বেপরোয়া ছাত্রলীগ, হিন্দু শিক্ষার্থীকেও ‘শিবির’ ট্যাগ ও ভয়াবহ নির্যাতন

ছবি: সংগৃহীত

গত ২৭ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের ডাইনিংয়ে তরকারিতে সিগারেটের অবশিষ্টাংশ পাওয়ার অভিযোগে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা গেটে তালা লাগিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালান। প্রাধ্যক্ষের কক্ষে তালা লাগিয়ে তাঁর পদত্যাগ দাবি করেন এবং তাঁকে লাঞ্ছিত করেন।

প্রাধ্যক্ষ অভিযোগ করেছেন, হলের ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা  উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে খাবারে সিগারেট পাওয়ার নাটক সাজিয়ে এই ভাঙচুর কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে তাঁকে ফাঁসানোর জন্য। তিনি আরও জানান, হলের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা জার্সি দাবি করলে তিনি তাঁরা অ্যাথলেট নন বলে তাঁদের জার্সি দিতে অপারগতা জানান। এই নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীরা তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন।

অভিযোগটি অত্যন্ত গুরুতর। এ ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ড অমার্জনীয়। দোষী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা জরুরি। হল প্রাধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় হল প্রাধ্যক্ষ পরিষদ জরুরি সভা ডেকে এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং জড়িত ব্যক্তিদের হল থেকে বহিষ্কার ও আইনি ব্যবস্থা নেবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

তবে গৃহীত সিদ্ধান্ত কতটুকু কার্যকর হবে, প্রাধ্যক্ষ পরিষদ এই ‘দম’ কতক্ষণ ধরে রাখতে পারবে—সেটি বড় প্রশ্ন। এর আগেও এ ধরনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও তা শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই থেকে গেছে, বাস্তবায়িত হয়নি। এবারে যেসব ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের একজনকে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় পূর্বেই হল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছিল কিন্তু সেটি বাস্তবায়িত হয়নি।

এর আগে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের প্রাধ্যক্ষ ছাত্রলীগের অবৈধ দখলে থাকা সিট দখলমুক্ত করার ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত তিনি পারেননি। ছাত্রলীগের অন্যায় দাবি না মানলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে বিভিন্ন সময় তারা বিভিন্ন প্রাধ্যক্ষকে ‘রাজাকার’, ‘জামাতি’ প্রভৃতি ট্যাগ লাগিয়ে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে থাকে।

রাবির আবাসিক হলগুলোতে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ বিস্তর। হল প্রশাসনের পাশাপাশি তাঁরা ছায়া প্রশাসন গড়ে তুলেছে। হল প্রশাসনকে তাদের খুশি রেখে ম্যানেজ করে হল চালাতে হয়। অনেক হলে নোটিশ দিয়ে আর আবাসিকতা দেওয়া হয় না। কিছু ক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতে আবাসিকতা দেওয়া হলেও হল প্রশাসন তাদের বরাদ্দ করা সিটে ওঠানোর ব্যাপারে সহযোগিতা করেন না। ছাত্রলীগকে ম্যানেজ করেই তাঁকে তাঁর বরাদ্দ করা সিটে উঠতে হয়।

শিক্ষার্থীরা মনে করেন, হলগুলোতে এই চাঁদাবাজি, ট্যাগবাজি, দখলদারি এবং আধিপত্যবাদ একটি সুস্থ পড়ালেখার পরিবেশ, সংস্কৃতির বিকাশ এবং মুক্তচিন্তার চর্চার প্রধান অন্তরায়। সিট থেকে নামিয়ে দেওয়া, মারধর করা এবং ভয়ভীতি দেখানো চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। সভ্য সমাজের একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য যা লজ্জার এবং বিব্রতকর।

হল প্রশাসনের মাধ্যমে যাঁরা ওঠেন, তাঁদের নানাভাবে ভয়ভীতি এবং নিপীড়নের শিকার হতে হয়। অভিযোগ আছে, তাঁদের কর্মী দিয়ে কক্ষে কক্ষে অভিযান চালায় কবে কার পরীক্ষা শেষ হচ্ছে, কবে হলের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এসব খোঁজ নেওয়া বিদায়ী শিক্ষার্থীদের জন্য অস্বস্তিকর ও অবমাননাকর। এসব সিটে ছাত্রলীগ নতুন শিক্ষার্থী তুলে দিচ্ছে কখনো দলীয় পরিচয়ে কখনো–বা অর্থের বিনিময়ে।

রাবির আবাসিক হলগুলোতে প্রায়ই কেউ না কেউ ছাত্রলীগের নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। কখনো মধ্যরাতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী এসে ঘুমন্ত শিক্ষার্থীকে জোরপূর্বক সিট থেকে নামিয়ে দিচ্ছেন। ভয়ভীতি দেখিয়ে বিছানাপত্র ফেলে দিচ্ছেন।

কখনো শিবির ট্যাগ দিয়ে শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করছেন এবং ‘মেরে শিবির বলে চালিয়ে দেওয়া’র কথা বলে চাঁদাবাজি করছেন। ‘শিবির’ ট্যাগ–বাণিজ্যের ফাঁদ থেকে অনেক সময় সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীরাও রক্ষা পান না। সাম্প্রতিককালে সনাতন ধর্মের দুজন শিক্ষার্থীকে ‘শিবির’ ট্যাগ দিয়ে মারধরের অভিযোগ ওঠে।

ছাত্রলীগের নির্যাতনে অন্তত দুজন শিক্ষার্থীর কানের পর্দা ফেটে গেছে। তাঁদের ভয় দেখানো হয় কাউকে বললে এর পরিণতি হবে বুয়েটের আবরার ফাহাদের মতো। নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীর অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন।

আরও পড়ুন

এসব ঘটনার প্রতিবাদে এবং নির্যাতনকারী ছাত্রলীগ নেতার শাস্তির দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে নানা সময় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। তাঁরা মনে করেন, প্রশাসনের আশকারায় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ দিনে দিনে চরম বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। জবাবদিহির অভাব ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি সংক্রামক হিসেবে কাজ করছে এবং একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। হলগুলোতে দায় এড়িয়ে গিয়ে প্রকারান্তরে প্রশাসন নিপীড়নকারীদের পক্ষ নিচ্ছে।

শিক্ষার্থীরা মনে করেন, হলগুলোতে এই চাঁদাবাজি, ট্যাগবাজি, দখলদারি এবং আধিপত্যবাদ একটি সুস্থ পড়ালেখার পরিবেশ, সংস্কৃতির বিকাশ এবং মুক্তচিন্তার চর্চার প্রধান অন্তরায়। সিট থেকে নামিয়ে দেওয়া, মারধর করা এবং ভয়ভীতি দেখানো চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। সভ্য সমাজের একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য যা লজ্জার এবং বিব্রতকর।

শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা এবং শিক্ষার একটি অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অন্যতম দায়িত্ব। দেশের অন্যতম একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, অনিয়ম–অরাজকতা আর নিপীড়ন চলছে আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্বিকার থাকাটা অত্যন্ত উদ্বেগের। রাজনৈতিক পরিচয় যা–ই হোক, আমরা বিশ্বাস করি, বিপথগামী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার মতো নৈতিক দৃঢ়তা প্রশাসনের আছে এবং তারা সেই দৃঢ়তা দেখাতে পিছপা হবে না।

  • ফরিদ খান অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ই-মেইল: [email protected]