বরাবরের মতোই প্রতি বছর পরিবেশ দিবস আসে, কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন করি এবং এরপর এই দিবস ও এর তাৎপর্যের কথা আমরা ভুলে যাই। পরিবেশ সাধারণত কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আগে আমাদের সতর্ক করে। এ রকম একটা সতর্কসংকেত বেজে উঠল কিছুদিন আগে ধানমন্ডিতে। হঠাৎ সিঙ্কহোল জেগে উঠল।
সিঙ্কহোল কেন হয়? কারণ, আমাদের ঢাকার পানির স্তর নেমে যাচ্ছে এবং এখন তা আশঙ্কাজনক। ঢাকা একটা নগর, যেখানে আমরা প্রয়োজনের ৬৬ শতাংশ পানি ব্যবহার করি মাটির তলদেশ থেকে এবং এ জন্য প্রতিবছর ২ দশমিক ৫ মিটার থেকে ৩ মিটার করে পানি কমে যাচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৬ সালে ঢাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল প্রায় ২৫ মিটার। ২০২৪ সালে তা কমে ৮৬ মিটারে পৌঁছেছে।
আমাদের ঠেকানোর কি কোনো পরিকল্পনা আছে? আমরা যাঁরা ঢাকার পুরোনো বাসিন্দা, তাঁদের সবার হয়তো মনে আছে, আগে রাস্তার পাশে কিছু খালি জায়গা থাকত, যেখানে ঘাস থাকত এর পর ফুটপাত। রাস্তা বড় করার নামে যিনি বা যাঁরা এই মাটির অংশটা ঢালাই করে বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন, কোনো বিকল্প ছাড়াই তাঁর বা তাঁদের আসলে বিচার হওয়া উচিত।
কারণ, এই পানির স্তর ঠিক রাখার যে প্রাকৃতিক উপায় ছিল, তা আমরা নষ্ট করেছি। এখন ঢাকা শহরে জলাধার থাকার দরকার অন্তত ১০ শতাংশ। সেখানে আছে মাত্র ৩ শতাংশ। এটা বাড়াতে হবেই। আর পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে আশপাশের নদীর পানি।
এখানেই আবার সেই নতুন সমস্যা। আমাদের নদীগুলো এখন প্রায় মরা, পানি নাই ফলে দূষণ এখন চূড়ান্ত। এখন আমরা যে সারফেস ওয়াটার ব্যবহার করব, তার জন্য পানিপ্রবাহ বাড়াতে হবে। দখল ও দূষণ কমানো লাগবে। আমাদের নেদারল্যান্ডস ও জাপানের সহায়তায় নদী নিয়ে দুইটা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হয়েছিল। (এই দুইটা থাকা সত্ত্বেও প্রধান উপদেষ্টা চীনের কাছে আবার পরিকল্পনা চেয়েছেন কেন, বোধগম্য নয়)।
এই পরিকল্পনা অনুসারে নদী পুনঃখনন ও দখলমুক্ত করতে হবেই। পুনঃখনন করলেই তো হবে না, নদীতে পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। আর তার জন্য উজানের পানি নিশ্চিত করা লাগবে। আর তা নিশ্চিত করতে গেলে চারটা প্রজেক্ট আমাদের জরুরি ভিত্তিতে করতে হবে। সেগুলো হলো—জাতিসংঘের পানিপ্রবাহ ১৯৯৭ চুক্তি স্বাক্ষর, এই চুক্তি স্বাক্ষর হলে ভারতের সঙ্গে আমরা ফারাক্কাসহ অন্য পানিবিষয়ক চুক্তিতে ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা, গঙ্গা ব্যারাজ এবং তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন। আমাদের আন্তদেশীয় পানি চুক্তিতে অবশ্যই আন্তর্জাতিক পানিবিশেষজ্ঞ আইনবিদ নিয়োগ দিতে হবে। আগের মতো আমলানির্ভর হলে, কোনো কিছুই হবে না।
দায় কি সব সরকারের? আমাদের কি কিছু করার নেই? বাড়ি করলে চারপাশে একটু মাটি রাখেন, যাতে পানি নেমে যেতে পারে। নতুন বিল্ডিংগুলোয় রেইনওয়াটার হারভেস্ট (রিইউজ) এবং গ্রে ওয়াটার হারভেস্ট (রিসাইকেল) বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলে অন্তত নিজেদের পানির ৩০ শতাংশ আমরা নিজেরাই রক্ষা করতে পারব। ছাদে গাছ, বাগান ও এখন পরিবেশ রক্ষার জন্য কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে। মিরপুরের একটি স্কুলে রেইনওয়াটার হারভেস্টিং চালু করে বছরে প্রায় ২০ শতাংশ পানির সাশ্রয় হচ্ছে। মতিঝিলের একটি অফিস ভবনে ছাদবাগান করে ছাদ তাপমাত্রা গড়ে ৪ ডিগ্রি কমেছে। এই উদ্যোগগুলো দেখিয়ে দেয়, ব্যক্তিপর্যায়ের পরিবর্তনও পরিবেশ রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
ঢাকায় ১৩ লাখ গাছ আছে, যা মোট শহরের ১০ শতাংশ। আমাদের এই সংখ্যা ২৫ শতাংশ করতে হবে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার উন্নয়ন এবং সৌন্দর্যবর্ধনের নামে অনেক গাছ কেটে ক্ষতি করে গেছে। বায়ুদূষণের চ্যাম্পিয়ন এই নগরীকে বাঁচাতে হলে গাছের বিকল্প নেই।
ঢাকার দূষণ কোনো পৃষ্ঠের ধুলা নয়, বরং গভীর কাঠামোগত সমস্যা। পরিবেশ অধিদপ্তর (ডিওই) এবং বিশ্বব্যাংক (২০২৩) অনুযায়ী, ৫৮ শতাংশ পিএম ২ দশমিক ৫ আসে ইটভাটা থেকে; ১৮ শতাংশ আসে যানবাহন থেকে; ১০ শতাংশ আসে নির্মাণকাজের ধুলা থেকে এবং ১৪ শতাংশ আসে বর্জ্য পোড়ানো, জৈব জ্বালানি ও শিল্প থেকে। এই দূষণ সার্বক্ষণিক তৈরি হচ্ছে। এই ইটভাটা বন্ধ করতে হবে এবং নতুন টেকনোলজি আনতে হবে। এটা ইতিমধ্যেই এ অঞ্চলে চলে আসছে।
কলকাতা ও ইয়াঙ্গুন আমাদের পাশের দেশের দুই শহর, যাদের আবহাওয়াও আমাদের মতো। কিন্তু তাদের দেশে তো এ রকম বালু বা ধুলা নেই। আমাদের এই অতিরিক্ত ধুলার সঙ্গে মরুকরণের কোনো ভূমিকা আছে? এ ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা উচিত। এবং যদি থাকে, তা হলে আবার আমার আগের আলোচনা, বায়ুদূষণের সঙ্গে পানিও জড়িত।
ঢাকা শহরের অতিরিক্ত ধুলাবালু সৌর প্যানেলের কার্যকারিতা প্রায় ২৫ থেকে ৩০শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দেয়, যা এনার্জি খাতের জন্য বিশাল ক্ষতি।
এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘প্লাস্টিক বিপর্যয় বন্ধকরণ’। কিন্তু প্লাস্টিক ছাড়া কি আমাদের এক দিনও চলে? বাংলাদেশে প্লাস্টিক বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল সেই বিএনপি জোট সরকারের আমলে। কিন্তু এই এক জিনিস না থাকার কারণে পুরো সিস্টেম বিপর্যস্ত হয়ে যায়। তখন পলিথিনের পুরুত্ব বাড়িয়ে এবং হাতল বাদ দিয়ে চালু করা হয়। কিন্তু তা আসলে এই বিশাল জনসংখ্যার ব্যবহারে খুব বেশি পরিবর্তন আনতে পারেনি।
এই সরকারও বন্ধের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বিকল্পের অভাবে আবারও ব্যর্থ হলো। সে রকম প্লাস্টিকজাত দ্রব্যের দামের কারণে আমাদের বিকল্প নেই। দূষণের সঙ্গে আরও দুটি বড় ক্ষতি করেছে আমাদের ময়লার ভান্ডারে সব ধরনের বর্জ্য একসঙ্গে থাকে। ফলে আমরা বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি না। এবং এখন দেশের মানুষের মধ্যে ক্যানসার প্রায় মহামারির মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে। যার একটা প্রধান কারণ প্লাস্টিকজাত দ্রব্য। আবার এই বর্জ্য নষ্ট না হওয়ায় আরও আগুন দিয়ে পোড়ানো হচ্ছে, যা বায়ুদূষণের একটা প্রধান কারণ। আমাদের বর্জ্য আলাদা করা শুরু করতে হবে এখন থেকেই।
বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকিতে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর একটি। প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও নদীভাঙনের ক্ষতি ক্রমেই বাড়ছে। জলবায়ু অভিযোজনের জন্য টেকসই অবকাঠামো, সবুজ বেড়িবাঁধ এবং দুর্যোগ-পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থার দিকে বিনিয়োগ জরুরি। অভিযোজন এখন বিলাসিতা নয়, অস্তিত্বের লড়াই।
বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকিতে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর একটি। প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও নদীভাঙনের ক্ষতি ক্রমেই বাড়ছে। জলবায়ু অভিযোজনের জন্য টেকসই অবকাঠামো, সবুজ বেড়িবাঁধ এবং দুর্যোগ-পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থার দিকে বিনিয়োগ জরুরি। অভিযোজন এখন বিলাসিতা নয়, অস্তিত্বের লড়াই।
বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার পরিবেশকে উন্নয়নের পথে বাধা হিসেবে চিহ্নিত করে অনেক ক্ষতি করে রেখে গেছে। পরিবেশ নিয়ে যত প্রজেক্ট ছিল, তা কাজের থেকে টাকা নয়ছয়ের মাধ্যম হয়ে গিয়েছিল। এক লাখ গাছ লাগানো হলেও বেশির ভাগই মরে গেছে। এই জন্যই আমরা বিভিন্ন বনখেকো মানুষজনকে পেয়েছি। প্রতিবছর গড়ে ২৬ হাজার একর করে বনভূমি দখল হওয়ার দায় রাজনৈতিক দলেরই। বিদেশ থেকে আমাদের অনেক ফান্ড আসে পরিবেশের জন্য, কিন্তু সেগুলোর কোনো বাস্তব প্রয়োগ দেখা যায় না।
আমাদের সরকারি কর্মচারীদের হাতে পড়ে হয়ে যায় সেই কাজীর গরু, কেতাবে আছে শুধু। যা এখনো চলমান, ভবিষ্যতেও থাকবে। আমাদের দরকার ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট করার এবং তা তৃতীয় পক্ষ দিয়ে মূল্যায়ন করাতে হবে।
এই সরকারে একজন বিশিষ্ট পরিবেশ–বিশেষজ্ঞকে দায়িত্ব দেওয়াতে আমাদের মধ্যে আশার সঞ্চার হলেও কাজের গতি খুব মন্থর। পলিথিন বন্ধের চেষ্টা, তারপর কিছু খাল খননের শুরু, বিদেশি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর গাছ নিষিদ্ধ, ১৯৯২ সালের জাতিসংঘ পানি কনভেনশনে স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত (যদিও তা আমাদের জন্য কার্যকর নয়) কিছু উল্লেখ্যযোগ্য কাজ। কিন্তু তাঁর কাছে থেকে আমাদের আশা আরও বেশি কিছু ছিল। অন্তত জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ কনভেনশন ১৯৯৭ যদি স্বাক্ষর করে যেতেন, আমাদের অন্য কারও ওপর ভরসা করতে হতো না।
পরিচয় সূত্রে প্রায় সব দলের সঙ্গেই কমবেশি কথা হয়। এর মধ্যে এখনো জাতীয় নাগরিক পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী পরিবেশ নিয়ে পরিষ্কার কোনো পরিকল্পনা নিয়ে আসেনি। বিএনপি এদিকে একটু এগিয়ে এসে কিছু পরিকল্পনা জানিয়েছে; যেমন বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে রিজার্ভার, খাল খনন, ৫ বছরে ২৫ কোটি গাছ লাগানো, উন্মুক্ত মাঠের সংখ্যা বৃদ্ধি, পলিথিন নিষিদ্ধ করে বিকল্প পাটকে প্রোমোট করা ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এখন আসলে এত অল্প কাজ করে দেশ বাঁচানো যাবে না। বিএনপির কাছ থেকে ব্যাপক এবং বাকিদের থেকেও পরিকল্পনা জানার অপেক্ষায় থাকলাম।
‘সেভ তুরাগ’, ‘বুড়িগঙ্গা বাঁচাও’—এসব আন্দোলন প্রমাণ করেছে যে জনগণ এক হলে প্রশাসনও নড়ে। পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নাগরিক সংগঠন ও তরুণদের ভূমিকাকে শক্তিশালী করতে হবে। একা সরকার কিছু করতে পারবে না, আর একা জনগণও নয়—দরকার ঐক্য।
আমরা পরিবেশ নিয়ে পরিকল্পনা করে করে অনেক সময় কাটিয়েছি। সব সমস্যা একটা আরেকটার সঙ্গে জড়িত। বলতে গেলে আসলে বই হয়ে যাবে। আমাদের মোটামুটি সব সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন কাজ করা শুরু করে দিতে হবে।আমাদের নিজেদেরই সামর্থ্য আছে বেশির ভাগ কাজ সম্পন্ন করার মতো।
এ ব্যাপারে পরিবেশবিজ্ঞানী ও জলবায়ু–বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে প্রকৌশলী, সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে বেসরকারি খাতসহ কাজ করলেই সম্ভব। আর পরিবেশ নিয়ে কাজ করলে বিদেশি ফান্ডও আসবে। কিন্তু বিড়ালের গলাতে ঘণ্টা বাঁধবে যে কে, সেটা হচ্ছে না।
আমাদের এবারের বাজেটে ও পরিবেশ খাতে বরাদ্দ জিডিপির শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। কিন্তু আমাদের যে ব্যাপক কাজ করতে হবে, তার জন্য অন্তত ২ শতাংশ বরাদ্দ রাখতে হবে। এই দেশকে আমরা পুরোই সৃষ্টিকর্তার দয়ার ওপর রেখে দিয়েছি। কিন্তু সৃষ্টিকর্তাও সাহায্য করবেন না, যতক্ষণ আমরা নিজেরা চেষ্টা না করব। সেই চেষ্টার শুরুটা শুরু কবে হবে?
সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট।
ই–মেইল: [email protected]