জাতীয় নির্বাচন নাকি স্থানীয় নির্বাচন—কোনটি আগে?

আমরা দুই ধরনের সরকারের সঙ্গে পরিচিত। একটি হলো স্থানীয় সরকার এবং অন্যটি হলো জাতীয় বা কেন্দ্রীয় সরকার। তবে সরকার বলতে আমরা দ্বিতীয়টিকেই বুঝি। সরকার মানেই ঢাকায় বসে কিছু লোক ছড়ি ঘোরান। তাঁদের দখলে আছে সচিবালয়, পার্লামেন্ট ও আদালত। সঙ্গে আছে জেলখানা, গোয়েন্দা, পুলিশ আর মিলিটারি।

স্থানীয় সরকার আছে তিন স্তরে—জেলা পর্যায়ে জেলা পরিষদ, উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ। ছোট শহরে আছে পৌরসভা। বড় শহরে আছে সিটি করপোরেশন। এগুলো নামেই সরকার। ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সরদার। আমাদের দেশে স্থানীয় সরকার পরিচালিত হয় কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে। বলা যায়, এটি সরকারের এক্সটেনশন, স্থানীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাজকর্মের জোগালি। সরকারি কর্মকর্তারা চাইলেই স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিকে বরখাস্ত করতে পারেন।

তারপরও স্থানীয় সরকারের একটা গুরুত্ব আছে। কারণ, এটা নাগরিকদের একেবারে ঘরের দুয়ারে। ধরা যাক, ইউনিয়ন পরিষদ। কোনো ঝামেলা না হলে পাঁচ বছর পরপর এখানে নির্বাচন হয়। ব্রিটিশ আমল থেকেই হয়ে আসছে। তখন নাম ছিল ইউনিয়ন বোর্ড। পাকিস্তান আমলে নাম হলো ইউনিয়ন কাউন্সিল। বাংলাদেশে নাম হলো ইউনিয়ন পরিষদ। এর মধ্যে কাজের পরিধি অনেক বেড়েছে। বেড়েছে খরচ ও আর্থিক বরাদ্দ। আগে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রধান ছিলেন প্রেসিডেন্ট। ব্রিটিশ আমলে প্রেসিডেন্ট বলতে ইউনিয়ন বা জেলা বোর্ডের প্রেসিডেন্টকেই বোঝাত। এখন তো প্রেসিডেন্ট হলেন রাষ্ট্রপ্রধান। তিনি বসেন বঙ্গভবনে। স্থানীয় পর্যায়ে প্রেসিডেন্টরা হয়ে গেছেন চেয়ারম্যান।

এ দেশের নাগরিক সমাজ ও রাজনীতিবিদেরা অনেকেই অনেক দিন ধরে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন নিয়ে কথা বলে আসছেন। ক্ষমতায়নের ভিত্তি হচ্ছে স্বশাসন। উদাহরণস্বরূপ, ইউনিয়ন পরিষদ হবে স্বাধীন। এটি খাজনা আদায় করবে, বাজেট তৈরি করবে এবং সে অনুযায়ী খরচ করবে, সেবা দেবে। এটি হয়ে ওঠেনি। যাঁরা রাজধানীতে বসে সিদ্ধান্ত নেন, তাঁদের আছে সর্বগ্রাসী ক্ষুধা। তাঁরা তামাম দেশটাকেই বগলদাবা করতে চান। ক্ষমতা ভাগাভাগি কিংবা দায়িত্ব বিলিবণ্টনের মানসিকতা নেই। কেন্দ্রীয় সরকার হচ্ছে সার্বভৌম। স্থানীয় সরকার হচ্ছে অধস্তন এজেন্ট।

ঢাকায় যখন একটা সরকার থাকে, সে তার সব সেবামূলক কাজ করে ইউনিয়ন বা উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে। এগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকলে ঢাকায় নিজেকে অনেক নিরাপদ ও নিরুপদ্রব মনে হয়। সে জন্য দেখা যায়, যিনি সংসদ সদস্য হন, তিনি তাঁর পছন্দের ও অনুগত লোকদের স্থানীয় সরকারে দেখতে চান। এর ফলে তিনি স্থানীয় পর্যায়ের সেবা ও সম্পদের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।

ইউনিয়ন পরিষদ হচ্ছে সংসদ সদস্যের ক্ষমতার ভিত্তি। স্থানীয় নেতারা সংসদ সদস্য তথা জাতীয় নেতাদের টাকা ও লাঠির উৎস। সংসদ নির্বাচনের সময় তাঁরাই ভোট জোগাড় করে দেন। আবার জাতীয় নেতাদের সঙ্গে দহরম-মহরম রেখে স্থানীয় নেতারা একদিকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখেন, অন্যদিকে তাঁর ‘রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক’কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নিজের তরক্কি বাড়ান। এ ব্যবস্থা চলে আসছে দশকের পর দশক।

একটা সময় ছিল, গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত, ভদ্র ও বনেদি পরিবারের লোকটিই স্থানীয় সরকারের নেতা হতেন। অনেক ক্ষেত্রে তিনি নিজের টাকা খরচ করে মানুষের সেবা করতেন। এগুলো এখন রূপকথা মনে হয়। বেশির ভাগ জায়গায় দেখা যায়, গ্রামের সবচেয়ে খারাপ লোকটাই ‘নির্বাচিত’ হচ্ছেন। তিনি এটা পারছেন পেশির জোরে এবং তাঁকে প্রশ্রয়দানকারী নেতার আনুকূল্য পেয়ে। বলা যায়, স্থানীয় সরকারগুলো সংসদ সদস্যদের জন্য কামধেনু। অনেক রাজনীতিবিদ আছেন, যাঁরা দেশের মানুষের উপকারের চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারেন না। তাঁরা এই ব্যবস্থা জিইয়ে রেখেছেন তাঁদের ইহজাগতিক স্বার্থে।

গত বছর আগস্ট মাসে দেশে একটা ওলট-পালট ঘটে গেছে। আমরা ভাবছি, নতুন করে স্বাধীন হয়েছি। সুতরাং আগের মতো করে এ দেশ চলবে না, চালাতে দেওয়া হবে না। সবাই যে এক রকম ভাবছেন, তা বলা যাবে না। অনেকেই বদলাচ্ছেন, অনেকে আছেন আগের মতোই। এত ঝড়ঝাপটা গেল, এত মানুষ মরল, তাতে তাঁদের ভ্রুক্ষেপ নেই। ক্ষমতার রাজনীতিতে সহসা গুণগত পরিবর্তন আসবে, এমনটি জোর গলায় বলা যাচ্ছে না।

সংস্কার আগে না নির্বাচন আগে, এ নিয়ে কথার ফুলঝুরি দেখছি। এর মধ্যে আরেকটা ঝগড়া ঢুকে গেছে—আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, নাকি সংসদ নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচনে যাঁরা সরকার গঠন করার ব্যাপারে আশা রাখেন, তাঁরা চান সংসদ নির্বাচন হোক আগে। নির্বাচিত সরকারের অধীন হোক স্থানীয় সরকার নির্বাচন।

একটা উদাহরণ দিই। এক-এগারোর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংসদ নির্বাচনের আগে উপজেলা নির্বাচন করতে চেয়েছিল। বড় দলগুলো, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এতে রাজি হয়নি। ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে হলো জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে উপজেলা নির্বাচনের আয়োজন করে। মারদাঙ্গা করে বেশির ভাগ উপজেলায় আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীরা জিতে যান। নির্বাচন কমিশন অসহায়ভাবে চেয়ে চেয়ে দেখে। কমিশনের প্রধান এ টি এম শামসুল হুদা সে সময় একটি মন্তব্য করেছিলেন, দলীয় সরকারের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

শেখ হাসিনার রাজত্বে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের নিয়ম চালু হয়। হাসিনার স্তাবকেরা যুক্তি দাঁড় করান, অমুক অমুক দেশে তো এই ব্যবস্থা আছে, তাহলে এ দেশে এ রকম হলে অসুবিধা কোথায়? তো দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজন করে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। দলবাজি পৌঁছে গেছে ঘরে ঘরে। রাজনীতি আর দলবাজি যে এক জিনিস নয়, এটা তাঁদের কে বোঝাবে?

ইদানীং রাজনীতিবিদেরা একটা মুখরোচক কথা চালু করেছেন, দেশে বিরাজনৈতিকীকরণ চলছে। রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে কিসের নির্বাচন? স্থানীয় সরকার যে দল-মতের ঊর্ধ্বে সবার সরকার ও সব মানুষ সেখানে সেবা পেতে যান, সেখানে দলীয় ক্ষমতার চর্চা কতটুকু যৌক্তিক, এটা তাঁরা ভেবে দেখেন না। দল মানে গোষ্ঠী, অলিগার্কি। সব জায়গায় তাঁদের গোষ্ঠীগত নিয়ন্ত্রণ চাই।

রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত স্থানীয় সরকার থাকলে রাজনীতিবিদদের অনেক অসুবিধা। রাজনীতিবিদেরা যেভাবে ক্ষমতার ছক কষেন, স্থানীয় সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারালে তাঁদের অসুবিধায় পড়তে হবে বলে তাঁরা মনে করেন। এ জন্য তাঁরা সংসদ নির্বাচনের আগে ইউনিয়ন বা উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের ঘোর বিরোধী। তাঁদের আশঙ্কা, স্থানীয় সরকারের নির্বাচন আগে হয়ে গেলে সংসদ নির্বাচনের সময় তাঁদের ভোট জোগাড় হবে কীভাবে? টাকাপয়সার ব্যাপার তো আছেই।

ক্ষমতাপ্রত্যাশী কোনো কোনো রাজনৈতিক দল মনে করে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিয়ে একটা ভিত্তি তৈরি করে অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থেকে যেতে চায়। এটি একটি ষড়যন্ত্র। জেনারেল আইয়ুব খান ও জেনারেল এরশাদ এভাবেই অনেক দিন ক্ষমতায় ছিলেন। এটা অবশ্যই একটা আশঙ্কার কথা। অন্তর্বর্তী সরকারের যে কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই, এটা তাদের স্পষ্ট করতে হবে। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন আয়োজন করতে গিয়ে জাতীয় নির্বাচন থেকে ‘ফোকাস’ যেন সরে না যায়, সেটিও দেখতে হবে।

হাসিনা সরকারের পতনের পর তাঁর সাজানো বাগান তছনছ হয়ে গেছে। স্থানীয় সরকারে তাঁর আশ্রিত ও তাঁর দ্বারা পরিপুষ্ট যাঁরা ছিলেন, তাঁরা অনেকেই ভেগে গেছেন। মেয়র-চেয়ারম্যানদের অপসারণ করাও হয়েছে। মানুষ দরকারি সেবাগুলো পাচ্ছে না। যদি এক-দেড় বছর পর সংসদ নির্বাচন হয়, তত দিন সাধারণ মানুষকে সেবাবঞ্চিত রাখা হবে কোন যুক্তিতে? এদিক থেকে বিবেচনা করলে বলতে হয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজন করা হোক। এটি এ বছর এপ্রিল-মে মাসের মধ্যেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। তারপর তো বর্ষা এসে যাবে। একই সঙ্গে সংসদ নির্বাচনেরও সম্ভাব্য একটি তারিখ ঠিক করা যেতে পারে।

  • মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক