আমরা যাচ্ছি কোন দিকে

পাঁচ মাস হলো আমরা শেষবার স্বাধীন হয়েছি। আমরা বড়ই স্বাধীনতাপ্রিয় জাতি। বারবার স্বাধীন হতে মন চায়। ১৯৪৭ সালে একবার হলাম। কয় দিন যেতে না যেতেই আমাদের মনে হলো, আমাদের ওপর বৈষম্য হচ্ছে, আমরা অন্যায়ের শিকার হচ্ছি। তো অবস্থা বদলে দিতে আমরা অনেক আন্দোলন করলাম। আন্দোলন করতে হলে কিছু লোককে মরতে হয়। লাশ না পড়লে আন্দোলন চাঙা হয় না। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ ও অনেক রক্তের বিনিময়ে আবার স্বাধীন হলাম। পরে দেখা গেল, জাতির পিতা পাল্টানো ছাড়া আমরা আর কোনো কিছু বদলাতে পারিনি। একটা জাতি থাকলে তার একটা পিতা থাকতে হয়, এই বিশ্বাস আমাদের মজ্জায় এখনো মিশে আছে।

একাত্তরের পর যে কতবার স্বাধীন হলাম, তা গুনে দেখতে হবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমরা ঘোষণা শুনলাম, ‘সূর্যসন্তানেরা’ দেশটা স্বাধীন করে ফেলেছে। আমরা ছিলাম অন্য একটি দেশের উপগ্রহ। এখন আমরা পরিপূর্ণ গ্রহ হিসেবে জ্বলজ্বল করব।

শুধু স্বাধীন হলেই তো চলবে না। আমাদের গণতন্ত্রও চাই। আমরা নানান কিসিমের গণতন্ত্রের মহড়া দেখলাম। মুজিববাদী গণতন্ত্র, শোষিতের গণতন্ত্র, উন্নয়নের গণতন্ত্র। তাতে আমদের মন ভরল না। ১৯৯০ সালে আমরা আবার স্বাধীন হলাম। সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিন মাস আমরা সত্যিই স্বাধীন ছিলাম। তারপর আমরা ফিরে গেলাম রাজতন্ত্রে, যেটা আমরা হারিয়েছিলাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে।

এ অঞ্চলে আমরা একসময় মোগল-পাঠানের দ্বৈরথ দেখেছি। এটাই ফিরে এল। কখনো মোগল আর কখনো পাঠানের রাজত্ব। এর মধ্যে বেরসিক মিলিটারি দিল একটা ঝাঁকুনি। মানুষ যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু মিলিটারিরা একসঙ্গে অনেকগুলো ফ্রন্ট খুলে তৈরি করল লেজেগোবরে অবস্থা। ২০০৯ সালে আমরা আবার ফিরে এলাম রাজতন্ত্রে। রাজতন্ত্রের দ্বিতীয় মেয়াদে ছিল অসুরদের রাজত্ব। তারা মানুষ, পশুপাখি, গাছগাছালি, পাহাড়-সমতল, খাল-বিল, নদী-নালা; এমনকি অফিস-আদালতও খেয়ে ফেলল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আমরা আবার স্বাধীন হলাম। এ জন্য অনেক শহীদের দরকার হলো।

পাঁচ মাস হলো আমরা নতুন স্বাধীনতার স্বাদ নিচ্ছি। আমরা এবার সত্যিই স্বাধীন। যার যা মনে চায়, করতে বাধা নেই। আপনার মনে হলো, আপনার কিছু চাই। মিনতি করে কাজ হচ্ছে না। দশ-বিশজন লোক জোগাড় করে সোজা চলে যান শাহবাগ। ওখানে একটা চৌরাস্তা আছে। সেখানে কয়েক ঘণ্টা বসে থাকলে ঢাকা নরক হয়ে যায়। নাম দিলেন অবরোধ। ব্যস, আপনার দাবি আদায় হয়ে গেল। হেডমাস্টার, প্রিন্সিপাল, উপাচার্য কথা শোনে না। তাকে ঘরে তালা মেরে রেখে দিন। কাজ আদায় হয়ে যাবে।

স্বাধীন দেশে এখন অনেক কথাই হবে। কেউ কারও মুখ বন্ধ রাখতে পারবে না। আমরা ধীরে ধীরে এতে অভ্যস্ত হয়ে যাব। তারপরও বোকা মানুষদের মনে প্রশ্ন উঁকি দেয়, এত সরকার এল-গেল, এতবার আমরা স্বাধীন হলাম, তাতে এগোলাম কতটুকু? দেশের বেশির ভাগ মানুষ চাষাভুষা, মুটে-মজুর। তারা এখনো নাগরিক হয়ে উঠতে পারেনি। রাজনীতির পালাবদলের হাওয়া তাদের গায়ে লাগে না। তারা জানে, শহরের বাবুদের বিশ টাকায় ফুলকপি খাওয়াতে হলে তাকে সেটা বেচতে হবে এক টাকায়। এ নিয়ে বাবুদের কোনো ভাবনা নেই। তারা বলবে, সব দোষ সিন্ডিকেটের, যেটা কখনো ভাঙা যায় না।

কিছু লোক অবস্থাটা মেনে নিতে পারছে না। তারা বলে বেড়াচ্ছে, দেশে কোনো শৃঙ্খলা নেই। কেউ কারও কথা শোনে না। আগেই তো ভালো ছিলাম। আসলে আমরা কখনো তো স্বাধীন ছিলাম না, তাই স্বাধীনতার মাজেজা বুঝিনি। স্বাধীনতা মানেই হলো আপনার যা ইচ্ছা তা-ই করবেন। এটা আমাদের অভ্যাসে নেই বলে এর স্বাদ প্রথম প্রথম তেতো মনে হয়। অভ্যাস হয়ে গেলে সবই সয়ে যাবে। বাঙালি যেমন চরম অধৈর্য প্রজাতি, তার সহ্যগুণও অসীম। তা না হলে তারা হাজার বছর বিদেশিদের পায়ের তলায় থাকে! মোটে তো পাঁচ মাস। এদের একটু সময় দিতে হবে না? এক উজির তো বলেই ফেলেছেন, তাঁর হাতে আলাদিনের চেরাগ নেই।

আগে বোঝা যেত, দেশে একটা সরকার ছিল। কেউ কিছু বললে পাইক-পেয়াদা তেড়ে আসত। এখন তো জনতার পৌষ মাস। পুলিশ ঢুকে গেছে কোটরে। সরকার মানেই ক্ষমতা। সেটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারটা কোথায়? ওটা কি সচিবালয়ে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, যমুনায়, ক্যান্টনমেন্টে? নাকি সব জায়গায়? কে যে কোথা থেকে ছড়ি ঘোরাচ্ছে, বোঝার উপায় নেই। কেউ বলছে রাজুতে আয়। কারও মুখে শুনি, কলম ভেঙে দেব। স্বাধীন দেশে প্রতিবাদও করা যাচ্ছে না। কিছু বললেই বলবে, ব্যাটা স্বৈরাচারের দোসর, ওর চামড়া তুলে নাও।

এই একটা অসুখ, যা ১৯৭২ সালে দেখেছি। তখন আমাদের মধ্যে স্বাধীন-স্বাধীন ভাব। কল্পিত শত্রুকে গণপিটুনি দিয়ে পরপারে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারপর সরকার একটু গুছিয়ে বসল। সরকার প্রবল হলে স্বাধীনতা কমে যায়। পিটুনির দায়িত্বটা রাজপথ থেকে চলে গেল সরকারের হাতে। এ জন্য তৈরি হলো নানান বাহিনী।

এখন আমরা আবার নতুন করে স্বাধীনতার সুবাস পাচ্ছি। ফিরে এসেছে গণপিটুনি। এর একটা ভারিক্কি নাম দেওয়া হয়েছে ‘মব জাস্টিস’। দেশের বিচারব্যবস্থা কাজ করে না। সুতরাং একটা ‘মব’ দিয়ে যাকে অপছন্দ, তাকে গায়ের জোরে হিসাব বুঝিয়ে দেওয়া।

এদিকে বাজারে আগুন। যা রোজগার, তাতে অনেকের হাঁড়ি চড়ে না। তো একদল লোককে খুশি করা হবে মাগ্‌গি ভাতা দিয়ে! কিন্তু টাকা আসবে কোথা থেকে? খাজনা বসাও। তো খাজনা গেল বেড়ে। উজির-নাজিররা বলছেন, খাজনা বাড়লেও জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না। এ এক নতুন অঙ্ক, যেটা যাদববাবুর পাটিগণিতে নেই। নতুন করে শিখতে হবে। মানুষ শিখতে চায় না। চারদিকে এখন ভ্যাট নিয়ে শোরগোল।

এত দিন যারা রাস্তাঘাটে চাঁদা তুলে খেত, তাদের দুর্দিন গেছে কিছুটা সময়। তারপর স্থিতাবস্থা ফিরে এসেছে। এক দলের জায়গায় আরেক দল খেয়াঘাট, সেতু, ট্রাকস্ট্যান্ড, বাস টার্মিনাল, হাসপাতাল, পাসপোর্ট অফিসের ইজারা নিয়ে গেছে। চাঁদা না তুললে খাবে কী? এটাও তো একটা কর্মসংস্থান!

স্বাধীন দেশে সবাই স্বাধীন। আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে। স্বৈরাচারী সরকার শহরের ভেতরে ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল। স্বাধীন হওয়ামাত্রই এসব রিকশা হু হু করে শহরে ঢুকে গেল হাজারে হাজারে। আমরা হয়ে গেলাম গরিবের বন্ধু। সমাজে বৈষম্য থাকবে কেন? গাড়ি চললে, রিকশা কেন চলবে না। কথাটা ফ্যালনা নয়। ঢাকা এখন রিকশাময়। স্বাধীনতা আমাদের অনেক শব্দ শিখিয়েছে। আগেও জানতাম। এখন সেগুলো ঘুঁটে-বেটে গিলিয়ে দিচ্ছে। এমন একটি শব্দ হচ্ছে ‘সংস্কার’। সংস্কার তো লাগবেই। আমাদের ঘরের দেয়ালের রং উঠে গেছে, পলেস্তারা খসে গেছে, কার্নিশে বটগাছ গজিয়েছে। এসব মেরামত হবে, নাকি ভেঙে নতুন করে বানাতে হবে, এ নিয়ে মহাতর্ক।

এর মধ্যে আরেক ঝামেলা। সংস্কার না নির্বাচন—এ নিয়ে লেগেছে হুজ্জত। কেউ কেউ চান এখনই নির্বাচন হোক। বয়স হয়েছে। চলতে-ফিরতে কষ্ট হয়। বছরে ছয় মাস হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। এখন যদি নির্বাচন না হয়, তাহলে তো জীবদ্দশায় ক্ষমতার স্বাদ নেওয়া হবে না। তাড়া থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সংস্কারপন্থীরা এই মুহূর্তে নির্বাচনের প্রয়োজন দেখেন না। নির্বাচন তো অনেক হলো। তাতে কী ফায়দা হয়েছে? সুতরাং আগে একটা ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, যাতে কেউ আর আগের মতো ঘাড়ে চেপে রক্ত চুষতে না পারে। এ যুক্তিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

স্বাধীন দেশে এখন অনেক কথাই হবে। কেউ কারও মুখ বন্ধ রাখতে পারবে না। আমরা ধীরে ধীরে এতে অভ্যস্ত হয়ে যাব। তারপরও বোকা মানুষদের মনে প্রশ্ন উঁকি দেয়, এত সরকার এল-গেল, এতবার আমরা স্বাধীন হলাম, তাতে এগোলাম কতটুকু? দেশের বেশির ভাগ মানুষ চাষাভুষা, মুটে-মজুর। তারা এখনো নাগরিক হয়ে উঠতে পারেনি। রাজনীতির পালাবদলের হাওয়া তাদের গায়ে লাগে না। তারা জানে, শহরের বাবুদের বিশ টাকায় ফুলকপি খাওয়াতে হলে তাকে সেটা বেচতে হবে এক টাকায়। এ নিয়ে বাবুদের কোনো ভাবনা নেই। তারা বলবে, সব দোষ সিন্ডিকেটের, যেটা কখনো ভাঙা যায় না।

আমরা যাচ্ছি কোন দিকে, কোথায়? সামনে কী অপেক্ষা করছে? মধুর নহর, নাকি একরাশ হতাশা?

  • মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক