ঢাকার রাস্তায় যখন কোনো ট্র্যাফিক সিগন্যাল পড়ে, তখন ফাঁকফোকর দিয়ে মোটরসাইকেলগুলো অন্য যানবাহনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সিগন্যাল ছাড়লে মোটরসাইকেলগুলো সবার আগে চলা শুরু করে।
ধরা যাক, সরকারি নিয়ম মেনে মোটরসাইকেলগুলো সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার বেগে চলা শুরু করল। তাহলে সিগন্যাল ছাড়ার পর প্রথমেই যানবাহনের জট তৈরি হবে, অথবা স্বল্পগতিতে চলা মোটরসাইকেলকে পেছন থেকে অন্য যানবাহন ধাক্কা দেবে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগ ৫ মে ‘মোটরযানের গতিসীমা-সংক্রান্ত নির্দেশিকা, ২০২৪’ জারি করেছে। এতে বিভিন্ন সড়কে যানবাহনের গতিসীমা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের উদ্যোগ অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু সমস্যা হলো, যে নীতিমালা হয়েছে, সেটা বিজ্ঞানভিত্তিক হয়নি।
বাংলাদেশে দুর্ঘটনা নিয়ে গবেষণা করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। সংস্থাটির সাবেক পরিচালক মো. হাদিউজ্জামানের সাক্ষাৎকার প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে তিনিও বলেছেন, নীতিমালাটি বিজ্ঞানসম্মত হয়নি।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনা, আহত ও নিহত মানুষের সংখ্যা উদ্বেগজনক। যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁরা আমাদেরই কারও না কারও স্বজন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে ২০২৩ সালে সারা দেশে ৫ হাজার ৪৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৫ হাজার ২৪ জনের মৃত্যু হয়। তবে দুঃখের বিষয় হলো, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে অবৈজ্ঞানিক নীতিমালা করা ছাড়া অন্য চেষ্টা কম।
যেকোনো আলোচিত সড়ক দুর্ঘটনার পরই দেখা যায়, হয় চালকের যথাযথ লাইসেন্স নেই, অথবা দুর্ঘটনায় পড়া যানবাহনের ফিটনেস নেই। ঝালকাঠিতে গত ১৭ এপ্রিল একটি সিমেন্টবাহী ট্রাক কয়েকটি যানবাহনকে চাপা দেয়। এতে ১৫ জনের মৃত্যু হয়। পরে জানা যায়, ট্রাকের চালকের ভারী যান চালানোর লাইসেন্স ছিল না। গত মাসের শেষ দিকে চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসটি ছিল ৪৩ বছরের পুরোনো এবং ফিটনেস ছিল না। আবার যে শিক্ষার্থীরা মোটরসাইকেলের আরোহী ছিলেন, তাঁদের মাথায় হেলমেট ছিল না।
১৫ মে বিআরটিএর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রশ্ন তোলেন, ৪৩ বছরের পুরোনো বাস সড়কে কীভাবে চলে? বিআরটিএ কি ঘুমিয়ে ছিল?
মাননীয় মন্ত্রী আসলে সঠিক রোগটি ধরতে পেরেছেন। দেশের মূল সমস্যা হলো, সরকারি সংস্থা ঘুমিয়ে থাকে, অর্থাৎ আইনকানুন বাস্তবায়িত হয় না বলেই সমস্যার সমাধান হয় না। দেশে যথেষ্ট আইন আছে, প্রয়োগ নেই। নতুন আইন ও বিধিবিধান হলে তা বাস্তবায়িত হওয়ার নিশ্চয়তা নেই।
সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে এখন সবার আগে ছয়টি কাজ করা দরকার—১. ফিটনেসবিহীন যানবাহন সড়ক থেকে তুলে নেওয়া; ২. যথাযথ লাইসেন্স ছাড়া কোনো চালককে যানবাহন চলাতে না দেওয়া; ৩. সড়কের ত্রুটি দূর করা; ৪. চালকের মাদকাসক্তি পরীক্ষা ও তার বিশ্রাম নিশ্চিত করা; ৫. সারা দেশে মানসম্মত হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল চালাতে না দেওয়া এবং ৬. সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনাগুলো তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তির যথোপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
সড়ক দুর্ঘটনায় দায়ী কে, সেটা চিহ্নিত না করলে সমস্যা সমাধান হবে না।
মোটরসাইকেল, ইজিবাইক ও অটোরিকশা ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন। দুর্ঘটনায় পড়লে এসব যানবাহনের চালক ও আরোহীর ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়। কিন্তু এটা মনে করার কারণ নেই যে দুর্ঘটনার জন্য তারা সব সময় দায়ী। বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, বাস, ট্রাক অথবা অন্যান্য বড় যানবাহন মোটরসাইকেল বা অটোরিকশাকে ধাক্কা দেয়। চালকেরা অনেক ক্ষেত্রে এসব যানবাহনের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন। কিন্তু পরিসংখ্যান যখন সামনে আসে, তখন দোষ হয় মোটরসাইকেলের, অটোরিকশার।
দেশে যত নিবন্ধিত যানবাহন আছে, তার ৪০ শতাংশের মতো মোটরসাইকেল। অনিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যাটি যোগ করলে হারটি আরও বেশি হবে। কিন্তু দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ৩৫ শতাংশের মতো মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী। আনুপাতিক দিক বিবেচনা করলে দেখা যাবে, এটা বেশি নয়। কিন্তু মোটরসাইকেলকেই সব সময় বেশি দোষ দেওয়া হয়। এই দোষাদুষির খেলায় দুর্ঘটনা কমানোর আলোচনাটি আড়ালে চলে যায়।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু অনেকটাই কমিয়ে আনতে পারে মানসম্মত হেলমেট। দুঃখজনকভাবে আমরা বাংলাদেশে এখনো মানসম্মত হেলমেট বিক্রি নিশ্চিত করতে পারিনি। হেলমেট বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) একটি ‘ম্যান্ডেটরি’ পণ্য। এই পণ্য আমদানিতে পরীক্ষা করে বিএসটিআইয়ের মানচিহ্নসহ বিক্রি করতে হবে। নিয়মটি কেউ মানে না। হেলমেটের নামে বাজারে বিক্রি হয় কার্যত প্লাস্টিকের বাটি, যা মানুষের মৃত্যুঝুঁকি আরও বাড়ায়।
সরকার একদিকে মোটরসাইকেলের গতিসীমা বেঁধে দিচ্ছে, আরেক দিকে ৩৭৫ সিসির (ইঞ্জিনের ক্ষমতা) মোটরসাইকেল বাজারে ছাড়ার অনুমতি দিচ্ছে। এই দ্বিচারিতা কেন? সরকারের একেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ একেকভাবে কাজ করবে, তাদের মধ্যে সমন্বয় থাকবে না, এটা কাম্য নয়।
গতিসীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, বিভিন্ন দেশের নীতি তারা পর্যালোচনা করেছে। তাহলে তারা দেখাক, কোন দেশের নীতি পর্যালোচনা করেছে? কোন দেশে আলাদা লেন ছাড়া মোটরসাইকেলের গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দেওয়া আছে? হ্যাঁ, কিছু দেশের শহরে মোটরসাইকেলের গতিসীমা আছে। সেখানে আলাদা লেন আছে। এটা বিজ্ঞানসম্মত। কিন্তু বাংলাদেশে তো লেন নেই। বাংলাদেশে ব্যাটারিচালিত রিকশার গতি ৩০ কিলোমিটারের বেশি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মানুষের জীবিকার কথা বিবেচনা করে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। মোটরসাইকেলের বিষয়টিও এখানে এসে যায়। মানুষ কেন মোটরসাইকেল চালায়, সেটাও মাথায় রাখতে হবে। বহু তরুণ কোনো কাজ না পেয়ে মোটরসাইকেলে ‘রাইড শেয়ার’ করে কোনোরকমে বেঁচে আছেন, বহু তরুণ অনলাইনে কেনা পণ্য মোটরসাইকেলে পৌঁছে দিয়ে সামান্য কিছু টাকা আয় করে জীবন চালাচ্ছেন, বহু চাকরিজীবী খরচ ও সময় বাঁচাতে মোটরসাইকেলে চলাচল করেন।
অটোরিকশায় এখন ২০০ টাকার নিচে স্বল্প দূরত্বেও যাওয়া যায় না। অথচ মোটরসাইকেলে ততটুকু জায়গা যেতে তেল খরচ মাত্র ২০ থেকে ৩০ টাকা।
দেশের অর্থনীতি এখন চাপে আছে। নতুন কর্মসংস্থান কম হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি চড়া। এ অবস্থায় সেসব মানুষের কথা ভাবুন, যাঁদের জীবিকার উৎস মোটরসাইকেল। যাঁরা রাতে মোটরসাইকেল নিয়ে ‘রেসে’ নামেন, তাঁদের বিষয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। তাঁদের শাস্তি দেওয়া সরকারের দায়িত্ব।
দেশে মোটরসাইকেলের ১০টির মতো কারখানা হয়েছে। এসব কারখানায় হাজার হাজার মানুষ কাজ করেন। মোটরসাইকেল বিক্রি কমে গেছে, খাতটি ধুঁকছে। অথচ সরকারের নীতিসহায়তা ও উৎসাহ পেয়েই মোটরসাইকেল কারখানাগুলো হয়েছে। বাংলাদেশে মোটরসাইকেল বিক্রি বাড়বে, ব্যবহার বাড়বে। কারণ, অর্থনীতির বর্তমান অবস্থায় মানুষ নিজস্ব যানবাহন চায়, যা দিয়ে সহজে ও কম খরচে যাতায়াত সম্ভব।
একটা সময় মোটরসাইকেল বিক্রি জাপানে বেড়েছিল।
ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত—দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার সব দেশেই মোটরসাইকেলের বড় বাজার হয়েছে। অর্থনৈতিক একটা পর্যায়ে মোটরসাইকেল চালকেরা গাড়ি কিনবেন। তার আগে মোটরসাইকেল বিক্রি বাড়বে। আমাদের দরকার মোটরসাইকেলসহ সব ধরনের যানবাহনের দুর্ঘটনা কমাতে কাজ করা।
মোটরসাইকেল কেনাবেচা থেকে সরকার যে রাজস্ব পায়, তা বাজেটের ২ শতাংশের সমান। সরকার গতিনিয়ন্ত্রণে ‘স্পিডগান’ কেনা, সড়কে ক্যামেরা বসানো, টহল জোরদার করা, সচেতনতা কার্যক্রম বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারে। কোম্পানিগুলো এ ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এখন আমরা নিজেরা করছি। আমাদের ইয়ামাহা রাইডার্স ক্লাবে মানসম্মত হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল চালানো পুরোপুরি নিরুৎসাহিত করা হয়।
আমরা বাংলাদেশের নাগরিক, বাংলাদেশের কোম্পানি; দেশের ক্ষতি করে আমরা ব্যবসা করতে চাই না। আমরা চাই সরকার সবার সঙ্গে আলোচনা করে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করুক। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বাস্তবায়ন করুক। সড়কে যদি ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলতে দেওয়া হয়, লাইসেন্স ছাড়া চালকেরা যানবাহন চালান, তাহলে যেকোনো নীতিমালার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
সুব্রত রঞ্জন দাস: নির্বাহী পরিচালক, এসিআই মোটরস।