গাজা নিয়ে চীনের সঙ্গে আমেরিকার সংঘাত কি বেধে যাবে?

বাইডেন ও সি বৈঠককে কেবল দুজনের ফটোসেশন আর গুরুত্বহীন কিছু চুক্তি সম্পাদন বলে কেউ উড়িয়ে দিতেই পারেছবি : রয়টার্স

গত এক মাসে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক ঘটনা কোনটি?

এক. হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধে। এই যুদ্ধে এ পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন, গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যে বড় পরিসরে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

দুই. ১৫ নভেম্বর সান ফ্রান্সিসকোয় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বৈঠক। সেখানে দুই নেতা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার শীতল সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং সামরিক পর্যায়ে আবার যোগাযোগ শুরুর ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন।

উত্তর হলো দুটি ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখানে প্রশ্ন উত্থাপনের কারণ হলো, দুই ঘটনার মধ্যে একটা যোগসূত্র রয়েছে। বাইডেন ও সি বৈঠকে কেবল দুজনের ফটোসেশন আর গুরুত্বহীন কিছু চুক্তি সম্পাদন বলে কেউ উড়িয়ে দিতেই পারে। কিন্তু তাতে মূল জায়গাটিই এড়িয়ে যাওয়া হবে। দুই পরাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এই ঘটনা কি ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রকৃতপক্ষে সেটাই বাইডেন-সি সম্মেলনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়।  

মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ ভয়াবহ ও হৃদয়বিদারক। প্রথম ভয়ের বিষয় হচ্ছে, যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে প্রতিবেশী দেশগুলো সেই যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিপদ রয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, পরাশক্তির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র রূপ ধারণ করায় এই যুদ্ধে দুই পক্ষ দুই দিকে হাওয়া দিতে পারে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দুর্বল করতে চীন অথবা দেশটির কৌশল-নীতিগত মিত্র রাশিয়া যুদ্ধের আগুনে ঘি ঢালতে পারে।

ভাসাভাসাভাবে দেখলে এই ধারণাটি বিশ্বাসযোগ্য। ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় শত্রুদেশ হিসেবে পরিচিত ইরান সম্প্রতি রাশিয়ার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর জন্য রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে ইরান। উত্তর কোরিয়াও সেটা করেছে।

চীনও সম্প্রতি ইরানের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এ বছরই সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তাতে মধ্যস্থতা করেছে চীন। মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ নিয়ে ইউরোপ এতটাই হতবিহ্বল যে রাশিয়া মনে করছে এই দেশগুলো এখন ইউক্রেনকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা কমিয়ে দেবে।

রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর থেকে বেইজিং মস্কোকে মৌখিক সমর্থন দিয়েছে এবং মস্কোর সঙ্গে তাদের ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠেছে। কিন্তু বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে অস্ত্র ও যুদ্ধের কাজে সহায়তা হয়, এমন কোনো উপকরণ সরবরাহ করেনি। চীন দূরবর্তী অবস্থানে থেকে এটিকে রাশিয়া, ইউক্রেন ও পশ্চিমের যুদ্ধ বলে ছেড়ে দিয়েছে।

চীন, রাশিয়া ও ইরান মিলে গাজা যুদ্ধ থেকে যদি একটা ফায়দা তুলতে চায়, সেটা অযৌক্তিক বলে মনে হবে না। ২০০৫ সাল থেকে ইরান ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে অস্ত্র ও অর্থসহায়তা দিয়ে আসছে।

তবে ভালো খবর হচ্ছে, এবার ইসরায়েল-হামাস সংঘাত থেকে এখন পর্যন্ত ইরান নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। সরাসরি কোনো কর্মকাণ্ডে না গিয়ে তেহরান দূর থেকেই নিন্দা জানিয়ে যাচ্ছে। ওই অঞ্চলে ইরানের প্রধানের প্রক্সি সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহও এবার ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে জড়িত হওয়া থেকে বিরত রয়েছে।

এটা যেকোনো সময় পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু বাইডেন-সিয়ের মধ্যে বৈঠক হওয়ায় আশাবাদী হওয়ার একটা কারণ রয়েছে। ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার পরও চীন মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে উসকানিদাতা না হয়ে শান্তিস্থাপক হতে চাইছে।

এর আংশিক কারণ হলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরায়েলের সঙ্গে চীনও ভালো সম্পর্ক বজায় রাখছে। আবার রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানো শুরু করলে পশ্চিমাদের চাপ থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েল সরাসরি রাশিয়াকে সমালোচনা করেনি।

কিন্তু শান্তিস্থাপক হিসেবে চীন কতটা ভূমিকা পালন করতে পারবে, সেটা চীনের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও বিশ্বে তার অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। চীন তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যে আচরণ করুক না কেন, বৈশ্বিক পরিসরে কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে তাদের সে রকম আত্মবিশ্বাসী হতে দেখা যায় না।

চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি নিম্নমুখী। কিছু ক্ষেত্রে তাদের রীতিমতো ধুঁকতে হচ্ছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের দেশগুলোতে পুঁজির বন্যা বইয়ে দেওয়ার এবং সভরেন ঋণ দেওয়ার সামর্থ্য বেইজিংয়ের কমে গেছে। বিশ্বের অসংখ্য দেশ ঋণ ও অন্যান্য সহযোগিতার জন্য চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করতে আগ্রহী হলেও তাদের প্রকৃত বন্ধু ও মিত্রের সংখ্যা খুব কম।

রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর থেকে বেইজিং মস্কোকে মৌখিক সমর্থন দিয়েছে এবং মস্কোর সঙ্গে তাদের ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠেছে। কিন্তু বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে অস্ত্র ও যুদ্ধের কাজে সহায়তা হয়, এমন কোনো উপকরণ সরবরাহ করেনি। চীন দূরবর্তী অবস্থানে থেকে এটিকে রাশিয়া, ইউক্রেন ও পশ্চিমের যুদ্ধ বলে ছেড়ে দিয়েছে।

সে কারণেই সান ফ্রান্সিসকোয় জো বাইডেন সি চিন পিংয়ের সঙ্গে করমর্দন করতে উৎসাহী হয়েছেন। এর আগের মাসগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমায় চীনের গোয়েন্দা বেলুন প্রবেশ এবং আমেরিকান জঙ্গি বিমান থেকে সেটা ভূপাতিত করার ঘটনায় সেটা তীব্র আকার ধারণ করে।

এ প্রেক্ষাপটে বাইডেন ও সি চিন পিংয়ের মধ্যে বৈঠকের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ দিকটা হচ্ছে, দুই পরাশক্তির মধ্যে উত্তেজনাকর সম্পর্কটা এখন কিছুটা সুস্থিরতার দিকে এগোচ্ছে। দ্বিতীয় দিকটিটি হচ্ছে, দুই নেতার মধ্যে এ বৈঠক এই ইঙ্গিত দেয় যে হামাস ও ইসরায়েলের সংঘাত দুই পরাশক্তির মধ্যে সংঘাতে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা নেই।

কিন্তু এই সংঘাত তাহলে কোন দিকে গড়াবে? এ ক্ষেত্রে দুটি বাস্তবতাকে মাথায় রাখতে হবে।

প্রথমত, ইসরায়েলের সঙ্গে যদি কারও সংঘাত বেধে যায়, সেখানে অনিবার্যভাবে হাজির হয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের সমর্থক দেশগুলো চেষ্টা করে যাবে ইসরায়েল যেন সংযত আচরণ করে। তারা এটাও চেষ্টা করে যাবে যাতে ইসরায়েল ও আরব প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতা করা যায়।

দ্বিতীয়ত, আরব দেশগুলোও এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে অপরিহার্য বলে মনে করছে। সেটা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক আছে সে কারণে নয়, উপসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কারণেও। এ অঞ্চলের তেলের বড় ক্রেতা, উপকারী বিনিয়োগকারী চীন। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠাকারী। কিন্তু সংকটের সময়ে চীন বিকল্প হতে পারেনি।

  •  বিল ইমোত দ্য ইকোনমিস্টের সাবেক এডিটর ইন চিফ
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত