দেশে যে জুলাই বিপ্লব ঘটে গেল, সেটি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সময়কার বিশ্ব ও বাংলাদেশের জন্য এক অনন্যসাধারণ ঘটনা।
মানুষের দৈনন্দিন জীবনের শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন, পেশা, সর্বোপরি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে একেবারেই ভিন্ন আঙ্গিকে বিবর্তিত করেছে যে সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেম, সেটিই হলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মূল প্রতিপাদ্য।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব যুগের বিশেষ উপাদান টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেটের ব্যবহার এই বিপ্লবের অনন্য নিয়ামক। ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ, মতবিনিময়, তথ্যের আদান–প্রদান, প্রতিমুহূর্তের ঘটনার সরাসরি প্রচার, মুহূর্তের মধ্যেই বিপুল মানুষের অংশগ্রহণে মতামত তৈরি (ওপিনিয়ন ফরমুলেশন), অপতথ্য, ভুল তথ্য, ডিপ ফেক, গোপনে ও প্রকাশ্যে দিকনির্দেশনা প্রচার ইত্যাদি আন্দোলনকে করেছে বহুমাত্রিক এবং এগিয়ে নিয়ে গেছে দুর্বার গতিতে। ভার্চ্যুয়াল বা সাইবার স্পেস যে মানুষের বাস্তব জগৎকে কতটা প্রভাবিত করে, জুলাই বিপ্লব তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সব মানুষের জন্য এ এক ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা।
অন্যদিকে সেই সময় ইন্টারনেট বন্ধের ফলে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগবিচ্ছিন্নতা, অনলাইনে বিল পরিশোধ করতে না পারায় পানি ও বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অফলাইন এবং বিশেষত অনলাইন ব্যবসায়িক যোগাযোগ বন্ধ হওয়া, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বন্ধ থাকা মানুষের হতাশা ও ক্ষোভকে নিয়ে গেছে চরম পর্যায়ে। ইন্টারনেট সংযোগের অভাবে প্রবাসীদের দেশের সঙ্গে যোগাযোগবিচ্ছিন্নতা এবং বিদেশের সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক লেনদেনের অচল অবস্থা মানুষ ও নানান প্রতিষ্ঠানকে ভিন্ন রকমের বিপাকে ফেলেছে।
বাংলাদেশের মানুষের ডিজিটাল মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীলতার একটি বাস্তব উদাহরণ উন্মোচন করেছে এই জুলাই বিপ্লব। বর্তমান বিভিন্ন নাগরিক সেবা, ব্যবসায় লেনদেন, শিক্ষা কার্যক্রম, যান চলাচল, চিকিৎসাসেবা, বিনোদনসহ সার্বিক জীবনব্যবস্থা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেটনির্ভর। বাস্তবতার নিরিখে জুলাই বিপ্লবের চেতনার বাংলাদেশ নির্মাণের পরিকল্পনা হতে হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকেন্দ্রিক। একটি সমৃদ্ধিশালী, আত্মনির্ভর ও ভবিষ্যৎমুখী বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন মানুষকেন্দ্রিক টেলিযোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি এবং অন্যান্য অত্যাধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক ডিজিটাল রূপান্তর।
এই ডিজিটাল রূপান্তর বিষয়ে বৈশ্বিক পরিস্থিতির দিকে নজর দেওয়া যাক। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে পৃথিবী পদার্পণ করেছে ডিজিটাল ভবিষ্যতে এবং এ লক্ষ্যে সব দেশই বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছে। আর ডিজিটাল ভবিষ্যতে প্রবেশের প্রথম ধাপ হলো ডিজিটাল রূপান্তর।
ডিজিটাল রূপান্তর একটি বৈশ্বিক প্রক্রিয়া এবং পৃথিবীর সব দেশই বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডিজিটাল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে।
এ ডিজিটাল রূপান্তর একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন–পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে হয়। মনে রাখার প্রয়োজন, এই ডিজিটাল রূপান্তর একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং নিয়ত পরিবর্তনশীল। প্রযুক্তি পরিবর্তন ও নতুন উদ্ভাবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই রূপান্তরকে বাস্তবসম্মত ও টেকসই রাখতে হয়।
যথাযথ ডিজিটাল রূপান্তরের পরিকল্পনা ও এর পর্যায়ক্রমিক বাস্তবায়ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন (নতুন ব্যবসায়িক সুযোগ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি), শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন (অনলাইন শিক্ষা ও দক্ষতা প্রশিক্ষণ), স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন (টেলিমেডিসিন ও স্বাস্থ্যতথ্য ব্যবস্থাপনা), সরকারি সেবা (ই-গভন্যান্সের মাধ্যমে দ্রুত ও স্বচ্ছ সেবা প্রদান), বাণিজ্য ও শিল্প (ই-কমার্স ও স্মার্ট ফ্যাক্টরি প্রযুক্তির ব্যবহার), সামাজিক অন্তর্ভুক্তি (ডিজিটাল বৈষম্য কমানো), পরিবেশ সুরক্ষা (স্মার্ট সিটি ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি), বৈশ্বিক সংযোগ ইত্যাদি বিষয়কে অগ্রগামী ও অর্থবহ করবে এবং সে সঙ্গে নিশ্চিত করবে জবাবদিহি।
জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে আটটি লক্ষ্যমাত্রা সরাসরি ডিজিটাল রূপান্তর এবং এ-সংক্রান্ত সক্ষমতা তৈরিকেন্দ্রিক। এ ছাড়া অন্য সব উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোও ডিজিটাল রূপান্তরের ওপর নির্ভরশীল।
জাতিসংঘ কর্তৃক ডিজিটাল রূপান্তর, ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি, সাইবার সুরক্ষা এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল ভবিষ্যৎ গঠনে বেশ কিছু উদ্যোগ ও ঘোষণা চলমান রয়েছে, যেমন:
বিশ্ব তথ্য সমাজ সম্মেলন (ডব্লিউএসআইএস) ২০০৩ সালে গৃহীত জাতিসংঘের একটি উদ্যোগ, যা বিভিন্ন প্রকার ডিজিটাল ও যোগাযোগপ্রযুক্তির মাধ্যমে বৈশ্বিক উন্নয়ন বিষয়ে আলোচনার একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্ম। ডব্লিউএসআইএস অ্যাকশন লাইন আইসিটি অবকাঠামো, ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থা এবং দক্ষতা, প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহার, ডিজিটাল বিভাজন দূরীকরণ বিশেষ গুরুত্ব পায়।
ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরাম (আইজিএফ): ২০০৫ সালে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠা হওয়া আইজিএফ একটি মাল্টিস্টেকহোল্ডার প্ল্যাটফর্ম, যেখানে ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি–সম্পর্কিত বিভিন্ন পাবলিক পলিসি ইস্যু নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা হয়। আইজিএফে ডিজিটাল অধিকার, সাইবার নিরাপত্তা, সাইবার আইন এবং বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট অ্যাকসেস–বিষয়ক আলোচনা প্রাধান্য পায়।
গ্লোবাল ডিজিটাল কমপ্যাক্ট (জিডিসি): এটি হলো ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশ্ব পরিচালনার জন্য একটি বৈশ্বিক সমন্বয়ের ও সহযোগিতার প্ল্যাটফর্ম। ইনফরমেশন সোসাইটির (ডব্লিউএসআইএস) বিশ্ব শীর্ষ সম্মেলনের ২০ বছর পর, ডিজিটাল প্রযুক্তির বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এবং ডিজিটাল বিভাজন বন্ধ করার জন্য বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল সহযোগিতার জন্য একটি রোডম্যাপ। ২০২৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বিশ্বের রাষ্ট্রনেতারা ভবিষ্যতের শীর্ষ সম্মেলনে (সামিট ফর দ্য ফিউচার) ভবিষ্যতের জন্য একটি সমন্বিত চুক্তি গ্রহণ করেছেন, যার মধ্যে গ্লোবাল ডিজিটাল কমপ্যাক্ট (জিডিসি) অন্যতম।
ডিজিটাল নৈতিকতা (ডিজিটাল এথিকস): ইউনেসকো ডিজিটাল নৈতিকতা নিয়ে অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, বিশেষত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সম্পর্কিত। ২০২১ সালে এআইয়ের নৈতিকতা–সম্পর্কিত সুপারিশ প্রকাশ করেছে ইউনেসকো, যেখানে এআই ব্যবহারের জন্য মানবাধিকার, স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ), ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ), ওয়ার্ল্ড ব্যাংক (বিশ্বব্যাংক), অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো–অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি), এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো–অপারেশন (অ্যাপিইসি), ইউরোপিয়ান কমিশন চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার, বৈশ্বিক সহযোগিতা ও নীতি প্রণয়ন, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, সাইবার নিরাপত্তা এবং ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি নিয়ে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য যুগোপযোগী নাগরিক সুবিধা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিক্ষা, চিকিৎসা ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে ডিজিটাল রূপান্তরের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের জন্য অর্থবহ ডিজিটাল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে প্রয়োজন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পরিকল্পনা। এ কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে এই বিষয়ে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন ব্যক্তিদের। এ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন মাল্টিস্টেকহোল্ডারের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে। বাংলাদেশের যথাযথ ডিজিটাল রূপান্তরের পরিকল্পনা ও তার ধারাবাহিক বাস্তবায়ন জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ করে একটি বৈষম্যহীন, জবাবদিহিমূলক, মানবকেন্দ্রিক সর্বজনীন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) খলিলুর রহমান বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক