বিশ্বে নতুন এই শীতল যুদ্ধের ধরনও নতুন

চীন ও রাশিয়ার প্রভাবকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা যেতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করতে সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মিত্র দেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার নেতাদের সঙ্গে ক্যাম্প ডেভিডে বৈঠক করেছেন। বিশেষ করে আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের দেশগুলোতে রাশিয়ার প্রভাবে যেভাবে একের পর এক অভ্যুত্থান হয়েছে, তা নিয়ে বাইডেন ও তাঁর মিত্ররা উদ্বিগ্ন হয়ে এই ধারা কীভাবে ঠেকানো যাবে, সে বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

অন্যদিকে, সম্প্রতি ব্রিকসভুক্ত দেশ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার নেতারা জোহানেসবার্গে মিলিত হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে পশ্চিমাদের খবরদারির তীব্র সমালোচনা করেছেন। শীতল যুদ্ধ সম্পর্কে ইতিহাসবেত্তারা এর আগে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা যে বাস্তব অবস্থায় চলে এসেছে, এখন তার প্রমাণ মিলছে।

আজকের দিনে পশ্চিমের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হলো চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়; পশ্চিমের সামনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ব্রিকস, ওয়ার শ প্যাক্ট নয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি এবং বার্লিন প্রাচীরের পতনের মধ্যবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে নিজেদের মতো করে সংজ্ঞায়িত করা বিশ্বের দুই প্রধান শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন আদর্শগতভাবে দ্বন্দ্বরত থেকেছে। এই দ্বন্দ্ব গোটা বিশ্বকে দুটো শিবিরে বিভক্ত করেছিল। এর জের ধরে বিশ্বে স্বাধীনতা চাওয়া দেশের সংখ্যাও বেড়েছে।

১৯৪৫ সালে স্বাধীনতা চাওয়া দেশের সংখ্যা ছিল ৫০। ১৯৮৯-৯১ সালে সেই সংখ্যা দেড় শর বেশি হয়ে দাঁড়ায়।

যখন দুটি শক্তির মিথস্ক্রিয়া জারি ছিল, তখন মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব সামনের দিকে উঠে আসছিল। স্বাধীনতার সংগ্রামগুলো প্রায়ই প্রক্সিযুদ্ধে রূপ নিচ্ছিল এবং দেশগুলোকে হয় যেকোনো একটি শিবিরে যোগ দিতে হচ্ছিল, নয়তো তাদের নিজেদের ‘জোটনিরপেক্ষ’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে বাধ্য করা হয়েছিল।

আন্দাজ করি, বর্তমানে ঠিক একই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে যাচ্ছে বলে যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার সবচেয়ে শক্তিধর ও সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের মুখোমুখি হয়ে নিজ মিত্রদের নিয়ে বেইজিংবিরোধী কৌশল অবলম্বন করছে। সেই কৌশলের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ‘ডিকাপলিং’ বা অর্থনৈতিকভাবে সম্পর্কচ্ছেদ করা এবং ‘ডি-রিস্কিং’ বা ঝুঁকিপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর লেনদেন বাতিল করার নীতি গ্রহণ করেছে। এটি আদতে শীতল যুদ্ধের সময়কার নিয়ন্ত্রণ নীতিরই একটি অর্থনৈতিক সংস্করণ।

একদিকে যুক্তরাষ্ট্র আদর্শগত মেরুকরণের মধ্য দিয়ে আদল পেতে শুরু করা দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধের আশঙ্কা করছে। অন্যদিকে চীন বৈশ্বিক বিভক্তির ওপর বাজি ধরে সেটিকেই কাজে লাগাতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে। হ্যাঁ, চীন অ-পশ্চিমা দেশগুলোকে জি-৭ কিংবা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো পশ্চিমা আধিপত্যের অধীনে থাকা সংস্থাগুলোর বিকল্প কিছু গড়ার চেষ্টা করেছে। চীন একটি বহু মেরুভিত্তিক বিশ্ব চায়।

চীন জানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন শিবিরের সঙ্গে তারা লড়াইয়ে পেরে উঠবে না। তবে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে তারা অন্তত একটি খণ্ডিত বৈশ্বিক ব্যবস্থায় একটি পরাশক্তি হিসেবে জায়গা করে নিতে পারবে।

মার্কিন নেতাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা জারি থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও মার্কিন ব্লক থেকে খণ্ডিত হওয়ার প্রবণতা থেকে মুক্ত হতে পারছে না। এটি যুক্তরাষ্ট্রকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে।

গত সপ্তাহে সম্ভবত সবচেয়ে বড় চমক ছিল ব্রিকসের এই ঘোষণা: আর্জেন্টিনা, মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত—এই ছয় দেশ আগামী বছরের শুরুতেই পূর্ণ সদস্য হয়ে উঠবে। চীনের নেতাদের মনে এটি নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি নেই যে ব্রিকসের মধ্য দিয়ে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো অধিকতর পশ্চিমাবিরোধী হয়ে উঠবে। এতে চীন তার লক্ষ্যে আরও এক ধাপ এগোবে।

ব্রিকসে যোগদান এই দেশগুলোর জন্য কাজের স্বাধীনতা বাড়াবে। উদাহরণস্বরূপ, এর মাধ্যমে তাদের অর্থায়নের বিকল্প উৎস বাড়বে; প্রকৃত অর্থেই মার্কিন ডলারের বিকল্প হিসেবে অন্য মুদ্রার ব্যবহার বাড়বে এবং বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে। এই ধরনের সংগঠনের মাধ্যমে এমন একটি বিশ্বব্যবস্থা তৈরির স্বপ্ন দেখা হচ্ছে, যা পশ্চিমাদের ওপর নির্ভরশীল নয়। তার মানে সেটি হবে চীনের ওপর নির্ভরশীল।

এটি যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার বড় কারণ। তাই নতুন একটি শীতল যুদ্ধাবস্থা অনেকটাই ঘনিয়ে এসেছে।

ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

  • মার্ক লিওনার্ড ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের পরিচালক