মতামত
পথের বাধা সরিয়ে নিন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে এগোতে দিন
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়–সংক্রান্ত আইনটির লক্ষ্য ছিল নতুন এক ধারার সূচনা। সেই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। কিন্তু এখন এর সীমাবদ্ধতা নতুন সংকট তৈরি করছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে লিখেছেন মুনির হাসান
আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে গত জুলাই মাসে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছি। সেখানেই দেখা হয় জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির আমার সাবেক সহকর্মী প্রকৌশলী শাকিবের সঙ্গে। একসময় তিনি পরিকল্পনা কমিশনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা ছিলেন। পরে একটি বহুজাতিক ইলেকট্রনিক কোম্পানিতে হেড অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রায় আড়াই দশকের কর্মজীবনে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, বিশ্বব্যাংক, ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট গভর্নমেন্টের জন্য কাজ করেছেন তিনি। অথচ একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হলো তাঁর অস্ট্রেলিয়ায় ইমিগ্রেশনের আবেদন করায়।
শাকিব বললেন, ‘ইমিগ্রেশনের জন্য আবেদন করার পর দেখলাম আমার ব্যাচেলর ডিগ্রি সেখানে ডিপ্লোমা হিসেবে বিবেচনা করেছে। আর অস্ট্রেলিয়া কম্পিউটার সোসাইটি (কম্পিউটার পেশাজীবীদের বিশ্বের অন্যতম সংস্থা) এ জন্য অ্যাসেসড এক্সেপিরিয়েন্সের পাঁচ বছর কেটে নিল, ডিপ্লোমার সঙ্গে ওই অভিজ্ঞতা যোগ করে পূর্ণাঙ্গ ব্যাচেলরের সমমান ধরবে বলে। জিজ্ঞেস করাতে আইনজীবী জানিয়েছেন, আমার বিশ্ববিদ্যালয়কে “বি ক্যাটাগরি” বলা হয়েছে—যেটা ইউজিসি থেকে অস্ট্রেলিয়া সরকারকে পাঠানো হয়েছিল।’
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার পরিধি আজ যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।
আমরা বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিবেচনা করছি ‘বৈমাত্রেয় ভাই’ হিসেবে; পদে পদে তাদের সামনে নিত্যনতুন বাধার সৃষ্টি করেছি।
বিস্ময় এখানেই। দেশে শাকিবের অধীনে কাজ করেছে একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। তিনি নিজে ইউএনডিপি ও বহুজাতিক সংস্থায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারপরও একদা ইউজিসির কারও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, ‘ওরা তো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, ওদের ডিগ্রিই–বা কী!’
বছর কয়েক আগে এই বৈষম্য দূর হয়েছে বটে, কিন্তু শাকিবের মতো অনেকেরই জীবনের মূল্যবান কয়েক বছর হারিয়ে গেছে।
আমার অন্যতম প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক রিজওয়ান খানের কথাও আমি প্রায়ই বলি। দেশে প্রকৌশল শিক্ষায় পিএইচডি গবেষণার সূত্রপাত বুয়েটে। সেখানে পিএইচডি গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ তিনি। পরে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য হিসেবে প্রতিষ্ঠানটিকে দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেছেন। বিশ্বমানের গবেষণা করেছেন, আধুনিক ল্যাব গড়েছেন, আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব তৈরি করেছেন।
গবেষণাকাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৭-১৮ সালে অধ্যাপক খান বিশ্বের ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারদের প্রেস্টিজিয়াস ও সবচেয়ে বড় পেশাজীবী সংস্থা আইইইইর ডিস্টিংগুইশড লেকচারার হয়েছেন। তবু তিনি কোনো পিএইচডি গবেষণা করাতে পারেন না, কারণ তিনি ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক’। অথচ অতিসাম্প্রতিক কালে প্রতিষ্ঠিত, গবেষণার অবকাঠামোহীন অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও অনায়াসে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করতে পারে!
আর ঠিক এভাবেই আমরা বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিবেচনা করছি ‘বৈমাত্রেয় ভাই’ হিসেবে; পদে পদে তাদের সামনে নিত্যনতুন বাধার সৃষ্টি করেছি।
শিক্ষা ও অর্থনীতিতে অবদান
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার পরিধি আজ যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলো বাদ দিলে দেশে মোট উচ্চশিক্ষার্থীর প্রায় অর্ধেকই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নির্ধারিত সময়েই একাডেমিক কার্যক্রম শেষ হয়, তাই এর প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহও ক্রমাগত বাড়ছে।
একসময় বলা হতো, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল উচ্চবিত্তের সন্তানেরা পড়েন। কিন্তু দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার খণ্ডকালীন শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা এবং সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় দেখেছি, বাস্তবতা ভিন্ন।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস, অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির (আইইউবিএটি) ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন ও বুয়েটে আমার সতীর্থ অধ্যাপক ড. মনিরুল ইসলাম জানালেন, আইইউবিএটিতে তাঁর এক ছাত্র এখন যুক্তরাষ্ট্রে মাস্টার্স করছে, যার পিতা একজন রিকশাশ্রমিক। সে নিজেও ছাত্রাবস্থায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেধাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য হারে বৃত্তির ব্যবস্থাও করে থাকে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলে এই শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ হয়তো উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যেতে পারত না।
আরেকটি ভুল ধারণা হলো, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো শিক্ষক নেই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দেশের বিভিন্ন খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা শিক্ষকেরা যেমন এখানে কাজ করছেন, তেমনি প্রচুর প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষকও পড়াচ্ছেন। তাঁদের রয়েছে বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা কিংবা প্রতিষ্ঠানে গবেষণার অভিজ্ঞতা। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি মেলে না।
ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্যতর শিক্ষকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এ কারণে সাম্প্রতিক কিউএস এশিয়া র্যাঙ্কিংস ২০২৫–এও দেখা যায়, বাংলাদেশের তালিকায় থাকা কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমান বা এগিয়ে আছে।
অন্যদিকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নতুন বিভাগ খোলার জন্য যে কাঠখড় পোড়াতে হয়, তাতে যুগোপযোগী ও নতুন বিষয় চালু করা সময়সাপেক্ষ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনুমোদন পেলেই দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এ কারণে ডেটা সায়েন্স ও এআই, ইনোভেশন ও এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপের মতো নতুন বিষয়গুলো আগে এসেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই।
যাত্রা শুরু
১৯৯২ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হওয়ার পর এ খাতের যাত্রা শুরু হয়। এ আইনই মূল কাঠামো নির্ধারণ করছে, যদিও এর সংশোধিত সংস্করণ ২০১০ সালে হয়েছে। সেই আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান এবং সিন্ডিকেট ও বোর্ড অব ট্রাস্টিজের অধীনে পরিচালিত। সরকারের অনুমোদনের পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তত্ত্বাবধানেই সবকিছু চলে।
এখন সময় পাল্টেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, ইন্টারনেট, স্মার্টফোনের অবারিত ব্যবহার এবং সর্বোপরি শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের ওপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাবে শিক্ষার ধরনও বদলেছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষক নিয়োগ, ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যোগাযোগ, ইন্টার্নশিপ, বিশেষায়িত ল্যাব—সবকিছু দ্রুততার সঙ্গে করতে হচ্ছে নিজেদের প্রয়োজনে। সেখানে ৩০ বছর আগের আইনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বেঁধে রাখা কতটা যুক্তিসংগত?
শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ: ইউজিসি নাকি অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল
বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষার মান যাচাই ও নিয়ন্ত্রণে অ্যাক্রেডিটেশন ব্যবস্থা থাকে। বাংলাদেশে দেরিতে হলেও ২০১৭ সালে আইন পাস হয় এবং ২০১৮ সালে কার্যক্রম শুরু করে বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল (বিএসি)।
বিএসির মূল দায়িত্ব হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রোগ্রাম অ্যাক্রেডিট করা, মান যাচাই করা এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য আনা। অর্থাৎ শিক্ষার মান নির্ধারণ ও স্বীকৃতির বিষয়টি এখন তাদের আওতায়। বিএসির ওয়েবসাইট অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত অ্যাক্রেডিটেশনের জন্য আবেদনকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এর মানে, মানের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যেতে আগ্রহ বেশি দেখা যাচ্ছে বেসরকারি খাতের।
প্রকৌশল শিক্ষার ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংস্থা বোর্ড অব অ্যাক্রেডিটেশন ফর ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনিক্যাল এডুকেশন (বিএইটিই)। ২০০৬ সাল থেকে ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের (আইইবি) অধীনে এর কার্যক্রম শুরু হয়।
শুরুতে স্থানীয় পটভূমিতে মান যাচাই করলেও ২০১১ সালে বিএইটিই ওয়াশিংটন অ্যাকর্ডের প্রভিশনাল সিগনেটরি হয় এবং ২০১৬ সালে পূর্ণ সদস্যপদ অর্জন করে। এর ফলে বাংলাদেশে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল প্রোগ্রাম বিএইটিই থেকে স্বীকৃত, সেগুলো এখন অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপানসহ ওয়াশিংটন অ্যাকর্ডভুক্ত অন্যান্য দেশের সমতুল্য হিসেবে গণ্য হচ্ছে।
বিশেষায়িত সরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল প্রোগ্রাম ইতিমধ্যে বিএইটিই থেকে অ্যাক্রেডিটেশন পেয়েছে। এগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে স্বীকৃত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রকৌশল শিক্ষাকে বৈশ্বিক অঙ্গনে নতুনভাবে পরিচিত করেছে। অন্যদিকে অনেক সাধারণ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগ এখনো অ্যাক্রেডিটেশনের প্রতি ততটা আগ্রহ দেখায়নি।
অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান
কেবল উচ্চশিক্ষা নয়, অর্থনীতিতেও বড় অবদান রাখছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর কর্মসংস্থান হচ্ছে। একই সঙ্গে গড়ে উঠছে গবেষণা তহবিল, ল্যাব, ক্যাম্পাসভিত্তিক সেবা খাত। আশুলিয়া ও পূর্বাচল তো বটেই, ঢাকার বাইরেও অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে ব্যবসাবান্ধব ইকোসিস্টেম তৈরি হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা
উচ্চশিক্ষার বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক। যুক্তরাষ্ট্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি নন-প্রফিট প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান—হার্ভার্ড বা এমআইটির মতো বিশ্বমানের গবেষণা ও উদ্ভাবনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে সেখানে ‘ফর–প্রফিট’ বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে, যারা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা দেয়।
যুক্তরাজ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে হলেও একাডেমিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা ভোগ করে। ভারতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্থান গত দুই দশকে চোখে পড়ার মতো। তুলনায় বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখনো নানা আইনি ও নীতিগত সংকটে আটকে আছে।
১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সংক্রান্ত আইনটির লক্ষ্য ছিল নতুন এক ধারার সূচনা। সেই লক্ষ্য পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু এখন এর সীমাবদ্ধতা নতুন সংকট তৈরি করছে। একদিকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান, অন্যদিকে প্রযুক্তিনির্ভর নতুন অর্থনীতির জন্য দক্ষ মানবসম্পদ প্রয়োজন। এমন অবস্থায় পুরোনো ধারা আঁকড়ে থাকা অর্থহীন।
বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা
২০১০ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধনের পর বাংলাদেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস খোলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় কাজও শুরু করেছে। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ ক্যাম্পাস এখন অনেক দেশেই উদাহরণ হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে বিশ্বের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় যেমন নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটি, জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি বা রচেস্টার ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ক্যাম্পাস রয়েছে। অতিসম্প্রতি পাকিস্তানেও অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি তাদের কার্যক্রম শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে। তবে বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে টানতে হলে আমাদের আইনি কাঠামো ও নীতি আরও সহনশীল করতে হবে।
নতুন করে ভাবার সময়
১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সংক্রান্ত আইনটির লক্ষ্য ছিল নতুন এক ধারার সূচনা। সেই লক্ষ্য পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু এখন এর সীমাবদ্ধতা নতুন সংকট তৈরি করছে। একদিকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান, অন্যদিকে প্রযুক্তিনির্ভর নতুন অর্থনীতির জন্য দক্ষ মানবসম্পদ প্রয়োজন। এমন অবস্থায় পুরোনো ধারা আঁকড়ে থাকা অর্থহীন।
আমাদের দরকার একটি বৈষম্যহীন উচ্চশিক্ষার পরিবেশ। এটি শুরু করতে হবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৯২ (সংশোধিত ২০১০)-এর পরিবর্তে নতুন আইন প্রণয়ন করে। এই আইনে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের ভূমিকা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সরকারি, অলাভজনক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি লাভজনকভাবে (ফর–প্রফিট) চলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুযোগ থাকতে হবে।
নীতিগত সহায়তা থাকলে ব্যাংকঋণ বা সরকারি প্রণোদনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ফি-নির্ভরতা কমানো সম্ভব। নন-প্রফিট হলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আয়করের আওতায় রাখা হয়েছে, এটি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, সেটিও ভাবার বিষয়।
একই সঙ্গে ইউজিসির ভূমিকা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। ইউজিসি চলে ১৯৭৩ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশে। ৫০ বছর আগের সেই অধ্যাদেশও পর্যালোচনা করা দরকার।
ইউজিসির দায়িত্ব হবে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, সরকারি গবেষণা তহবিল বৈষম্যহীনভাবে বণ্টন, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেট সমন্বয় এবং প্রবাসী বাংলাদেশি বিজ্ঞানী-গবেষকদের ছুটির সময় দেশে শিক্ষকতা-গবেষণার সুযোগ তৈরি করা।
কিন্তু শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ করবে কেবল বিএসি (প্রকৌশলের ক্ষেত্রে বিএইটিই)। এ জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজস্ব দক্ষ অ্যাসেসর দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে।
পথের বাধা সরিয়ে নিন
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার সম্ভাবনা এখন আর শুধু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নয়। বাধা সরিয়ে দিলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কেবল মানসম্পন্ন শিক্ষা দেবে না, বরং অর্থনীতিতেও শক্ত ভিত গড়ে তুলবে। বুয়েটে আমার সমাবর্তন বক্তা ছিলেন বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা। তাঁর সমাবর্তন বক্তৃতার শিরোনাম ধার করে আমি লেখাটি শেষ করছি: পথের বাধা সরিয়ে নিন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে এগোতে দিন।
● মুনির হাসান প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক
* মতামত লেখকের নিজস্ব
