বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির আয়োজনে, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় এবারের আঞ্চলিক গণিত উৎসবের দুটি অঞ্চলে সম্পৃক্ত থাকার সুযোগ হয়েছিল আমার।
একটি ফরিদপুর, অন্যটি চট্টগ্রাম আঞ্চলিক উৎসব। গণিতের এই অসামান্য আয়োজন যে শুধু নামেই উৎসব নয়, সেটি সেখানে উপস্থিত না হলে টের পেতাম না। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ের ছোট ছোট মুখ কী পরিমাণ ঔৎসুক্য আর আনন্দ নিয়ে ভেন্যুতে এসে হাজির হয়েছে, সেটি দেখার মতো এক বিষয়।
এসেছিলেন অভিভাবকেরা। ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার শীতের ভোরেও তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের সন্তানদের, তাঁদের পরিজনদের। তাঁরা হয়তো স্বপ্ন দেখেন, একদিন তাঁদের সন্তানেরা সত্যিকারের বিদ্যা-শিক্ষা নিয়ে আলোকিত মানুষ হয়ে উঠবে।
হয়তো স্বপ্ন দেখেন, মুখস্থ করে নয়, গণিতের অন্তর্নিহিত গুরুত্ব ও সৌন্দর্য অনুধাবন করেই তাঁদের সন্তানেরা বড় হবে। সে জন্যই হয়তো, মুখস্থ করাটাকে নিরুৎসাহিত করতে গণিত অলিম্পিয়াডে একযোগে চিৎকার করে সবাই যে তিনটি ‘ম’-কে ‘না’ বলে, তার একটি ‘মুখস্থ’। অন্য দুটি হলো মাদক ও মিথ্যা। মাদককে না, মিথ্যাকে না এবং মুখস্থকে না।
তার প্রমাণ ইতিমধ্যে আমরা পেতে শুরু করেছি। শুধু গণিত নয়, এ রকম আরও আয়োজন, আরও উৎসব, নানান জনের উদ্যোগে হতে থাকুক ‘সকল দেশের রানি’ আমাদের এই স্বপ্নের জন্মভূমিতে, আমরা সেই প্রত্যাশাই করি। লেখাপড়ার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাক আমাদের শিক্ষার্থীরা। আমাদের শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নের কাছে হেরে যেতে চাই আমরা, ব্যর্থ হয়ে যেতে চাই বারবার। আমাদের এই ব্যর্থতাতেই আনন্দ।
একটি উৎসবে সংশ্লিষ্ট সবাই নিজেদের মতো করে আনন্দের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। এই যে অলিম্পিয়াড চলছে, এর পেছনে যে প্রশ্ন করা, পরীক্ষা পরিচালনা করা, উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা, খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করা, মঞ্চ প্রস্তুত করা, ফলাফল প্রস্তুত থেকে শুরু করে পুরস্কারের ব্যবস্থা করা, এই বিশাল কর্মযজ্ঞ কীভাবে সম্পন্ন হচ্ছে, সেটি আরেক দেখার মতো বিষয়।
একদল বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ের শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে প্রবল আগ্রহ আর আনন্দ নিয়ে কাজগুলো করে যাচ্ছেন। আরও আছে চৌকস স্বেচ্ছাসেবকের দল। এর মধ্যে আবার কিছুক্ষণ পরপর, স্থানীয় যে ভেন্যুতে আয়োজনটি করা হয়েছে, সেটির প্রধান বা দায়িত্বপ্রাপ্তজনেরা এসে আমাদের খবর নিয়ে যাচ্ছিলেন; জিজ্ঞেস করছিলেন, চা লাগবে নাকি, গরম-গরম শিঙাড়া লাগবে নাকি, ফরিদপুরের বিখ্যাত ‘বাঘাট’ মিষ্টি কিংবা চট্টগ্রামের বিখ্যাত ‘মেজবান’ খাবার লাগবে নাকি।
কিন্তু আমরা যাঁরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা গিয়েছিলাম, আমাদের জন্য মধুর আতঙ্কের অংশ ছিল প্রশ্নোত্তর পর্ব। সেখানে শুধু গণিতসম্পর্কিত প্রশ্ন নয়, কৌতূহল মেটানোর জন্য যেকোনো ধরনের প্রশ্ন হতে পারে। যেমন সামনের চেয়ারের জন্য ঠিকমতো দেখাও যাচ্ছে না, সে রকম এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খুদে শিক্ষার্থী হয়তো প্রশ্ন করল, স্যার মুখ দিয়ে ফুঁ দিলে মোমবাতি নিভে যায়, কিন্তু চুলার আগুন কেন বেড়ে যায়?
আরেকজন বলল, সেদ্ধ করলে আলু নরম হয়, কিন্তু ডিম কেন শক্ত হয়, স্যার? একজন জিজ্ঞেস করল, স্যার পুকুরের মধ্যে লবণ ঢেলে দিলে কি সমুদ্রের মতো হবে? আমি মনে মনে ভাবছিলাম, এরপরের প্রশ্নটাই হবে, সেই লবণঢালা পুকুরের পানিতে কি ইলিশ মাছ চাষ করা যাবে স্যার? ভাগ্যিস, তার আগেই উপস্থাপক অন্যদিকে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
প্রশ্নোত্তর শেষে এল পুরস্কারের পালা। কেউ পুরস্কার পেল, কেউ পেল না। কিন্তু সেটি বড় কথা নয়। উপস্থিত অভিভাবকদের বলেছিলাম, আপনারা লিখে রাখেন, আজ যে খুদে গণিতবিদেরা আমাদের সামনে বসে আছে, যাদের আপনারা এই উৎসবে শামিল হতে সাহায্য করেছেন, আজ থেকে কয়েক বছর বা দশক পর, এরাই বিশ্বের দরবারে আমাদের তুলে ধরবে।
তার প্রমাণ ইতিমধ্যে আমরা পেতে শুরু করেছি। শুধু গণিত নয়, এ রকম আরও আয়োজন, আরও উৎসব, নানান জনের উদ্যোগে হতে থাকুক ‘সকল দেশের রানি’ আমাদের এই স্বপ্নের জন্মভূমিতে, আমরা সেই প্রত্যাশাই করি। লেখাপড়ার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাক আমাদের শিক্ষার্থীরা। আমাদের শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নের কাছে হেরে যেতে চাই আমরা, ব্যর্থ হয়ে যেতে চাই বারবার। আমাদের এই ব্যর্থতাতেই আনন্দ।
ড. বি এম মইনুল হোসেন অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়