আগের দিনের আমির–খলিফারা শিক্ষকদের ও শিষ্টাচার শিক্ষাদানকারীদের সম্মান করতেন। তাঁদের দেখে সম্মানার্থে বাহন থেকে নেমে পড়তেন। এ কারণে শিক্ষকেরা সর্বস্তরের মানুষ থেকে খুব সম্মান পেতেন। একবার খলিফা হারুনুর রশিদ ইমাম মালিককে (র.) ডেকে লোক পাঠালেন। যাতে খলিফার দুই ছেলে আমিন ও মামুন তাঁর থেকে হাদিস শুনতে পারে। ইমাম মালিক অস্বীকৃতি জানালেন।
তিনি বললেন, ইলমের কাছে সবাই আসে, ইলম কারও কাছে যায় না। খলিফা হারুন দ্বিতীয়বার লোক পাঠালেন। বললেন, আমি আপনার কাছে আমার দুই ছেলেকে পাঠিয়ে দেব। তারা আপনার ছাত্রদের সঙ্গে বসে হাদিস শুনবে।
ইমাম মালিক বললেন, ‘তাহলে শর্ত এই যে তাঁরা মানুষের ঘাড় ডিঙিয়ে সামনে এসে বসবে না। বরং মজলিসে যেখানে জায়গা পাবে, সেখানে বসবে।’
এ ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয় একসময় শিক্ষকের মর্যাদা কেমন ছিল। আমরা দেখলাম দিন দিন শিক্ষকের মর্যাদা কমে গেল। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এর প্রথম কারণ হিসেবে বলা যায়, রাষ্ট্রের অবহেলা। রাষ্ট্র শিক্ষকদের নানা আঙ্গিকে মর্যাদার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। শিক্ষক সুচারুরূপে তখনই শিক্ষাদান করতে পারবেন, যখন তাঁর জীবনের প্রয়োজনগুলোর জন্য দুশ্চিন্তা করতে হবে না, তাঁর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে না, তাঁর কাজের ক্ষেত্রকে উৎকর্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্য উপকরণের অভাব বোধ হবে না। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কোনো মনোযোগ দেয়নি।
উন্নত বিশ্বের কথা বাদ দিলাম, আমাদের এশিয়ার দেশগুলোতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে বেতন দেওয়া হয়, আমাদের দেশে তা কল্পনা। সিঙ্গাপুর বা সৌদি আরবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মাসিক সর্বোচ্চ গড় বেতন চার হাজার ডলারের ওপরে অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় সাড়ে চার লাখের ওপরে বা প্রায় পাঁচ লাখের কাছাকাছি। প্রায় এই রকম বেতন দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনে।
কেবল সার্কভুক্ত আমাদের যে প্রতিবেশী দেশ আছে, যেমন ভারত, সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন শুরু হয় ৩৫ হাজার টাকা থেকে। পাকিস্তানে ৩০ হাজার, শ্রীলঙ্কায় ২৭ হাজার, নেপালে ৩৪ হাজার, ভুটানে ৩৩ হাজার ও মালদ্বীপে ৬৩ হাজার টাকা। আর আমাদের বাংলাদেশে প্রারম্ভিক বেতন ১৮ হাজার ৫০০ টাকা (সূত্র: কালের কণ্ঠ)
আমাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৯৭ শতাংশ বেসরকারি। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ঠিকমতো বেতনই পান না। যা পান, তা রীতিমতো লজ্জাজনক। আর্থিকভাবে তাঁদের অসম্মানের কারণে সামাজিকভাবেও শিক্ষকদের অবস্থান সুখকর নয়। এ কারণে এ পেশায় আগ্রহী হয়ে কেউ আসতে চান না। যারা আসেন, তারা দায়ে পড়ে। সমাজ তাদের বিব্রত করে।
অনেক জায়গায় শিক্ষককে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে আঘাত করে। এমনকি যে শিক্ষক সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান করেন, সেই গুরুর প্রতি কোনো শিষ্য অপবাদ, অপমান এবং লাঞ্ছিত করতেও ছাড়ে না।
শিক্ষকতা পেশায় দক্ষতা অর্জন, তার চর্চা এবং দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রগুলো অনুর্বর এবং অনুন্নত। এখানে শিক্ষকদের নেই ব্যক্তিগত ও পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নের জন্য যথাযথ এবং যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ।
তবে কি ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কেবল বইয়ের পাতায়ই শোভা পাবে? রাষ্ট্র, সমাজ এবং সমাজের মানুষের কি কোনো দায়বদ্ধতা নেই! উত্তরে বলা যায়, অবশ্যই আছে। এবার দেখা যাক শিক্ষকদের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে কী কী কাজ অবশ্যই করা প্রয়োজন। প্রথমত, শিক্ষকদের সম্মানজনক জীবনধারণের জন্য বেতন–ভাতা বৃদ্ধি করা। শিক্ষকদের ধারাবাহিকভাবে প্রশিক্ষণ প্রদান। শিক্ষকদের পড়াশোনা ও গবেষণা করার সুযোগ প্রদান। টেলিভিশন, পত্রিকা এবং অন্যান্য মিডিয়াতে শিক্ষকদের নিয়ে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কাজ করা; যেটা আমাদের বাংলাদেশে হয় না।
আমাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৯৭ শতাংশ বেসরকারি। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ঠিকমতো বেতনই পান না। যা পান, তা রীতিমতো লজ্জাজনক। আর্থিকভাবে তাঁদের অসম্মানের কারণে সামাজিকভাবেও শিক্ষকদের অবস্থান সুখকর নয়।
জাতীয় শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচনের একটি পদ্ধতি আছে আমাদের দেশে। এখানে যিনি নির্বাচিত হন, তাঁকে ২৫ হাজার টাকার সম্মানী চেক দেওয়া হয়। এটা কমপক্ষে ১ লাখ টাকা করা উচিত। এ ছাড়া নাগরিক জীবনের নানা রকম সুবিধা শিক্ষকদের জন্য রাখা উচিত।
শিক্ষকদের নৈতিক চরিত্র দৃঢ় না হলে আদর্শের জায়গাটা নড়বড়ে হয়ে পড়ে। তাই শিক্ষকদের হতে হবে নৈতিক, মানবিক, সাংস্কৃতিক গুণাবলিসম্পন্ন, মেধাবী, চিন্তা ও কাজে আন্তরিক সৎ এবং নির্লোভ।
শিক্ষক শব্দের পূর্ণরূপ শিষ্টাচার, ক্ষমা ও কর্তব্যপরায়ণতা। এই তিন গুণ যিনি আয়ত্ত করেছেন, তিনিই শিক্ষক। আর এমন শিক্ষকই গড়ে তুলতে পারেন সত্যিকারের মানুষ, যারা প্রকৃতই জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে পরিগণিত হবে।
হাদিসে বলা আছে, ‘আকাশের অগণিত তারা, সমুদ্রের গভীর তলের মাছ ও মাটির গর্তের পিপীলিকা সেই শিক্ষকের জন্য দোয়া করে, যে শিক্ষক সৎ ও সুশিক্ষা দান করেন।’ অথচ আমরা মানুষ হয়ে শিক্ষাগুরুর মর্যাদা যদি না রাখি, তাহলে কী করে মর্যাদাবান নাগরিক দেশে গড়ে উঠবে?
মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। তাই সভ্যতায় শিক্ষাব্যবস্থার যখন সূচনা হলো, সেই শিক্ষার সঙ্গে নিবিড় হলে জড়িয়ে আছেন শিক্ষক। সেই শিক্ষকদের মর্যাদা না রাখলে সভ্যতাও ঠিক থাকবে না।
তাসনীম চৌধুরী শিক্ষক