ভাড়াটে সেনারা যেভাবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সব হিসাব পাল্টে দিচ্ছে

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পর ইউক্রেনে বিদেশি যোদ্ধাদের ঢল নামে।
ছবি : রয়টার্স

২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে নিহত হন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক মেরিন সেনা পিটার রিড। পূর্ব ইউক্রেনের বাখমুত শহর থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। দুই দিন পর ৪ ফেব্রুয়ারি দুই ব্রিটিশ স্বেচ্ছাসেবকের মরদেহ ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর করে রাশিয়া। বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় মরদেহ ফেরত দেওয়া হয়।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। এই সংঘাতে যে পশ্চিমারাও নিহত হচ্ছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের তিন নাগরিকের মৃত্যু তারই প্রমাণ। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে রাশিয়া প্রথম দফায় আগ্রাসন শুরু করে। সে সময় থেকেই বিদেশ থেকে ভাড়াটে যোদ্ধারা সেখানে ঝাঁক বেঁধে যেতে শুরু করেন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পর ইউক্রেনে বিদেশি যোদ্ধাদের ঢল নামে।

২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইউক্রেন রক্ষায় আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা ব্রিগেডে যোগ দেওয়ার জন্য বিদেশিদের প্রতি আহ্বান জানান। দুই সপ্তাহের মধ্যে ৫০টি দেশ থেকে ২০ হাজার বিদেশি যোদ্ধা ও স্বেচ্ছাসেবক কিয়েভে গিয়ে পৌঁছান।

আদর্শিক কারণে অনেকেই ইউক্রেনে গিয়েছিলেন। আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পশ্চিমা দেশগুলোর সাবেক সেনারা কিয়েভে গিয়েছিলেন এই বিশ্বাসের জায়গা থেকে যে তাঁরা ইউক্রেনীয়দের দুর্দশা লাঘব করতে পারবেন। গণতন্ত্র রক্ষার তাগিদও অনেককে ইউক্রেনে যেতে অনুপ্রাণিত করেছিল।

এ ছাড়া, অল্প কয়েকজন হলেও মার্কিন যোদ্ধা রাশিয়ার পক্ষে লড়াইয়ে নেমেছে। তাঁদের সঙ্গে মার্কিন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আফগান কমান্ডাররাও যুদ্ধ করছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দুই দেশের মধ্যকার প্রথাগত যুদ্ধের চেয়ে ভিন্ন একটি যুদ্ধ। বস্তুগত (সামরিক ও মানবিক) সহযোগিতার অতিরিক্ত দুই পক্ষেই বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা হাজার হাজার ভাড়াটে সেনা অংশ নিচ্ছেন। যত বেশি ভাড়াটে যোদ্ধা এই যুদ্ধে অংশ নেবেন, এ যুদ্ধ তত বেশি বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

যা হোক, ইউক্রেনে যাওয়া সিংহভাগ বিদেশি গত বছরের গ্রীষ্মের আগেই সেখান থেকে ফিরে আসেন। এর পেছনে বেশ কিছু কারণও রয়েছে। ভালো অভিজ্ঞতা না থাকায় তাদের অনেকে ইউক্রেনের মুক্তিসংগ্রামে ভূমিকা রাখতে পারেননি। বরং তাঁরা ‘যুদ্ধকালীন মেহমান’ হিসেবে সমালোচনার মুখে পড়েন। বিমানবাহিনীর শক্ত সমর্থন ও প্রযুক্তির সহযোগিতা না পাওয়ায় পশ্চিমা সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রেও বেশ বেকায়দায় পড়েন।
ইউক্রেনীয় সেনাদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বিদেশি সেনাদের স্পষ্টত ভাষার বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। নিজ দেশে অনেককে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল। এসব কারণেও অনেকে কিয়েভ ছাড়েন।

বেশির ভাগ বিশ্লেষক মনে করেন, এখন ইউক্রেনীয় বাহিনীকে সহায়তা করছেন এক থেকে তিন হাজারের মতো বিদেশি সেনা। এর বাইরেও নানা ক্ষেত্রে নিয়োজিত রয়েছেন কয়েক শ স্বেচ্ছাসেবী।

আরও পড়ুন

ইউক্রেনে যুদ্ধরত বিদেশি সেনাদের মধ্যে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশ যেমন জর্জিয়া, চেচনিয়া কিংবা বেলারুশের যোদ্ধারা রয়েছেন। পশ্চিমাদের পরিচালিত সামরিক গ্রুপ আলফা, ফ্যালাঙ্ক ও নরমান ব্রিগেডও রয়েছে। এসব সেনা ইউনিট নিয়ে বেশ সমালোচনাও হয়েছে। পশ্চিমা ব্যক্তিমালিকানাধীন সামরিক ও নিরাপত্তা কোম্পানিগুলোও (পিএমএসসিএস) সক্রিয় রয়েছে ইউক্রেনে। রাশিয়ানদের ভাগনার গ্রুপের মতো যুক্তরাষ্ট্রের ব্যক্তিমালিকানাধীন ভাড়াটে সেনাদের বাহিনী মোজার্ট গ্রুপ যুদ্ধের প্রথম দিকে বেশ সক্রিয় ছিল। কিন্তু তহবিলসংকট এবং গ্রুপের বেশ কয়েকজন সৈন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতিবাচক পোস্ট দেওয়ার পর মোজার্ট গ্রুপ ইউক্রেন থেকে সরে আসে।

যুদ্ধের বিশ্বায়ন

ইউক্রেনে যুদ্ধরত ও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিয়োজিত বিদেশিদের হতাহতের ভুল তথ্য প্রায়ই প্রকাশিত হয়। গত ২৫ জানুয়ারি তুরস্কের একটি ওয়েবসাইটে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের তথ্যের বরাতে দাবি করা হয়, এ যুদ্ধে এ পর্যন্ত ন্যাটোর কয়েক হাজার সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কয়েক শ সেনা আছেন। যদিও এ দাবি তৎক্ষণাৎ নাকচ করেছে ন্যাটো।

ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, তারা শুধু ইউক্রেনের বিরুদ্ধে লড়ছে না, ন্যাটোর বিরুদ্ধেও লড়ছে। পশ্চিমা যোদ্ধাদের আটকের মাধ্যমে রাশিয়ার জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সেই বার্তাই দিতে চায় ক্রেমলিন। মস্কোর পক্ষ থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে পশ্চিমাদের সঙ্গে সংঘাত বলে চিত্রিত করার প্রচেষ্টা রয়েছে। মস্কো এ–ও মনে করে যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের জনগণও তাদের এই মতের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করে।

এ বিশ্বাস থেকেই ২০২২ সালের মার্চ মাসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বিদেশি যোদ্ধাদের প্রতি ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চল মুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। নিউজউইক জানাচ্ছে, রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুর তথ্যমতে, ১৬ হাজার বিদেশি সেনা রাশিয়ান বাহিনীর পক্ষে ইউক্রেনে লড়াই করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

ভাগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিন এ মাসে তাঁর টেলিগ্রাম চ্যানেলে ঘোষণা দেন যে এক কোটির বেশ মার্কিন নাগরিক রাশিয়ার পক্ষে লড়তে তাদের গ্রুপে নাম লিপিবব্ধ করেছে। যদিও ভাগনার গ্রুপ তাদের নতুন নিয়োগকৃত বেশির ভাগ সৈন্য বন্দীদের থেকে নিয়েছে। এরপরও বিদেশি সেনা নিয়োগের ক্ষেত্রে রাশিয়ার ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলেই মনে হয়।

রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধে নামা বেশির ভাগ ভাড়াটে সেনা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো থেকে আসা। এই সংঘাতে এসব দেশের ভাড়াটে যোদ্ধারা দুই পক্ষেই লড়ছেন বলে সন্দেহ করা হয়।

আরও পড়ুন

সার্বিয়ান নাগরিকদের অনেকেই সার্বিয়াতে পশ্চিমের যে ঐতিহাসিক ভূমিকা, তাতে ভীষণ ত্যক্ত-বিরক্ত। ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনে রাশিয়ান বাহিনীর পক্ষে কয়েকটি সার্বিয়ান গ্রুপ যুদ্ধ করে আসছে। গত মাসে সার্বিয়ান কর্তৃপক্ষ জানায়, আরও কিছু সার্বিয়ান নাগরিক রাশিয়ার পক্ষে লড়াইয়ে যুক্ত হয়েছেন বলে যে প্রতিবেদন পাওয়া গেছে, সেটা তারা তদন্ত করে দেখছে।

ইরানের তৈরি ড্রোন যাতে রাশিয়ানরা পরিচালনা করতে পারেন, সে জন্য ইরানি সেনা ও বিশেষজ্ঞরা ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত অক্টোবর মাসে রাশিয়ান বাহিনীর অবস্থানে হামলায় ১০ ইরানি নিহত হন। রাশিয়ার পক্ষে শত শত সিরিয়ান যোদ্ধা যুদ্ধ করছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এই যুদ্ধে দুই পক্ষেই আরও ভাড়াটে যোদ্ধার অংশগ্রহণের উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। ২০২২ সালের আগস্ট মাস থেকে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে, ইউক্রেনে তাদের দখলকৃত এলাকা পুনর্গঠনের জন্য উত্তর কোরিয়া থেকে এক লাখ স্বেচ্ছাসেবক আসছেন। এই সংখ্যা অনেকটাই কাল্পনিক। কিন্তু কিয়েভের পক্ষে লড়াই করার জন্য দক্ষিণ কোরিয়া থেকে হাতে গোনা কয়েক জন ইউক্রেনে গেছেন।

এ ছাড়া, অল্প কয়েকজন হলেও মার্কিন যোদ্ধা রাশিয়ার পক্ষে লড়াইয়ে নেমেছে। তাঁদের সঙ্গে মার্কিন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আফগান কমান্ডাররাও যুদ্ধ করছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দুই দেশের মধ্যকার প্রথাগত যুদ্ধের চেয়ে ভিন্ন একটি যুদ্ধ। বস্তুগত (সামরিক ও মানবিক) সহযোগিতার অতিরিক্ত দুই পক্ষেই বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা হাজার হাজার ভাড়াটে সেনা অংশ নিচ্ছেন। যত বেশি ভাড়াটে যোদ্ধা এই যুদ্ধে অংশ নেবেন, এ যুদ্ধ তত বেশি বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

  • জন পি রুহেল অস্ট্রেলিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান সাংবাদিক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে