ক্রেমলিনে ‘ড্রোন হামলার’ সময় জেলেনস্কি কেন বিদেশ সফরে?

একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ড্রোনের মতো দেখতে একটি বস্তু ভূমি থেকে ৫০ ফুটের মতো উচ্চতায় বিস্ফোরিত হচ্ছে।
ছবি : রয়টার্স

রাশিয়ার গণমাধ্যম তাস, আরটি ও স্পুতনিক নিউজ জানাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ক্রেমলিনের যে বাসভবনে থাকেন, সেখানটাতে দুটি ড্রোন দিয়ে হামলা চালানো হয়েছে। মে মাসের ৩ তারিখ রাতে পুতিন তাঁর বাসগৃহে ছিলেন না। সে কারণে কেউ যদি প্রকৃতপক্ষেই এই হামলা করে থাকেন, তাহলে যে উদ্দেশ্য (পুতিনকে হত্যা) থেকে এটি পরিচালিত হয়েছিল, সেটি পূরণ হওয়া সম্ভব ছিল না।

সব ঘটনা এখন দাঁড়িয়ে আছে ক্রেমলিন কর্তৃপক্ষের প্রকাশ করা কয়েকটি ভিডিওর ওপর ভিত্তি করে। একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ড্রোনের মতো দেখতে একটি বস্তু ভূমি থেকে ৫০ ফুটের মতো উচ্চতায় বিস্ফোরিত হচ্ছে। খুব অদ্ভুতভাবেও এই ভিডিওতে দুজন ব্যক্তিতে দেখা যাচ্ছে, যাঁরা ক্রেমলিনের ভবনগুলোর মধ্যে একটির ওপরে উঠছিলেন। কেউ কেউ বলছেন, তাঁরা দুজনই সৈনিক। ভিডিওতে দেখতে পাওয়া গম্বুজযুক্ত ভবনটি ক্রেমলিনের সিনেট প্রাসাদ। ড্রোন যখন বিস্ফোরিত হচ্ছিল, তখন সৈনিক দুজন প্রাসাদ বেয়ে উঠছিলেন।

যদি এই ভিডিওটি বিশ্বাসযোগ্য হয়, তাহলে সেই মধ্যরাতে তাঁরা দুজন সেখানে কী করছিলেন, সেটা স্পষ্ট নয়। তাহলে তাঁরা কি ম্যানপ্যাডস (একজন মানুষ বহন করতে পারে, এ রকম বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা) কাঁধে করে সিনেট প্রাসাদের একেবারে চূড়ায় উঠছিলেন, যাতে বিমানবিধ্বংসী রকেট ছুড়ে ড্রোন ধ্বংস করা যায়? কিন্তু ভিডিও থেকে সে রকম কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না যে তাঁরা কিছু বহন করছিলেন।

তাঁরা কি তবে পর্যবেক্ষক? ক্রেমলিনের চারপাশের আকাশ পর্যবেক্ষণ করার জন্য তাঁদের সেখানে পাঠানো হয়েছিল। সেটা সম্ভব, যদি হামলার আগাম সতর্কবার্তা থাকে। যাহোক, ধরে নিই তাঁরা সেখানে দেরিতে পৌঁছেছেন। বিস্ফোরণের পরপরই যখন ভিডিওটি শেষ হয়ে যাচ্ছে, তখন সেই দুজনের কী হলো, সেটা জানা যাচ্ছে না।

রাশিয়ানরা বলেছেন, ক্রেমলিনের ওপর এই হামলার উপযুক্ত জবাব তাদের পছন্দনীয় স্থান ও সময়ে তারা দেবে। কিন্তু এই ঘোষণায় ড্রোন হামলা হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে রাশিয়ার দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যে দলটি ড্রোন হামলা পরিচালনা করেছে, তাদের যদি রাশিয়ানরা চিহ্নিত করতে পারত, তাহলে ঘটনাটির সত্যতা নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন থাকত না। কিন্তু এটাকেও উপসংহার ভাবাটা ঠিক হবে না।

যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থার দিক থেকে রাশিয়া এখন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশগুলোর একটি। সম্ভবত ইসরায়েলের স্তরভিত্তিক বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে মস্কোর বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এটা বিস্ময়কর হবে না, যদি বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নে ইসরায়েলকে হুবহু নকল করে রাশিয়া। কিন্তু নকল করলেও রাশিয়ার প্রতিরক্ষা উপকরণ ইসরায়েল থেকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে ভিন্ন। রাশিয়ার হাতে এমন একটি সমন্বিত বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আছে, যেটি দিয়ে ক্রেমলিনের এত কাছে আসার অনেক আগেই যেকোনো ধরনের ড্রোন হামলা প্রতিহত করা সম্ভব।

ব্লগ পরিসরে এ রকম একটা গল্প চালু হয়েছে যে ক্রেমলিনে সংঘটিত এই হামলা রাশিয়ার ভেতর থেকেই হয়েছে। ইউক্রেনীয় ভাড়াটে সেনাদের একটি দল ক্রেমলিনের সীমান্ত প্রাচীরের খুব কাছ থেকে ড্রোন হামলা করেছে। সে ক্ষেত্রেও মস্কো নগরের চারপাশ ঘিরে যে বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আছে, তা দিয়ে খুব কার্যকরভাবেই এই হামলা প্রতিহত করা সম্ভব। আর ড্রোন হামলার বিষয়ে আগেআগে শনাক্ত করা গেলে সে ধরনের হামলা চালানো একেবারেই অসম্ভব।

রাশিয়া বলছে, তারা শেষ পর্যন্ত ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে ড্রোন দুটি থামিয়েছে। ভিডিও থেকে একটা বিষয় দেখা যাচ্ছে, ড্রোন দুটি শুধু ইলেকট্রনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে থামানো হয়নি, কমপক্ষে একটি ড্রোন বিস্ফোরণের মাধ্যমে ধ্বংসও করা হয়েছে। এর অর্থ হলো, রাশিয়ানদের কাছে এমন সক্ষমতা আছে, যা দিয়ে তারা ড্রোনের বিস্ফোরকও ধ্বংস করে ফেলতে পারে। সেটা কি সম্ভব? উত্তরটা হ্যাঁ সূচক।

রাশিয়ানদের হাতে শুধু জ্যামার নেই, শক্তিশালী জ্যামার আছে। তা দিয়ে তারা ড্রোনের বিস্ফোরকেও আঘাত করতে সক্ষম। রাশিয়ার গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ধ্বংস হওয়ার পর মাটিতে ড্রোনের হাজার হাজার টুকরা পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
অন্যভাবে বলা যায়, নিরপেক্ষ সূত্রে এমন কোনো শক্ত তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি, যাতে করে বলা যাবে ড্রোন হামলার ঘটনাটি ঘটেছে।

আরও পড়ুন

এদিকে ইউক্রেনীয় সরকার, ক্রেমলিনে পুতিনকে লক্ষ্য করে চালানো কোনো ড্রোন হামলায় তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। জেলেনস্কি সে সময় রাষ্ট্রীয় সফরে ফিনল্যান্ড ছিলেন। বুদ্ধিমানের মতো ব্যাপার হতো কিংবা বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত হতো, যদি এ খবর শোনার পর জেলেনস্কি তাঁর সফর স্থগিত করে ইউক্রেনে ফিরে আসতেন। তবে কেউ এই অনুমানও করছেন যে ইউক্রেনে মাটির নিচে যে বাংকারে জেলেনস্কি অবস্থান করেন, তার আশপাশে বোমা পড়ুক, সেটা নিশ্চয়ই তিনি চাইবেন না।

জেলেনস্কির ফিনল্যান্ড সফর স্থগিত না করার কারণ হিসেবে কেউ কেউ বলছেন, পুতিনের বিরুদ্ধে বিশেষ এই সামরিক অভিযানের (ড্রোন হামলা) জন্য তিনি তাঁর বিদেশ সফরের সময়টাকেই বেছে নিয়েছেন। যদি সেটা সফল হতো, তাহলে তিনি বীরের বেশে দেশে ফিরতেন। আর ব্যর্থ হলে তো তাঁর হাতে আরও অনেক করণীয় আছেই।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ভাষ্য হলো, যদি ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটত, তাহলে ওয়াশিংটন কিয়েভের কাছ থেকে কি আগাম সতর্কবার্তা পেত না। বিরুদ্ধপক্ষের হাতে যখন শক্তিশালী তথ্যপ্রমাণ থাকে না, সে ক্ষেত্রে এটি দায়িত্ব এড়ানোর সুবিধাজনক পথ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ক্রেমলিনে ড্রোন হামলার রাশিয়ার এই দাবিকে ‘বড় লবণদানির এক চিমটি লবণ’ হিসেবে দেখা প্রয়োজন।

রাশিয়ানরা বলেছেন, ক্রেমলিনের ওপর এই হামলার উপযুক্ত জবাব তাদের পছন্দনীয় স্থান ও সময়ে তারা দেবে। কিন্তু এই ঘোষণায় ড্রোন হামলা হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে রাশিয়ার দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যে দলটি ড্রোন হামলা পরিচালনা করেছে, তাদের যদি রাশিয়ানরা চিহ্নিত করতে পারত, তাহলে ঘটনাটির সত্যতা নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন থাকত না। কিন্তু এটাকেও উপসংহার ভাবাটা ঠিক হবে না।

  • স্টিফেন ব্রায়েন সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি এবং ইয়র্কটাউন ইনস্টিটিউটের একজন সিনিয়র ফেলো
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত