দশকের পর দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে একটি পরিবার প্রভাব টিকিয়ে রেখেছে। সেই পরিবার হলো নেহরু-গান্ধী বংশের পরিবার। পরিবারটির সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও স্বাধীন ভারতের ইতিহাস গভীরভাবে জড়িয়ে আছে।
এই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, নেহরু–কন্যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ইন্দিরাপুত্র সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। আর বর্তমানে রাজনীতির অগ্রভাগে আছেন রাজীব গান্ধীর পুত্র কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এবং কন্যা লোকসভার সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র।
রাজনৈতিক নেতৃত্বও বংশানুক্রমে পাওয়া যায়—এমন ধারণাকে পরিবারটি প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। ধারণাটি এখন ভারতের রাজনীতির প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি দল ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।
যদিও নেহরু-গান্ধী পরিবার ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস দলের সঙ্গে যুক্ত, তবু বংশানুক্রমিক নেতৃত্ব এখন ভারতের সব রাজনৈতিক দলের মধ্যেই দেখা যায়।
উদাহরণস্বরূপ, জনতা দলের গঠনে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখা বিজয়নন্দ (বিজু) পট্টনায়কের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে নবীন পট্টনায়ক লোকসভায় তাঁর আসনে নির্বাচিত হন। পরে নবীন তাঁর বাবার স্মরণে বিজু জনতা দল (বিজেডি) প্রতিষ্ঠা করেন এবং ওডিশা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন। ওই পদে তিনি দুই দশকের বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করছেন।
মহারাষ্ট্রভিত্তিক শিব সেনা দলের প্রতিষ্ঠাতা বাল ঠাকরে মারা যাওয়ার আগে দলের নেতৃত্ব তাঁর ছেলে উদ্ধব ঠাকরেকে দিয়ে যান। উদ্ধবের ছেলে আদিত্য ঠাকরে এখন খোলাখুলিভাবেই উত্তরাধিকারের অপেক্ষায় আছেন। একইভাবে সমাজবাদী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও উত্তর প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদবের পর তাঁর ছেলে অখিলেশ যাদব সেই পদে আসীন হন। বর্তমানে অখিলেশ লোকসভার সদস্য এবং দলের সভাপতি। লোক জনশক্তি পার্টির নেতা রাম বিলাস পাসোয়ানের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে চিরাগ পাসোয়ান দলটির নেতৃত্বে এসেছেন।
ভারতের মূল ভূখণ্ড ছাড়াও জম্মু ও কাশ্মীরে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে আবদুল্লাহ পরিবার। এই পরিবার তিন প্রজন্ম ধরে রাজ্যের নেতৃত্বে রয়েছে। সেই রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলও মুফতি পরিবারের মাধ্যমে দুই প্রজন্ম ধরে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
পাঞ্জাবে দীর্ঘদিন ধরে শিরোমনি আকালি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রকাশ সিং বাদল। পরে দলের দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁর ছেলে সুখবীর বাদল।
তেলেঙ্গানায় ভারত রাষ্ট্র সমিতি (বিআরএস) দলের প্রতিষ্ঠাতা কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের ছেলে ও মেয়ের মধ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। আর তামিলনাড়ুতে প্রয়াত এম করুণানিধির পরিবারই এখনো শাসক দল দ্রাবিড় মুন্নেত্র কাঝাগম (ডিএমকে) নিয়ন্ত্রণ করছে। তাঁর ছেলে এম কে স্টালিন বর্তমানে সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর নাতি ইতিমধ্যে পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষিত হয়েছেন।
এ ঘটনাটা শুধু কিছু পরিচিত বা প্রভাবশালী পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি ভারতের শাসনব্যবস্থার গভীরে গেঁথে আছে। গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে লোকসভার সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত এটি ছড়িয়ে আছে।
সাম্প্রতিক এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৪৯টি পরিবার একাধিক সদস্যসহ রাজ্য আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব করছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় ১১ জন মন্ত্রী এবং ৯ জন মুখ্যমন্ত্রীও আছেন, যাঁদের পারিবারিক রাজনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে।
২০০৯ সালের নির্বাচনের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ৪৫ বছরের নিচের দুই-তৃতীয়াংশ এমপিরই ঘনিষ্ঠ স্বজন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তরুণ এমপিদের প্রায় সবাই সংসদীয় আসন উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পিতা–মাতা থেকে উত্তরাধিকার পেয়েছেন।
সব রাজনৈতিক দল মিলিয়ে দেখা যায়, নারী এমপিদের ৭০ শতাংশই রাজনৈতিক বংশ বা পরিবারের সদস্য। এমনকি যেসব নারী রাজনীতিবিদের সরাসরি উত্তরাধিকারী নেই (যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা কুমারী মায়াবতী), তাঁরাও তাঁদের উত্তরসূরি হিসেবে ভাইপোদের বেছে নিয়েছেন।
তবে ন্যায্যভাবে বললে এই পারিবারিক বা বংশগত রাজনীতি পুরো ভারতীয় উপমহাদেশেই দেখা যায়। পাকিস্তানে ভুট্টো ও শরিফ পরিবার, বাংলাদেশে শেখ ও জিয়া পরিবার আর শ্রীলঙ্কায় বন্দরনায়েকে ও রাজাপক্ষ পরিবার।
কিন্তু ভারতের প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের সঙ্গে এই বংশানুক্রমিক রাজনীতি একেবারেই বেমানান মনে হয়। তাহলে প্রশ্ন আসে, ভারত কেন এত আগ্রহ নিয়ে এই ‘রাজনৈতিক বংশতন্ত্র’ মডেল গ্রহণ করেছে?
এর একটি কারণ হতে পারে—এখানে পরিবার নিজেই একধরনের ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে কাজ করে। পরিচিত নামধারী প্রার্থীদের ভোটারদের আস্থা অর্জন বা মনোযোগ টানতে খুব বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। যদি ভোটাররা কোনো প্রার্থীর বাবা, খালা বা ভাইকে গ্রহণ করে থাকেন, তাহলে সেই প্রার্থীকেও সহজেই মেনে নেন। এখানে বিশ্বাসযোগ্যতা গড়ার বাড়তি প্রয়াসের দরকার পড়ে না।
এই প্রভাব, বিশেষ করে অতীতের ভারতে (যখন দেশে সাক্ষরতার হার ছিল কম এবং গণমাধ্যমের পরিসর ছিল সীমিত) বেশি কাজ করত।
কিন্তু এখন যখন সাক্ষরতার হার প্রায় ৮১ শতাংশ এবং মোবাইল ইন্টারনেটের প্রবেশাধিকার ৯৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে, তখন নিশ্চয়ই অন্য কিছু কারণও কাজ করছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর একটি হলো রাজনৈতিক দলের ভেতরের কাঠামো। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ভারতের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এখানে নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রক্রিয়া প্রায়ই অস্পষ্ট থাকে; এখানে সিদ্ধান্ত নেয় এমন একদল ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বা কোনো একক নেতা, যাঁরা পরিবর্তন আনতে খুব একটা আগ্রহী নন।
এর ফলে দেখা যায়, যোগ্যতার চেয়ে আত্মীয়তাই বেশি মূল্য পায়। অর্থাৎ, স্বজনতোষণই মেধার চেয়ে এগিয়ে থাকে।
রাজনীতিতে আসতে বিপুল অর্থ ও সম্পদের দরকার যখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে, তখন অবস্থাটা আরও কঠিন হয়।
রাজনৈতিক বংশ বা রাজবংশীয় পরিবারগুলোর হাতে সাধারণত প্রচুর আর্থিক সম্পদ থাকে। এই সম্পদ তারা বছরের পর বছর ক্ষমতায় থেকে গড়ে তুলেছে। তা ছাড়া তাদের হাতে অনুদানদাতা নেটওয়ার্ক, দলীয় কর্মী, এমনকি স্থানীয় দুষ্কৃতকারীসহ নির্বাচনী কাঠামো তাঁদের হাতে প্রস্তুত অবস্থায় থাকে। এই সুবিধাগুলো তাদের নতুন প্রার্থীদের তুলনায় বিরাট এক বাড়তি শক্তি দেয়।
ভারতে রাজনৈতিক বংশতন্ত্রের পেছনে সাংস্কৃতিক দিকও থাকতে পারে। ভারতে আধুনিকায়নে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে বটে, তবে ভারতীয় সমাজে এখনো একধরনের সামন্ততান্ত্রিক আনুগত্যবোধ টিকে আছে।
একসময় স্থানীয় জমিদার বা রাজপরিবারের প্রতি যে ভয়ভক্তি দেখানো হতো, এখন তা রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিই দেখানো হয়। এতে এমন ধারণা জোরদার হয় যে রাজনৈতিক অভিজাতরা সাধারণ মানুষের চেয়ে একেবারে ভিন্ন শ্রেণির মানুষ। অনেকে ভাবেন, রাজনৈতিক অভিজাত পরিবারগুলোর জন্ম হয়েছে ক্ষমতায় বসার জন্য। এই আত্মবিশ্বাস বা ‘অধিকারবোধ’ এত প্রবল যে তা তাঁদের অপরাধমূলক কাজের রেকর্ডকেও আড়াল করে দেয়। ফলে বারবার নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পরও এই রাজনৈতিক পরিবারের সদস্যরা দলগুলোর নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারেন।
কিন্তু বংশানুক্রমিক রাজনীতি ভারতের গণতন্ত্রের জন্য ভয়াবহ হুমকি। যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা যোগ্যতা, প্রতিশ্রুতি বা জনসম্পৃক্ততার বদলে বংশের ওপর নির্ভর করে, তখন শাসনব্যবস্থার মান কমে যায়। সীমিত সংখ্যক পরিবারের মধ্য থেকেই যখন নেতৃত্ব বাছাই হয়, তখন মেধার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
তবে এখন ভারতকে বংশতন্ত্রের বদলে যোগ্যতাভিত্তিক গণতন্ত্রে (মেরিটোক্রেসি) রূপান্তর করার সময় এসেছে। এর জন্য আইনি সীমা নির্ধারণ করে মেয়াদকাল নির্ধারণ করা, রাজনৈতিক দলের ভেতরে প্রকৃত অর্থে অভ্যন্তরীণ নির্বাচন চালু করা এবং ভোটারদের শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলার মতো কিছু এর জন্য মৌলিক সংস্কার দরকার।
যত দিন ভারতীয় রাজনীতি পরিবারনির্ভর থাকবে, তত দিন পর্যন্ত ‘জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য জনগণের সরকার’খ্যাত গণতন্ত্রের প্রকৃত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে না।
শশী থারুর ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও বর্তমানে দেশটির কংগ্রেস দলের এমপি
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ