাম। আমরা যে জানি না, তা–ও না।

খেলতে গিয়ে এক পর্যায়ে গোসল করতে নামে একই পরিবারের তিন শিশু। এরপর তাদের আর বেঁচে ফেরা হলো না। পুকুরপাড়ে পড়ে আছে তাদের জুতা

আমরা জানি, পাঁচ বছরের নিচের শিশুকে সর্বক্ষণ দেখাশোনায় রেখে, আর ৬-১০ বছরের শিশুকে সাঁতার শিখিয়ে আমরা তাদের পানিতে ডুবে মৃত্যুকে রুখে দিতে পারি। আমরা এমন ব্যবস্থা করতে পারি, যাতে শিশুদের সাঁতার শেখাতে বাধ্য হয় অভিভাবকেরা। শিশুদের বাঁচাতে সাঁতারকে করা যেতে পারে ‘সপ্তম টিকা’। আমরা নিয়ম করতে পারি, যদি সাঁতার না জানে, তাহলে প্রাথমিক বিদ্যালয় পাস হবে না শিশুদের।

বাংলাদেশে ১৮ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ, পানিতে ডুবে যাওয়া। কিন্তু আমরা একে নিয়ে ততটা চিন্তিত না, যতটা চিন্তিত তার অন্যসব কিছু নিয়ে। জীবনই যদি না বাঁচে, তাহলে অন্য সবকিছুই তো বৃথা!

আরও পড়ুন

আমরা বলি, গ্রামের ছেলেমেয়েরা হাঁটা শেখার মতোই সাঁতার শিখে যায়। কিন্তু আসলে সেটা পুরোপুরি সত্য নয়। কেউ ডুবতে ডুবতে শিখে যায় বটে, তবে তাদের সবারই জীবন বাঁচানোর জন্য হলেও সাঁতার শিখতে হয়। সাঁতার একটা প্রাথমিক জীবন রক্ষাকারী দক্ষতা। আর কোনো কিছু না শেখালেও তা আপনার জীবনহন্তারক হবে না। কিন্তু সাঁতার না শিখলে তা আপনার জীবনাবসানের কারণ হতে পারে। শিশুদের সাঁতার শেখানোর জন্য সামগ্রিক পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

  • নাহিদ আখতার কমিউনিকেশন ম্যানেজার, সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)