চীনের ‘ইলেকট্রো-রাষ্ট্রের’ ভবিষ্যৎ কী

চীনের অর্থনীতি রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেএএফপি

চীনে এখন আরেকটি বড় রূপান্তর চলছে। বিশ্বের কারখানা হিসেবে পরিচিত চীন দ্রুত একটি ‘ইলেকট্রো-রাষ্ট্রে’ পরিণত হচ্ছে। এর অর্থনীতি দিন দিন কার্বনমুক্ত জ্বালানি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তি এবং গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালের নিয়ন্ত্রণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। এই নতুন মডেলে অনেক সম্ভাবনা আছে। তবে বড় কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে।

কার্বনমুক্ত প্রযুক্তির উৎপাদনে চীন এখন বিশ্বের একক নেতা। সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি ও ব্যাটারির যন্ত্রপাতি উৎপাদনের প্রায় ৬০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে চীন। শুধু সৌর প্যানেলের ক্ষেত্রেই বৈশ্বিক উৎপাদনের ৮০ শতাংশের বেশি চীনেই হয়। এ বিশাল উৎপাদনের কারণে খরচ অনেক কমে গেছে। যেমন গত ১০ বছরে সৌর প্যানেলের দাম প্রায় ৮০ শতাংশ কমেছে।

চীন বিরল মৃত্তিকা খনিজ বা ‘রেয়ার আর্থ’-এর দখলও অনেকটা নিজের হাতে নিয়েছে। এসব খনিজ বৈদ্যুতিক গাড়ি, বায়ু টারবাইন ও এআই সেন্সর তৈরিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বিশ্বের রেয়ার আর্থ মজুতের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ এবং উৎপাদন ও পরিশোধনের প্রায় ৭০ শতাংশ চীনের নিয়ন্ত্রণে।

এদিকে গবেষণা ও উদ্ভাবনে, বিশেষ করে এআই খাতে চীনের বিনিয়োগও বড় ফল দিচ্ছে। এখন বিশ্বের মোট এআই গবেষকদের অর্ধেকের বেশি চীনে কাজ করেন। বিশ্বজুড়ে নিবন্ধিত এআই পেটেন্টের প্রায় ৭০ শতাংশ চীনের। বিশ্ব মেধাস্বত্ব সংস্থার উদ্ভাবন সূচকেও চীন এখন শীর্ষ দশে। এই সবকিছু মিলিয়ে ওপর নির্ভরশীল।

কাঁচামাল, উচ্চ প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদন, নতুন শিল্প ও জ্বালানিব্যবস্থার নকশা এবং অর্থায়ন—সবকিছুতেই চীনের বড় ভূমিকা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি রেয়ার আর্থ চায় বা কোনো উন্নয়নশীল দেশের যদি পরিষ্কার জ্বালানি অবকাঠামো দরকার হয়, তাকেও চীনের দিকে তাকাতে হচ্ছে। কিন্তু এখানেই একটি বড় ঝুঁকি আছে। চীন যতই শক্তিশালী রপ্তানিকারক হোক, তবু তার অর্থনীতি এখনো বাইরের চাহিদার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। অথচ চীন সেই নির্ভরতা কমাতে চাইছে। বিশ্বে যখন সুরক্ষাবাদ বাড়ছে এবং জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে সরবরাহব্যবস্থা চীন থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে, তখন এ নির্ভরতা চীনের জন্য দুর্বলতা হয়ে উঠতে পারে।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জনসংখ্যাগত সংকট। চীনের শ্রমক্ষম মানুষের সংখ্যা কমছে। বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। জন্মহার কমে গেছে প্রয়োজনীয় মাত্রার অনেক নিচে। ফলে শ্রমিকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় আয় ও ভোগ কম বাড়তে পারে। এতে ভোগনির্ভর অর্থনীতিতে যাওয়ার যে পরিকল্পনা, তা বাধাগ্রস্ত হবে। আবাসন খাতও বড় সমস্যা তৈরি করছে।

আরও পড়ুন

এ অবস্থায় চীন এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা একটি উদ্ভাবনী, কম কার্বননির্ভর শিল্প অর্থনীতির কাঠামো তৈরি করেছে। এ অর্থনীতি বিশ্বকে নেট জিরো এবং এআই বিপ্লবের দিকে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এই ‘ইলেকট্রো-রাষ্ট্র’ টেকসই করতে হলে চীনকে তিনটি বিষয়ে অগ্রগতি আনতে হবে।

প্রথমত, উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। শুধু আরও রোবট বা কারখানা দিয়ে নয়; বরং উদ্ভাবন, দক্ষতা বৃদ্ধি, ভালো ব্যবস্থাপনা এবং সেবা খাত উন্নয়নের মাধ্যমে। গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। জিডিপির তুলনায় গবেষণায় ১০ শতাংশ বেশি ব্যয় করলে উৎপাদনশীলতা ৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।

দ্বিতীয়ত, দেশীয় চাহিদা বাড়াতে হবে। মানুষের আয় ও সম্পদ বাড়াতে হবে। ভোক্তার আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। বিশেষ করে সেবা খাত, যেমন প্রবীণদের যত্ন ও স্বাস্থ্যসেবার মতো খাতে জোর দিতে হবে। পাশাপাশি শিল্প ও আবাসন খাত থেকে শ্রমিক সরিয়ে ভোক্তানির্ভর খাতে আনতে হবে।

তৃতীয়ত, বাইরের নির্ভরতা সামলাতে হবে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। আত্মনির্ভরশীলতা জরুরি। তবে পাশাপাশি কৌশলগত অংশীদার, স্থিতিশীল বাণিজ্য সম্পর্ক ও স্বচ্ছ সহযোগিতার কাঠামোও দরকার।

  • লুদোভিক সুবরাঁ জার্মানিভিত্তিক বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান আলিয়াঞ্জের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা (সিআইও) ও প্রধান অর্থনীতিবিদ

  • স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত