প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, তিনি ইরানে তিনটি স্থাপনা ধ্বংস করে ‘অসাধারণ সামরিক সাফল্য’ অর্জন করেছেন। ট্রাম্পের এই দাবি আদৌ ঠিক কি না, তা হয়তো পরে বোঝা যাবে।
তবে এটি স্পষ্ট, তিনি আমেরিকাকে সরাসরি ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছেন। এই যুদ্ধ আরও বড় ধরনের সংঘাতে রূপ নিতে পারে এবং সে আশঙ্কা ট্রাম্প নিজে স্বীকারও করে নিয়েছেন।
ইরানে বোমা হামলার আইনি ভিত্তি আছে কিনা তা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। তবে আমি যেটিকে এখন সবচেয়ে বিপজ্জনক বলে ভাবছি, তা হলো—এখানে তিনটি বড় অনিশ্চয়তা আমেরিকার সামনে ঝুলছে, যেগুলোর ওপর আমেরিকা ও বিশ্বের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
ইরান কীভাবে আমেরিকার ওপর পাল্টা আঘাত হানবে তার ওপর প্রথম অনিশ্চয়তার বিষয়টি নির্ভর করছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি আগেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, ‘যদি যুক্তরাষ্ট্র সামরিকভাবে এই সংঘাতে নামে, তাহলে তারা যে ক্ষতির মুখে পড়বে, তা কখনোই পূরণ করা সম্ভব হবে না।’
ইরানের সামনে অনেক পথ খোলা আছে। তারা ইরাকে, বাহরাইনে কিংবা অন্য কোথাও অবস্থিত আমেরিকান ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালাতে পারে।
তারা সাইবার হামলা করতে পারে, আমেরিকান দূতাবাসে আক্রমণ করতে পারে, অথবা কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীকে দিয়ে সন্ত্রাসী হামলা করাতে পারে।
আরেকটি সম্ভাব্য পদক্ষেপ হতে পারে হরমুজ প্রণালি আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া। তারা তেলবাহী জাহাজে আক্রমণ চালাতে পারে, বা সামুদ্রিক মাইন পেতে দিতে পারে।
এতে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লাগবে, কারণ বিশ্বের মোট তেলের এক-চতুর্থাংশ এই প্রণালি দিয়ে আনা-নেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞরা আমাকে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত প্রণালিটি পুনরায় উন্মুক্ত করতে পারবে বটে, কিন্তু তার জন্য অর্থনৈতিক ও অন্যান্য দিক থেকে মূল্য দিতে হতে পারে।
১৯৮৮ সালে যখন ইরান এই প্রণালিতে মাইন পেতে দিয়েছিল, তখন একটি মাইন আমেরিকার যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস স্যামুয়েল বি. রবার্টসকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।
২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করেছিল, তখন ইরান আমেরিকার ইরাকের ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল। সেই উত্তেজনার সময় ভুলবশত একটি ইউক্রেনীয় যাত্রীবাহী বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করা হয়। সে বিমানে থাকা ১৭৬ জন আরোহীর সবাই নিহত হন।
আমার ধারণা, ইরান এবার আগের চেয়েও জোরালোভাবে পাল্টা হামলা চালাতে পারে। এর একটা কারণ হতে পারে—তারা চায় যেন যুক্তরাষ্ট্র আবার এমন আক্রমণ চালাতে সাহস না করে। অর্থাৎ তারা প্রতিরোধ শক্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে।
তবে ইরানের সেই সক্ষমতা আগের চেয়ে সীমিত হয়ে থাকতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ইসরায়েলি হামলায় হয়তো তাদের হরমুজ প্রণালিতে মাইন বসানোর ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর এমন কাজ করলে ইরানের নিজস্ব তেল রপ্তানিও বাধাগ্রস্ত হবে।
বিশেষ করে চীনে ইরানের তেল রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে। এটি ইরানের বন্ধু রাষ্ট্র চীনকে অস্বস্তিতে ফেলতে পারে।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা মনে রাখা দরকার যা ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস বলেছিলেন: ‘কোনো যুদ্ধ তখনই শেষ হয়, যখন শত্রু বলে এটি শেষ হয়েছে। আমরা ভাবতে পারি যুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু শত্রুরও তো মতামত রয়েছে।’
দ্বিতীয় অনিশ্চয়তার বিষয়টি হলো, ইসরায়েল ও আমেরিকার হামলা কি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আসলেই বন্ধ করতে পেরেছে, না কি এটি উল্টো আরও গতি এনে দিয়েছে।
ফোরদো ও অন্যান্য স্থাপনায় বোমাবর্ষণ কতটা সফল হয়েছে, তার ওপর ওই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে। আসলে ট্রাম্প যে দাবি করছেন, তা কতটুকু সত্য, তা বুঝে উঠতে সময় লাগবে।
আমেরিকার ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের ‘বাংকার বাস্টার’ বোমা দিয়েও ফোরদো স্থাপনাটি ধ্বংস করা যাবে কি না তা নিয়ে এর আগে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন।
কারণ স্থাপনাটি গভীর পাহাড়ের পাথরের নিচে নির্মিত। এ ছাড়া ইরানের আরও কোনো গোপন স্থানে অতিরিক্ত সেন্ট্রিফিউজ আছে কি না তাও আমাদের জানা নেই।
বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ একমত, যদি ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে থাকে, তাহলে তা পুরো অঞ্চলের জন্য ভয়ংকর পরিণতি বয়ে আনতে পারে। তাদের হাতে পরমাণু অস্ত্র গেলে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোও নিজস্ব পারমাণবিক কর্মসূচি চালু করতে চাইতে পারে।
তবে ট্রাম্প প্রশাসনের গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড এই বছরের বসন্তে প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে না। তিনি এই বিষয়টিকে তিনি তখন খুব একটা গুরুত্ব দেননি।
এখানে মূল ঝুঁকি হলো, ইসরায়েল ও আমেরিকার হামলার ফলে ইরান এখন এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে যে, তাদের সত্যিই পারমাণবিক অস্ত্র দরকার। কারণ, যদি তাদের পরমাণু অস্ত্র থাকত, তাহলে ইসরায়েল হয়তো এত সহজে ইরানে বোমা ফেলতে সাহস করত না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরান ইতিমধ্যে এত পরিমাণ উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম তৈরি করে ফেলেছে যা দিয়ে অন্তত ১০টি পারমাণবিক বোমা বানানো সম্ভব।
ধারণা করা হয়, এই উপাদানগুলো ছিল ইরানের ইস্পাহান শহরে। ট্রাম্প বলেছেন, আমেরিকা ইস্পাহানেও হামলা করেছে। কিন্তু সেই স্থাপনাটি ধ্বংস হয়েছে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনিশ্চয়তা হলো: এটি কি সংঘাতের শেষ, না কি নতুন এক যুদ্ধের শুরু?
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বিশ্বাস করেন, তিনি এবং আমেরিকা মিলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং এমনকি তাদের সরকারকেও শেষ করে দিতে পারেন। তবে মনে রাখা দরকার, নেতানিয়াহু ইরাক যুদ্ধেরও জোর সমর্থক ছিলেন এবং ভেবেছিলেন সেটার ফলেও ইরানে পরিবর্তন আসবে। বাস্তবে, ইরাক যুদ্ধ ইরানকেই আরও শক্তিশালী করে তুলেছিল।
ইরানের সমৃদ্ধকরণ সক্ষমতা ধ্বংস হয়ে গেছে—এ কথা যদি ধরেও নেওয়া হয়, তাহলেও এটি পরিষ্কার, ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার জ্ঞান ও দক্ষতা নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয়।
অর্থাৎ, যদি ইরানের বর্তমান শাসনব্যবস্থা টিকে থাকে, তাহলে এ ঘটনাকে হয়তো পরমাণু কর্মসূচির শেষ না বলে সাময়িক একটি ধাক্কা বলা যেতে পারে।
অনেকে ভাবছেন, বোমা মেরে ইরানের সরকারকে ফেলে দেওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, তেমন লক্ষণ খুব একটা নেই। কারণ ইরানের বিরোধীরাও বাইরের সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ সমর্থন করছেন না। যেমন সরকারবিরোধী নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত নাগরিক অধিকারকর্মী নারগেস মোহাম্মদি গত সপ্তাহে ইরানে বোমা হামলার নিন্দা করেছেন। তিনি ট্রাম্পকে অনুরোধ করেছেন যেন তিনি এই হামলা বন্ধ করেন এবং এতে যুক্ত না হন।
আমি যখন ইরান ভ্রমণ করেছি, তখন দেখেছি সেখানকার সাধারণ মানুষদের মধ্যে সরকারের জনপ্রিয়তা কতটা কম। আমার কাছে সাধারণ ইরানিদের বরাবরই ‘আমেরিকান-অনুকূল’ বলে মনে হয়েছে।
এর মূল কারণ হলো, তাঁরা তাঁদের সরকারকে ঘুষ, ভণ্ডামি আর অর্থনৈতিক ব্যর্থতার জন্য ভীষণ অপছন্দ করেন।
এই জনগণের মধ্যকার আমেরিকা-প্রীতি দেখে মনে হয়েছিল, যদি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা মারা যান, তাহলে দেশটির ভবিষ্যৎ হয়তো আমেরিকার সঙ্গে আরও ভালো সম্পর্কমুখী হবে। কিন্তু যদি আমরাই ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ করি, তাহলে সেখানে আমেরিকাপন্থী সরকার গঠনের সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে।
বাস্তবে, তখন ‘সরকার পরিবর্তন’কে তখন কট্টরপন্থী কোনো গোষ্ঠীর অভ্যুত্থান বলে মনে হতে পারে।
ফলে এখানে সম্ভাবনার পরিসর যেমন অনেক বড়, তেমনি এখানে অনেক কিছুই আছে যা বেশ ভীতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ।
ম্যারিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্র্যাট সিনেটর ক্রিস ভ্যান এই ঝুঁকিগুলো এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন: ‘আমরা সবাই একমত যে, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র থাকা উচিত নয়। কিন্তু ট্রাম্প এই লক্ষ্য অর্জনে কূটনৈতিক পথ ছেড়ে দিয়েছেন এবং তার বদলে এমন কিছু করেছেন যা অপ্রয়োজনে আমেরিকান নাগরিকদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছে, আমাদের সেনাবাহিনীকে আরও বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে এবং আমেরিকাকে আবারও মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘ এক সংঘাতে জড়িয়ে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বারবার বলেছে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে না। কূটনৈতিক সমাধানের জন্য আরও সময় ছিল।’
এই কথাগুলো আমার কাছে ঠিকই মনে হয়। ট্রাম্পের ভাষণ ছিল বিজয়ের সুরে ভরা। কিন্তু এখনই উদ্যাপনের সময় আসেনি। কারণ সামনে যে কী হবে, তা নিয়ে এখনো অনেক অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
নিকোলাস ক্রিস্টোফ নিউইয়র্ক টাইমস–এর কলাম লেখক