রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণ করবে যে ঘটনা

ক্রিমিয়ায় রুশ যুদ্ধবিমানের মহড়াছবি : এএফপি

ইউক্রেনের জন্য সেপ্টেম্বর মাসটা ছিল পাল্টা আঘাতের চেয়েও বেশি কিছু। সম্প্রতি রাশিয়ার কাছ থেকে খেরসনের বিপুল পরিমাণ ভূমি পুনর্দখলে নিয়েছে ইউক্রেন বাহিনী। এ ঘটনা জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। রাশিয়ার বাহিনী এখন অনিবার্যভাবেই রক্ষণাত্মক অবস্থানে চলে গেছে। ইউক্রেনের ভূমি দখল ও পুনর্দখল এখন আর তারা করতে চাইছে না। ইউক্রেনের যেটুকু জায়গা দখল করেছে, তা ধরে রাখতে চায় মস্কো। এর জন্য মস্কো এখন খুব নিবিড় প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলছে। নতুন সৈন্য নিয়োগ করে তাদের তুমুল যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ দিতে মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

ইউক্রেনের জন্য সবচেয়ে অগ্রাধিকারমূলক কাজ এখন কোনটি? রুশ বাহিনী এখন যে টালমাটাল অবস্থায় পড়েছে, সেটা যেন দীর্ঘস্থায়ী হয়, সেই ব্যবস্থা করা। নতুন সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে রুশ বাহিনী নিজেদের হারানো শক্তি যাতে পুনরুদ্ধারের সুযোগ না পায়, সেই কাজটা করে যাওয়া। আগামী কয়েক মাস রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই পক্ষের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকবে ক্রিমিয়া। ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের যতটা ভূমি রাশিয়া দখল করে নিয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ক্রিমিয়া। গত সেপ্টেম্বর মাসে ইউক্রেনের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ভ্যালেরি জালুঝনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ক্রিমিয়া হচ্ছে রাশিয়ার ‘ভারকেন্দ্র’, তাদের মূল চাবিকাঠি।

আলেক্সি নাভালনির মতো বিরোধী নেতার মধ্যেও এ ধারণা বদ্ধমূলভাবে রয়েছে। এ কারণেই খেরসন হাতছাড়া হলে রাশিয়ানরা নির্বিকার থাকলেও ক্রিমিয়া উপদ্বীপের প্রশ্নে সবাই এককাট্টা হয়ে যাবেন। এ ধরনের কোনো হুমকি তৈরি হলে রাশিয়ার পক্ষ থেকে নিম্ন মাত্রার বা ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনাও থাকবে। যুদ্ধ বিশ্লেষক ও সাবেক সামরিক কর্তা মাইক মার্টিন বলেছেন, ক্রিমিয়া পুনরুদ্ধারে পূর্ণ মাত্রায় সামরিক অভিযান চালানো হলে তা রাশিয়ার সামরিক শক্তির পুনর্জাগরণ ঘটাবে।

ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও এটা সত্য। কিয়েভের পক্ষ থেকে সম্প্রতি উপদ্বীপ ঘিরে যেসব সামরিক তৎপরতা চালানো হয়েছে, তা থেকে স্পষ্ট যে ইউক্রেন ক্রিমিয়াকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে। কার্চ সেতুতে বিস্ফোরণ, কৃষ্ণসাগরে রুশ জলযানে ড্রোন হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে। এখন প্রশ্ন হলো, এখন কীভাবে ক্রিমিয়া পুনর্দখলে নেবে ইউক্রেন? এই প্রশ্নের উত্তরটিই আগামী দিনে যুদ্ধের গতিপথ নির্ধারণ করে দেবে। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ইউক্রেনের কাছে ক্রিমিয়াকে স্থানান্তর করেছিলেন। যদিও এই ঘটনাকে বিবেচনায় নিয়ে কেউ বলতে পারে, ইউক্রেন তো তাহলে পুরোপুরি মস্কোর অধীন এবং এর কার্যকর স্বাধীনতা অসম্ভব একটা বিষয়।

১৭৮৩ সালে অটোমানদের পরাজিত করে ক্রিমিয়ার দখল নেয় রাশিয়া। ক্রিমিয়া নানা কারণে রাশিয়ার মহা কৌশলের অংশ। দক্ষিণ উপকূলের সেভাস্তোপল রাশিয়ার একমাত্র উল্লেখযোগ্য উষ্ণ পানির নৌঘাঁটি। এই সমুদ্রপথ দিয়েই ভূমধ্যসাগরে সারা বছর প্রবেশের সুযোগ পায় রাশিয়া।  সেভাস্তোপল নৌঘাঁটি রাশিয়ার স্বার্থের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯১ সালে ইউক্রেন স্বাধীন হওয়ার পর মস্কো ইউক্রেনের কাছ থেকে লিজ নেয়। কিন্তু ২০১৪ সালে মস্কোর সঙ্গে ক্রিমিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করার পর ভ্লাদিমির পুতিন সেই চুক্তি বাতিল করেন। ক্রিমিয়া উপদ্বীপে আরও কিছু উল্লেখযোগ্য সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, রাশিয়া এ পর্যন্ত যত অঞ্চল নিজেদের দখলে নিয়েছে, তার মধ্যে ক্রিমিয়াতেই রুশ জাতিগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ। কয়েক শতাব্দী ধরে ক্রিমিয়া রুশদের গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের কেন্দ্র। এখন সেখানে সম্পত্তির দাম পড়ে গেছে, ইউক্রেনের সেনারা আসবে কি না, সেই ভয়ও রয়েছে।

অন্যদিকে ইউক্রেন তাদের দখল হয়ে যাওয়া সব ভূমি পুনরুদ্ধারে সংকল্পবদ্ধ। কিয়েভ বলেছে, দখলে নেওয়া সব ভূমি ছেড়ে দিলেই রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু হতে পারে। এই উভয়সংকট পরিস্থিতিতে ক্রিমিয়া দুই পক্ষের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সামরিক চ্যালেঞ্জ। গত কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ক্রিমিয়াতে আগ্রাসন চালিয়ে এ পর্যন্ত কেউই সুবিধা করতে পারেনি। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা ক্রিমিয়া দখল করলেও শেষ পর্যন্ত তাদের সেখান থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে। সামরিক দিক থেকে ক্রিমিয়াকে কাবু করা অত্যন্ত দুরূহ একটা কাজ।

বড় আকারের নৌ ও উভচর বাহিনী ছাড়া ইউক্রেন এখন যদি ক্রিমিয়াতে প্রবেশ করতে চায়, তাহলে তাদের জন্য একমাত্র প্রবেশপথ হলো ৫ কিলোমিটার প্রশস্ত পেরেকপ স্থাথামুস। এই পথ দিয়ে প্রবেশ করতে হলে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মুখে পড়তে হবে। ১৯২০ সালে রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ এবং ১৯৪১ সালে জার্মান আগ্রাসনের সময় একই ঘটনা ঘটেছিল।

দ্বিতীয়ত, ক্রিমিয়ায় হামলা হলে তাতে রাজনৈতিক বিপদও উপস্থিত হবে। রাশিয়ার দখল করা অন্য এলাকা থেকে ক্রিমিয়া একেবারে স্বতন্ত্র। রাশিয়ার বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন রুশ জাতিগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় ক্রিমিয়া বৈধভাবেই রাশিয়ার ভূখণ্ড।  
রাশিয়া থেকে নির্বাসিত ভিন্নমতাবলম্বী আমার একজন বন্ধু পুতিন সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করায় বেশ কয়েকবার কারাগারে গিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বলেছেন, খেরসন, জাপোরিঝঝিয়া কিংবা দনবাসের কী হলো না হলো, তাতে খুব কমসংখ্যক রাশিয়ানের কিছু যায় আসে। রাশিয়ানরা মনে করেন, সেখানকার জনগোষ্ঠী হলো ইউক্রেনীয়। কিন্তু সবাই বিশ্বাস করেন যে ক্রিমিয়ার মানুষেরা হলেন রাশিয়ান।

আরও পড়ুন

আলেক্সি নাভালনির মতো বিরোধী নেতার মধ্যেও এ ধারণা বদ্ধমূলভাবে রয়েছে। এ কারণেই খেরসন হাতছাড়া হলে রাশিয়ানরা নির্বিকার থাকলেও ক্রিমিয়া উপদ্বীপের প্রশ্নে সবাই এককাট্টা হয়ে যাবেন। এ ধরনের কোনো হুমকি তৈরি হলে রাশিয়ার পক্ষ থেকে নিম্ন মাত্রার বা ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনাও থাকবে।

যুদ্ধ বিশ্লেষক ও সাবেক সামরিক কর্তা মাইক মার্টিন বলেছেন, ক্রিমিয়া পুনরুদ্ধারে পূর্ণ মাত্রায় সামরিক অভিযান চালানো হলে তা রাশিয়ার সামরিক শক্তির পুনর্জাগরণ ঘটাবে। কিন্তু রাশিয়ার সামরিক শক্তিকে পরাজিত করে ক্রিমিয়া দখল করা গেলে নিজ দেশে ব্যাপক চাপের মুখে পড়তেন পুতিন। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের ক্ষেত্রে ইউক্রেন বারবার করে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। এবারও কি সেই সুযোগ তাদের সামনে?

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন সম্প্রতি বলেছেন, ক্রিমিয়া নিয়ে ইউক্রেনের নেতারা কী ভাবছেন, সে অনুযায়ীই ইস্যুটির সমাধান হতে হবে। ক্রিমিয়া ইস্যুকে ইউক্রেনের নেতারা কীভাবে দেখছেন, তার ওপর যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নির্ভর করছে। যে পথই তারা বেছে নিক না কেন, এই যুদ্ধ শিগগিরই শেষ হওয়ার লক্ষণ নেই।

  • ফ্রাঙ্ক লুডভিগ, পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক কৌশল ও আইনের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে