ইসরায়েলের উন্মত্ততা বলে দিচ্ছে তারা হেরে যাচ্ছে

রাফায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত শিশুর লাশ নিয়ে স্বজনদের আহাজারিছবি: এএফপি

আন্তর্জাতিক দৃশ্যপটে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক চারটি ঘটনা সম্ভবত ইসরায়েলকে কোণঠাসা করে ফেলবে এবং ইসরায়েল সব সময় যে মুখোশ পরে বিশ্বের সামনে হাজির হয়, সম্ভবত এই ঘটনাগুলো সেই মুখোশকে টেনে খুলে ফেলবে।

চার ঘটনার প্রথমটি হলো যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিক্ষোভ। দ্বিতীয়টি হলো, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির প্রক্রিয়া। তৃতীয়টি হলো, ফিলিস্তিনকে স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ের স্বীকৃতি দেওয়া। সর্বশেষ ঘটনা হলো, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) ইসরায়েলকে রাফাতে হামলা বন্ধের নির্দেশ।

ইসরায়েল নিজেকে ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ হিসেবে দাবি করে ফিলিস্তিনি ‘সন্ত্রাসবাদের’ বিরুদ্ধে তার চালানো যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে ন্যায্যতা দিতে যে মিথ্যা ভাষ্য গড়ে তুলেছে, সেই ভাষ্যকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ঘটনাগুলোকে ‘হিমশৈলের ডগামাত্র’ বলা যেতে পারে।

আরও পড়ুন

ইসরায়েলের অপরাধগুলোর সাম্প্রতিকতমটি সংঘটিত হয়েছে ২৬ মে সন্ধ্যায়। ওই দিন রাফায় জাতিসংঘের পরিচালনাধীন একটি ‘নিরাপদ অঞ্চলে’ আশ্রয় নেওয়া বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের তাঁবুতে ইসরায়েল সেনাবাহিনী রকেট ছোড়ে। এতে অন্তত ৪০ জন পুড়ে মারা গেছেন, যাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন নারী ও শিশু।

ইসরায়েল যদিও আইসিসি, আইসিজে এবং ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া তিনটি ইউরোপীয় দেশকে ‘প্রতিশোধমূলক হুমকি’ দিয়েছে, তবে সেই হুমকিগুলো আরও বেশি ভীতি নিয়ে অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং পশ্চিম তীরের প্যালেস্টিনিয়ান অথোরিটির (পিএ) কাছে গেছে।

আমরা যাঁরা পশ্চিম তীরের বাসিন্দা, তাঁরা এখন ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় হুমকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছি।

২২ মে ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ‘কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা’ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এসব শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মধ্যে ফিলিস্তিনিদের প্রাপ্য রাজস্ব আটকে দেওয়া, ফিলিস্তিনি ব্যাংকগুলোকে বাইরের সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা, পশ্চিম তীরে ইহুদিদের জন্য আরও কয়েক হাজার হাউজিং ইউনিট নির্মাণের অনুমোদন করা, ‘একতরফাভাবে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়, এমন প্রতিটি দেশের’ সঙ্গে নতুন বন্দোবস্তে যাওয়া ইত্যাদি।

মার্কিন অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন এবং জি-৭ ভুক্ত কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন কর্মকর্তারা ফিলিস্তিনি ব্যাংকগুলোকে বিচ্ছিন্ন করার হুমকির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলে ফিলিস্তিনি অর্থনীতির জীবন রক্ষাকারী ধমনি অচল হয়ে যাবে।

২২ মে গ্যালান্ট পশ্চিম তীরের উত্তরাঞ্চলের সুরক্ষায় ২০০৫ সালে প্রণয়ন করা ইসরায়েলি ‘বিচ্ছিন্নতা আইন’ প্রত্যাহার করেছেন।

তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারনের প্রণয়ন করা আইনটিতে গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলের দখলদারি সরিয়ে নেওয়া এবং পশ্চিম তীরে চারটি ইহুদি বসতি সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এখন সেই আইন বাতিলের ফলে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা সেই সরিয়ে নেওয়া বসতিগুলোকে আবার সেখানে ফিরে যাওয়ার অনুমতি পেলেন।

২২ মে ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ‘কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা’ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এসব শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মধ্যে ফিলিস্তিনিদের প্রাপ্য রাজস্ব আটকে দেওয়া, ফিলিস্তিনি ব্যাংকগুলোকে বাইরের সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা, পশ্চিম তীরে ইহুদিদের জন্য আরও কয়েক হাজার হাউজিং ইউনিট নির্মাণের অনুমোদন করা, ‘একতরফাভাবে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয় এমন প্রতিটি দেশের’ সঙ্গে নতুন বন্দোবস্তে যাওয়া ইত্যাদি। 

আরও পড়ুন

মার্কিন অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন এবং জি-৭ ভুক্ত কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন কর্মকর্তারা ফিলিস্তিনি ব্যাংকগুলোকে বিচ্ছিন্ন করার হুমকির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলে ফিলিস্তিনি অর্থনীতির জীবন রক্ষাকারী ধমনি অচল হয়ে যাবে। 

২২ মে গ্যালান্ট পশ্চিম তীরের উত্তরাঞ্চলের সুরক্ষায় ২০০৫ সালে প্রণয়ন করা ইসরায়েলি ‘বিচ্ছিন্নতা আইন’ প্রত্যাহার করেছেন। একই দিনে ইসরায়েলের পার্লামেন্টে একটি বিল পাস হয়েছে যা দখলকৃত দক্ষিণ হেবরন পাহাড়কে ইসরায়েলি নাকাব অঞ্চলের সঙ্গে জুড়ে দেবে। এগুলো ইসরায়েলের ঔদ্ধত্যকে সামনে আনে। ইসরায়েল যে নিজেকে আন্তর্জাতিক আইনের ঊর্ধ্বে বলে ভাবে এবং তারা যে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র ও তার সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারকে মাড়িয়ে যাচ্ছে, তা তাদের কর্মকাণ্ডে প্রকাশিত হয়ে গেছে। 

একই দিনে, ইসরায়েলের পার্লামেন্টে একটি বিল পাস হয়েছে, যা দখলকৃত দক্ষিণ হেবরন পাহাড়কে ইসরায়েলি নাকাব অঞ্চলের সঙ্গে জুড়ে দেবে।

এগুলো ইসরায়েলের ঔদ্ধত্যকে সামনে আনে। ইসরায়েল যে নিজেকে আন্তর্জাতিক আইনের ঊর্ধ্বে বলে ভাবে এবং তারা যে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র ও তার সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারকে মাড়িয়ে যাচ্ছে, তা তাদের কর্মকাণ্ডে প্রকাশিত হয়ে গেছে।

বিশ্বে নতুন বাস্তবতা তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট ইসরায়েলকে খারিজ করার প্রবণতা বাড়ছে এবং সেই নতুন বাস্তবতা দখলদারি এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকে ক্রমবর্ধমানভাবে সংহত করছে।

ব্যক্তি, রাষ্ট্র কিংবা প্রতিষ্ঠান—যে যখনই ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড বা নীতির সমালোচনা করেছে, ইসরায়েল তখনই তার বিরুদ্ধে ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগ তুলে তাকে আক্রমণ করেছে।

ইসরায়েলের এই চরমপন্থী অবস্থানে সব সময় তার সবচেয়ে বড় মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য পাশে ছিল। তাদের ওপরই দেশটি সব সময় নির্ভর করে এসেছে। ইসরায়েলের বাইরে শুধু এই দুই দেশ আইসিসির সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল।

এই ‘শাস্তিমূলক ব্যবস্থা’ ইসরায়েলের বর্তমান ও পূর্ববর্তী সরকারগুলোর কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আগেভাগেই ঠিক করে রেখেছে। এগুলো তাদের পরিকল্পনার অংশ। একটি শান্তিচুক্তিতে পৌঁছানো এবং একটি বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে যাতে অসম্ভব করে তোলা যায়, সেই লক্ষ্যেই তারা কাজ করে যাচ্ছে।

অনেক ফিলিস্তিনি এখন মনে করছেন, ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা ও দখলদারির থেকে বাঁচানোর জন্য যথেষ্ট হবে না। তাঁরা মনে করেন, গাজায় যে নারকীয় তাণ্ডব চালানো হচ্ছে, তাতে বিশ্ববাসী বিক্ষুব্ধ হচ্ছেন এবং সেই ক্ষোভকে সাময়িকভাবে প্রশমিত করার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে সত্যিকার অর্থে কার্যকর পদক্ষেপের (যেমন ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানি বন্ধ করা, ইসরায়েলকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে বর্জন করা এবং ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা) দিকে মনোনিবেশ না করে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে।

তাঁদের এই ধারণা যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ। তবে একই সঙ্গে আমি দেখতে পাচ্ছি, ফিলিস্তিনিরা ধাপে ধাপে যা অর্জন করছেন, তা ইসরায়েলি দখলদারির অবসান ও ন্যায়বিচার পাওয়ার লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এটি প্রতিপক্ষকে এক ঘুষিতে ফেলে দেওয়ার মতো ব্যাপার নয়; বরং বারবার আঘাত করে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে ফেলার মতো ব্যাপার।

বিশ্বে নতুন বাস্তবতা তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট ইসরায়েলকে খারিজ করার প্রবণতা বাড়ছে এবং সেই নতুন বাস্তবতা দখলদারি এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকে ক্রমবর্ধমানভাবে সংহত করছে।

আন্তর্জাতিক জনমত আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন গণহত্যা বন্ধ করা, দখলদারি অবসান ঘটানো এবং ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের বৈধ অধিকার দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন।

আমাদের আশা, এই ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক ঐকমত্য জনমতের একটি বৈশ্বিক সুনামি ঘটাবে এবং সেই সুনামির তোড়ে ইসরায়েলি দখলদারি ভেসে যাবে। সেই সুনামি ফিলিস্তিনের জনগণের জন্য ন্যায়বিচার ও মর্যাদা নিয়ে আসবে।

  • ফরিদ তামাল্লাহ রামাল্লায় বসবাসরত একজন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক

  • মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ