অগ্নিদুর্যোগ নিয়ে ফায়ার সার্ভিসকে যা করতে হবে

বেইলি রোডে বহুতল আগুন লাগার পর ধোঁয়ায় ঢেকে যায় পুরো ভবন। এরই মধ্যে আগুন নেভাতে চলে ফায়ার সার্ভিসের চেষ্টাছবি : প্রথম আলো

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের অন্যতম কাজ হলো অগ্নিকাণ্ড যাতে না ঘটে, সেই বিষয়ে জনসাধারণকে সচেতন করা এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জান, মাল রক্ষা ও উদ্ধারে জীবন বাজি রেখে কাজ করা।

পাশাপাশি ফায়ার বিষয়ক ‘লাইসেন্স’ ও ‘ছাড়পত্র’ প্রদান, নবায়ন এবং ফায়ার সেফটির জন্য সঠিক নিয়মে ফায়ার ইকু৵ইপমেন্টস ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, এই বিষয়গুলোও দেখভাল করা।

অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতি দশকেই ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ইমারত ও জনসংখ্যা। রাজধানী ঢাকাসহ সমগ্র বাংলাদেশের নগরীগুলোতে ঘটিত অগ্নিদুর্যোগ আজ বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে। সেই তুলনায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রস্তুতি যথেষ্ট কি?

প্রেক্ষাপট
একটি ভবন গড়ে ওঠা থেকে শুরু করে এর কার্যক্রম চলা পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপের সঙ্গে সরাসরি ছয়টি সংস্থা যুক্ত থাকে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও যুক্ত রয়েছে। কারণ, এসব সেবা সংস্থা ও কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের মধ্য দিয়ে এসব ভবন গড়ে ওঠা ও এর কার্যক্রম চলার কথা। কিন্তু কার্যত নিয়মকানুন কোনো কিছুই মেনে চলা হয় না।

বিদ্যমান বিভিন্ন আইনের অসামঞ্জস্যতার কারণে নগরীর অগ্নিঝুঁকির বিষয়গুলো সমন্বয়হীনতা ও ব্যত্যয়ের আবর্তে বন্দী হয়ে আছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দুর্বল অবকাঠামোর কারণে ঢাকাসহ সারা দেশের হাজার হাজার স্থাপনা মারাত্মক অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর ২০২৩ সালে সারা দেশের ৫ হাজার ৩৭৪টি ভবন পরিদর্শন করে ১ হাজার ৬৯৪টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ও ৪২৪টি ভবন অতি অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করেছে।

প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাতেই কোনো না কোনো সরকারি সংস্থার গাফিলতি ও তদারকির অভাব ছিল বলে প্রতীয়মান। ২০১০ সালের ৩ জুন চানখাঁরপুলের নিমতলীতে কেমিক্যালের গোডাউনে অগ্নিকাণ্ড, ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ড, ২০১৯ সালের পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় রাসায়নিক গুদামে বিস্ফোরণ, একই বছরের ২৮ মার্চ বনানীর বহুতল বাণিজ্যিক ভবন এফআর টাওয়ারে আগুন, এসব দুর্ঘটনায় ৩৩৪ জনের মৃত্যুর এখনো পর্যন্ত কোনো বিচার হয়নি।

সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ড একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি মাত্র। ‘অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩’-এ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে মামলা করার ক্ষমতা দেওয়া হলেও এ সম্পর্কিত ‘অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ বিধিমালা ২০১৪’ স্থগিত থাকার কারণে অগ্নিকাণ্ডজনিত হত্যাকাণ্ড রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন বা প্রতিষ্ঠানে চিঠি প্রদান করা ছাড়া তাদের কিছুই করণীয় নেই।

প্রতিটি অগ্নিদুর্ঘটনার পর বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে পরবর্তী সময়ে পর্যাপ্ত নজরদারি ও তদারকির অভাবে নানান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ভবনের অগ্নিনির্বাপণের সিঁড়ি হয়ে যায় গুদাম কিংবা গ্যাস সিলিন্ডার রাখার স্থান, স্পিঙ্কলারগুলো কিংবা ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম কার্যক্ষম কি না, ফায়ার এক্সটিংগুইশারগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ কি না, তা সবার অগোচরেই থেকে যায়।

অগ্নিনির্বাপণের প্রাথমিক প্রতিরোধের (গুরুত্বপূর্ণ প্রথম ১৫ মিনিট) জন্য অন্তর্ভুক্ত প্রশিক্ষিত জনবল অর্থাৎ ‘ফায়ার ভলান্টিয়ার’ তৈরির অভাব আজ দারুণভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর দেশব্যাপী প্রায় ৬৫ হাজার ‘আরবান কমিউনিটি লেভেল ভলান্টিয়ার’ তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও সেখানেও রয়েছে ধারাবাহিকতার অভাব।

আরও পড়ুন

প্রতিটি জনসমাগমপূর্ণ ভবনে অথবা শিল্পকারখানায়, যেখানে অনেক মানুষ বিপদগ্রস্ত হতে পারেন, সেখানে প্রশিক্ষিত ‘ফায়ার ভলান্টিয়ার’ নিয়োগ দেওয়া যেত, তাহলে অগ্নিদুর্ঘটনায় ক্ষতির সংখ্যা অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব হতো।

অপরদিকে শিল্প আইনে ১৮ শতাংশ এরূপ প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগের প্রবিধান থাকা শর্তেও আমরা তা অদ্যাবধি তৈরি করতে পারিনি।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো নিয়ন্ত্রণ বা নির্বাপণে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এখনো পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। বাংলাদেশের সব উপজেলা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের মতো শিল্প এলাকাকেন্দ্রিক শহর, বেপজা, বেজা, ইপিজেডসহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গার জন্য ন্যূনতম ৭৩৫টি স্টেশন প্রয়োজন, যার বিপরীতে বর্তমানে ফায়ার স্টেশন আছে মাত্র ৪৯৫টি।

দেশে বর্তমানে থাকা মোট ফায়ার স্টেশনের মধ্যে ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত রয়েছে ৯২টি, ‘বি’ শ্রেণিভুক্ত ২৮৮টি, ‘বি’ স্থল-কাম-নদী স্টেশন ৪টি, ‘সি’ শ্রেণিভুক্ত ১০০টি এবং নদী ফায়ার স্টেশন ১১টি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকা শহরে প্রতি ৭ লাখ ৪২ হাজার ১৭০ অধিবাসীর জন্য মাত্র একটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন আছে। অপরদিকে, ফায়ার সার্ভিস ও সিভেল ডিফেন্স অধিদপ্তর-এ অনুমোদিত জনবলের মাত্র ৪০ শতাংশ বর্তমানে নিয়োজিত রয়েছে।

অর্থাৎ ফায়ার সার্ভিসের সংখ্যা যেমন অপ্রতুল, তেমনি তাদের জনবল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিরও স্বল্পতা রয়েছে। একই সঙ্গে সাধারণ জনগণও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন নন।

দেশজুড়েই অপরিকল্পিত নগরায়ণের চিত্রটি সামনে আসে অগ্নিদুর্ঘটনার সময়ে। নগরবাসীদের চিত্তবিনোদনের জন্য উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান, গণপরিসর এবং জলাশয়গুলো ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে। বহুতল ভবনগুলোতে স্থাপিত শপিং মল, রেস্টুরেন্টগুলোই হয়ে উঠেছে নগরবাসীর চিত্তবিনোদনের কেন্দ্রস্থল।

আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালের দোকান বা সামগ্রী, ঘিঞ্জি পরিবেশ, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, সরু রাস্তা দিয়ে উদ্ধারসামগ্রী পৌঁছাতে কষ্টসাধ্য, অগ্নিপ্রতিরোধের ব্যবস্থার অনুপস্থিতি বা মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থা, ঢাকার আশপাশে এবং মধ্যে জলাশয়ের অভাবে উদ্ধার কার্যক্রমও অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে।

করণীয়
এক. আগামী ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে ভবন নির্মাণ অনুমোদন এবং ব্যবসায়িক লাইসেন্স অনুমোদনকারী সংশ্লিষ্ট সরকারি ৬টি মন্ত্রণালয় বা সংস্থার সমন্বয়ে ‘টাস্ক ফোর্স’ গঠনপূর্বক নগরীতে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিতকরণ এবং তার দ্রুত যথাযথকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

একই সঙ্গে চিহ্নিত ‘অতি বিপজ্জনক’ ও ‘বিপজ্জনক’ ভবনগুলোর হালনাগাদ তালিকা নিয়মিতভাবে ওয়েবসাইটে প্রকাশের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ভবনগুলোর সম্মুখে দৃশ্যমানভাবে প্রকাশের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

দুই. অবিলম্বে স্থগিত ‘অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ বিধিমালা-২০১৪’ অনুমোদন ও বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি ‘অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন, ২০০৩’ এর ধারা ১৭ থেকে ২৩ পর্যন্ত বর্ণিত শাস্তির বিধান বাস্তবায়ন ও প্রয়োগে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরকে ক্ষমতায়ন করতে হবে।

তিন. ‘ফায়ার লাইসেন্স’ প্রদান কমিটিতে দক্ষ এবং পর্যাপ্ত পেশাজীবীদের অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি ভবনের ‘প্রতিবছর নবায়নযোগ্য ব্যবহারযোগ্যতা’র সনদ প্রদানের আগে ‘ফায়ার সেফটি অডিট’ নিশ্চিত করতে হবে।

চার. ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ‘সিভিল ডিফেন্স’ অংশকে শক্তিশালী করার উদ্যোগে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে প্রতিটি উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত প্রশিক্ষিত জনগণ তৈরির কার্যক্রমকে বাস্তবায়ন করতে হবে।

আরও পড়ুন

পাঁচ. ফায়ার স্টেশনবিহীন ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্টগুলো জরুরি ভিত্তিতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে বর্তমানে উদ্যোগ গ্রহণ করা ‘স্যাটেলাইট ফায়ার স্টেশন’ স্থাপন ও পরিচালনা করার সার্বিক ও সর্বাঙ্গীণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে দেশজুড়ে স্থাপিত শিল্পাঞ্চলগুলো অগ্নিদুর্যোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা অর্জন করতে পারে।

ছয়. ‘ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স’কে সময়োপযোগী, যুগোপযোগী এবং সর্বাঙ্গীণ করার নিমিত্তে উক্ত সংস্থার প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের পাশাপাশি যথোপযুক্ত দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল বৃদ্ধির উদ্যোগ ও কার্যক্রম দ্রুততার সহিত গ্রহণ করতে হবে।

সাত. অগ্নিঝুঁকি ও নিরাপত্তাবিষয়ক নিয়মিত গণসচেতনতামূলক ‘স্মার্ট প্রচার ও জনসংযোগ’ কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি জনস্বার্থে বহুতল আবাসিক, বাণিজ্যিক ভবন এবং শিল্পাঞ্চলগুলোর ধারাবাহিকভাবে ‘ফায়ার ড্রিল’ পরিচালনা করতে হবে।

আট. অবিলম্বে সব নগর এলাকা, বিশেষ করে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অধীন ফায়ার স্টেশন বা ‘অগ্নিনির্বাপণ কেন্দ্রগুলোর’ নিয়ন্ত্রণ অধীন এলাকার অগ্নিঝুঁকিজনিত বিপজ্জনকতার ওপর সার্বিক সমীক্ষা গ্রহণপূর্বক তা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

  • ইকবাল হাবিব স্থপতি ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি।